দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে টিআইবির যত ভুল তথ্য
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ‘২৪১ আসনে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি’সহ বেশকিছু বিতর্কিত মন্তব্য করা হয়েছে ওই প্রতিবদেনে। টিআইবির ওই প্রতিবেদন নিয়ে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়াতেই এই প্রতিবেদন। বিজ্ঞানসম্মত ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ না করে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছে টিআইবি। টিআইবি গবেষণা পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
গত ১৭ জানুয়ারি নিজস্ব কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি দাবি করে, একপাক্ষিক ও পাতানো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনও অন্তত ৫১ শতাংশ আসনে জাল ভোট, প্রকাশ্যে সিল মারা ও বুথ দখলের ঘটনা ঘটেছে।
তবে ৩০০ আসনের মধ্য ৫০টি আসনে কীসের ভিত্তিতে তারা গবেষণা করেছে তা উল্লেখ করা হয়নি। কাদের কাছ থেকে তারা তথ্য সংগ্রহ করেছে তাও উল্লেখ করেনি। এ প্রসঙ্গে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেন, ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪২ হাজার ৩৫০টি কেন্দ্রে ভোট হয়েছে। পোলিং বুথ ছিল ২ লাখ ৬১ হাজার ৫৬৫টি। টিআইবি কতগুলো বুথের তথ্য সংগ্রহ করেছে, তা উল্লেখ না করে প্রতিবেদনের উপংহারে পৌঁছে বলেছে ৫১ শতাংশ আসনে পোলিং বুথে প্রকাশ্যে ভোট দেওয়া হয়েছে। গায়েবিভাবে তারা এই তথ্য উপস্থাপন করেছে।’
তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘যাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে তারা মূলত অংশীজন। তারা তথ্য নয়, মতামত দিয়েছে। তথ্য এবং মতামতের মধ্যে পার্থক্য আছে। তারা মতামতকে তথ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে।’
টিআইবি গবেষণা পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, টিআইবি পরিমাণগত ফলাফল সহ তার রিপোর্ট দিয়েছে। যদিও মেথডলজি সেকশন (সেকশন ৩, পৃষ্ঠা ৩) থেকে দেখা যাচ্ছে যে তারা তাদের সিদ্ধান্তে আসার জন্য গুণগত এবং পরিমাণগত উভয় ডেটা ব্যবহার করেছে। তারা কীভাবে পরিমাণগত ফলাফলে এসেছে তার কোনও প্রক্রিয়া উল্লেখ নেই।
পয়েন্ট-২ : টিআেইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, তারা ৩০০টির মধ্যে ৫০টি নির্বাচনী এলাকার তথ্য নিয়েছে। কিন্তু তারা কতগুলি ভোট কেন্দ্রের তথ্য নিয়েছে তার উল্লেখ নেই। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ৪২ হাজার ৩৫০টি ভোটকেন্দ্র ছিল। তাদের পদ্ধতি কীভাবে কার্যকর ধরা যায়, যখন তারা কতগুলি ভোট কেন্দ্রের তথ্য নিয়েছে, সেই সংখ্যাটিই প্রকাশ করেনি? তাদের ছিল মাত্র ৩ জন গবেষক এবং ৪ জন গবেষণা সহকারী। এত অল্প সময়ে এত ছোট টিম দিয়ে নির্বাচনের পুরো মেকানিজম জরিপ তারা কীভাবে করতে পারলেন?
পয়েন্ট-৩ : কেউ যদি সেকশন ৫ (পৃষ্ঠা ৫, ৬) পড়ে, তবে এটি স্পষ্ট হবে যে, প্রতিবেদনটি রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট। এতে বিএনপির ঐতিহাসিক অনিয়ম ও সাম্প্রতিক সহিংসতার কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। বরং আওয়ামী লীগকে এমন একটি দল হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে, যারা ক্ষমতা দখলের জন্য যা ইচ্ছা তাই করে।
টিআইবি প্রতিবেদনে বলেছে, অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি নির্বাচন কমিশন। অথচ ৩০০টি সংসদীয় আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আশায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছ থেকে মোট ২ হাজার ৭১৬টি মনোনয়নপত্র নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠানো হয়। তবে যাচাই-বাছাই শেষে ৭৩১ প্রার্থী বা মোট ২৭ শতাংশ প্রার্থীকে বাতিল করেছে ইসি। দ্বৈত নাগরিকত্বের দায়ে আওয়ামী লীগ নেতা শাম্মী আহমেদের (বরিশাল-৪ আসনে) প্রার্থিতা বাতিল করেছে ইসি।
মাত্র ৫০টি নির্বাচনী আসন সম্পর্কে অস্পষ্ট পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করে টিআইবি রায় দিয়েছে। তারা বলেছে- আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা সবাই নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছে। কিন্তু রিপোর্টে সুনির্দিষ্ট কোনো ঘটনা বা তথ্য দিতে পারেনি সংস্থাটি।
নির্বাচনী প্রচারণা, আচরণবিধি পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য ইসি ৭৬২ বার শোকজ করেছে, যার মধ্যে ৩০০ বার ছিল আওয়ামী লীগের শতাধিক সংসদ সদস্যকে। এছাড়াও প্রার্থী বা তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে ৬৩টি মামলা হয়েছে।
নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ ঠেকাতে পুলিশ-প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা, বিরোধী দলগুলোর পোলিং এজেন্টদেরকে ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেয়া, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের পক্ষপাত, সাংবাদিকদেরকে তথ্য সংগ্রহে বাধাদান, জাল ভোটদান ইত্যাদি অভিযোগ তুলেছে টিআইবি। এক্ষেত্রেও সংস্থাটির মাপকাঠি মাত্র ৫০টি নির্বাচনী আসন। সেগুলোর কতগুলো ভোটকেন্দ্রে তারা পর্যবেক্ষণ চালিয়েছে, তার উল্লেখ নেই। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।
ইসির তথ্য অনুযায়ী, ১৪০টি কেন্দ্র থেকে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অন্তত ৯টি নির্বাচনী এলাকার ২১টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। অনিয়মের অভিযোগে ৪২ জনকে আটক করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীকে (চট্টগ্রাম-১৬) অযোগ্য ঘোষণা করে ইসি। এটি দেশের নির্বাচনের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। নরসিংদী-৪ আসনে জাল ভোট অভিযোগে শিল্পমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুনের ছেলেকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয় ইসি। একটি ভোট কেন্দ্র স্থগিত থাকায় ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনের ফলাফলও স্থগিত করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।
২৭ শতাংশ থেকে ৪১ শতাংশ ভোটার টার্নআউট নিয়ে বিতর্ক বিভ্রান্তকর তথ্য দিয়েছে টিআইবি। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন কমিশন প্রায় প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর হালনাগাদ তথ্য পেয়েছে। এর মানে হল যে ২৭ শতাংশ ভোটারের তথ্য, যা বিকাল ৩ টায় বলা হয়েছে, তা কমপক্ষে দুই ঘন্টা পুরানো ছিল। অতএব, ৪১ শতাংশ ভোট পড়ার বিকাল ৪টায় আপডেট হওয়া তথ্যের সঙ্গে আগের তথ্যের তিন ঘন্টার ব্যবধান ছিল। নির্বাচনের দিন সকালে অতিরিক্ত ঠান্ডা পড়েছিল। পঞ্চগড়ে তাপমাত্রা ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমেছিল। ভোটারদের একটি বড় অংশ তাদের ভোট দেওয়ার