ঢাকাশুক্রবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ৫ বৈশাখ ১৪৩২

আতহার আলী খান : লাল-সবুজের বলিষ্ঠ কণ্ঠযোদ্ধা

আবদুল্লাহ আল মাসুম

শুক্রবার, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ , ০৬:৫৫ পিএম


loading/img

দেশ কিংবা দেশের বাইরে, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল পৃথিবীর যে প্রান্তেই মাঠের লড়াইয়ে নামুক না কেন, সেখানেই তার সদর্প উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তবে মাঠে ক্রিকেটারদের মতো ব্যাট-বল হাতে তিনি লড়াই করেন না, তার লড়াইটা চলে কমেন্ট্রি বক্সে মাইক্রোফোন হাতে। ক্রিকেট বিশ্বে লাল-সবুজের পতাকা বয়ে চলা বলিষ্ঠ এই কণ্ঠযোদ্ধার নাম আতহার আলী খান। 

বিজ্ঞাপন

স্বাধীন বাংলাদেশে আশির দশকে ক্রিকেটে সর্বপ্রথম যাত্রা শুরু করেছিল। তাই বর্তমান সময়ের হিসাবে শুধু পরিসংখ্যান দিয়ে বিচার করলে আতহার গড়পড়তা মানের ক্রিকেটার ছিলেন। তবে সেই সময়ের স্টাইলিশ এই অলরাউন্ডার নিজের ক্রিকেটার সত্ত্বাকেও ছাড়িয়ে গেছেন ধারাভাষ্যকার পরিচয়ে। ক্রিকেট বিশ্বে এই পরিচয়ে কমেন্ট্রি বক্সে বেশ জনপ্রিয়দের একজন আতহার। 

ক্রিকেট বিশ্বে এখন বেশ শক্তপোক্ত অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। তবে আজকের এই অবস্থানে আসার পেছনে যে কয়েকজন ক্রীড়াবিদের অবদান অনাস্বীকার্য, তাদের মধ্যে আতাহার অন্যতম। বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক এই ক্রিকেটার ও বর্তমান সময়ের দেশসেরা ধারাভাষ্যকার আজ ষাটের গণ্ডি পেরিয়ে ৬১ বছর বয়সে পা দিলেন। বাংলাদেশের এই ক্রিকেট কিংবদন্তি ১৯৬২ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন।

বিজ্ঞাপন

বাংলার ক্রিকেট ইতিহাসের উজ্জ্বল নক্ষত্র আতহার আশির দশকে ছিলেন দেশের ক্রিকেটের নিয়মিত মুখ। লম্বা গড়নের এই মানুষটি ওপেনিংয়ে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি করতেন মিডিয়াম পেস বোলিং। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে খেলা একটি অবিশ্বাস্য ইনিংসের জন্য সর্বপ্রথম আলোচনায় আসেন।

১৯৮৫ সালে তিন দিনের ওই ম্যাচে সতীর্থ তারিকুজ্জামান মুনিরকে নিয়ে ৪৪৭ রানের এক অবিস্মরণীয় জুটি গড়েছিলেন তিনি। মুনির দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম তিনশ রানের ইনিংস খেলার ম্যাচে ১৫৫ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস উপহার দিয়েছিলেন আতহার। এর পরপরই পূর্ণশক্তির শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বিসিবি (তৎকালীন বিসিসিবি) একাদশের হয়ে খেলার সুযোগ পান তিনি।

বিজ্ঞাপন

এরপর ১৯৮৮ সালের ২৭ অক্টোবর বাংলাদেশের হয়ে আতহারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল। চট্টগ্রামের এম.এ আজিজ স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে নিজের প্রথম ম্যাচে ব্যাট হাতে ১৬ রান করার সঙ্গে দুই ওভারের বোলিংয়ে উইকেটশূন্য ছিলেন তিনি। এক যুগের ক্যারিয়ারে লাল-সবুজের জার্সিতে ১৯টি ওয়ানডে খেলে তিন ফিফটিতে ২৯.৬০ গড়ে ৫৩২ রান করেছেন। পাশাপাশি বল হাতে শিকার করেছেন ৬টি উইকেট।

তবে অভিষেকের পর নিজের জাত চেনাতেও বেশি দিন সময় নেননি আতহার। ১৯৮৮ সালের এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে ১৬, পাকিস্তানের বিপক্ষে ২২ এবং শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ৩০ রান করে বাংলাদেশের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৯০ সালে কলকাতার ইডেন গার্ডেনে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তিনটি বিশাল ছক্কার সাহায্যে অপরাজিত ৭৮ রান করে ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার লাভ করেন তিনি। 

বাংলাদেশের হয়ে ১৯৮৬, ১৯৯৪ ও ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফিতেও প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন আতাহার। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক ওয়ানডে জয়ের ম্যাচে কেনিয়ার বিপক্ষে মোহাম্মদ রফিকের সাথে ১৩৭ রানের জুটি গড়েছিলেন তিনি। অলরাউন্ড পারফর্ম করা রফিকের হাতে ম্যাচসেরার পুরস্কার উঠলেও গুরুত্বপূর্ণ ৪৭ রান এসেছিল তার ব্যাট থেকে।

এরপর ঢাকায় ১৯৯৪ সালে সার্ক ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম ম্যাচে একাদশে সুযোগ হয়নি আতহারের। তবে দ্বিতীয় ম্যাচে সুযোগ পেয়েই দারুণ ইনিংস উপহার দেন তিনি। বর্তমানে বাংলাদেশ দলের কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের শ্রীলঙ্কা ‘এ’ দলকে হারানোর ম্যাচে ৫২ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। পরের ম্যাচে ভারত 'এ' দলকে ১ রানে হারানোর ম্যাচেও ২৬ রান করেন আতহার। তবে ফাইনালে একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে মাত্র ১০ রান করেন তিনি। 

আতহার তার ক্যারিয়ার সেরা ইনিংসটি খেলেন ১৯৯৭ এশিয়া কাপে। পাকিস্তানের বিপক্ষে ৮২ রানের দৃষ্টিনন্দন এই ইনিংসটি খেলার পাশাপাশি টুর্নামেন্টে ৩ ম্যাচে ৫২.৩৩ গড়ে ১৫৭ রান করে আসরে সেরা পাঁচ রান সংগ্রাহকের তালিকায়ও ছিলেন ডানহাতি এই ব্যাটার।  

বল হাতে সেরা ফিগার ছিল মোহালিতে ভারতের বিপক্ষে ৩৩ রানে ২ উইকেট। এ খেলায় তিনি ভারতের বর্তমান কোচ ও কিংবদন্তি ব্যাটার রাহুল দ্রাবিড়কে আউট করেছিলেন। ১৯৯৮ সালে মুম্বাইয়ে ভারতের বিপক্ষে তিনি ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলেন। 

১৯৯৭ এশিয়া কাপে অসাধারণ খেলেও বয়সের অজুহাত দেখিয়ে ১৯৯৯ বিশ্বকাপের স্কোয়াডে জায়গা হয়নি আতহারের। এতে হয়ত খুব অনুশোচনায় ভুগছিলেন তিনি। তবে দেশের হয়ে প্রথম বিশ্বকাপে খেলতে না পারা আতহারের ধারাভাষ্য কক্ষে আগমনটা বেশ রোমাঞ্চ ছড়িয়েছিল।

ওই বিশ্বকাপকে সামনে রেখে কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ দলকে ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড সফরে পাঠিয়েছিল বিসিবি। সফরে যুক্তরাজ্যের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের ক্যামেরাম্যান মার্ক ও’ডয়ারের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় আতহারের। ওই সম্পর্কটাই দুই বছর পর তার ধারাভাষ্য জীবনের ক্যারিয়ারে টার্নিং পয়েন্ট হয়ে দাঁড়ায়। 

বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টের আগের দিন হোটেল শেরাটনে ক্রিকেটারদের শুভকামনা জানাতে যান আতহার। তবে সেখানে গিয়ে আকস্মিকভাবে দেখা হয়ে যায় ওই মার্ক ও’ডয়ারের সঙ্গে। ভারতের বিপক্ষে সেই সিরিজের প্রডিউসার হিসেবে কাজ করতে বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি।

কথার এক পর্যায়ে ধারাভাষ্যে নিজের নাম লেখানোর ইচ্ছের কথা মার্ক ও’ডয়ারের সঙ্গে শেয়ার করেন আতহার। যেই বলা সেই কাজ, পরদিন ইয়ান চ্যাপেল, মাইকেল হোল্ডিং, সুনীল গাভাস্কার, টনি গ্রেগদের মতো রথী-মহারথীদের পাশে বসে ধারাভাষ্যে অভিষেক হয় এই কিংবদন্তির। 

এ প্রসঙ্গে আতহার পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ওরা আমাকে দুই দফায় আধঘণ্টা করে মোট এক ঘণ্টা কমেন্ট্রি করার সুযোগ দিয়েছিল। তো প্রথমবার মাইক্রোফোন হাতে নিয়েই দেখলাম আমার সঙ্গী কমেন্টেটর ইয়ান চ্যাপেল। প্রথম কয়েক মিনিট তো মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হচ্ছিল না!’ 

বাংলার ক্রিকেটপ্রেমী জনতা ভালোমতোই জানে ধারাভাষ্যকার হিসেবে নিবেদিত এই প্রাণ একজন নির্ভীক যোদ্ধা। তাই প্রথম দিন কথা বলতে না পারা সেই আতহার আলী খানই বিশ বছর পরে বিশ্ব ক্রিকেটে ‘দ্য ভয়েস অব বাংলাদেশ ক্রিকেট’ হয়ে উঠেছেন।

একটা সময় সবাই যখন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতো, খোঁচা দিত, তিনি ধৈর্য নিয়ে সেসব গ্রহণ করতেন। এরপর সময় বুঝে ঠিক তার উত্তর দিতেন। ২০০৩ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে ঐতিহাসিক মুলতান টেস্টে অলক কাপালির একটি বিতর্কিত ক্যাচ আউট নিয়ে ধারাভাষ্য কক্ষে প্রতিবাদ করে প্রশংসা কুড়ান আতাহার। 

আতহার আলী খান বাংলাদেশ দলকে ভালোবেসে, বাংলাদেশ দলের প্রতি বিশ্বাসকে পুঁজি করে দেশে-বিদেশে, এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে ছুটে বেড়িয়েছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশি এই ধারাভাষ্যকারের মাইক্রোফোনে পৃথিবীর নানা প্রান্তে বাংলার বিজয়ের ঘোষণা তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে।

তার শব্দভাণ্ডার থেকেই সর্বপ্রথম ‘বাংলাওয়াশ’ প্রতিধ্বনি উচ্চারিত হয়েছিল। যা এখন দেশের ক্রিকেটে একপ্রকার ট্রেন্ডে পরিনত হয়েছে।  দেশের ক্রীড়াঙ্গনে ধারাভাষ্যের যে অনাবিষ্কৃত পথ তিনি আবিষ্কার করেছেন, যে পথ ধরে অনাগত ভবিষ্যতে হয়তো হাঁটবে অনেক পথিক। তখন অনেকেই হয়ত  বলবে, ওই দেখো বলিষ্ঠ কণ্ঠযোদ্ধা আতহারের লাল-সবুজের প্রতিনিধি।

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |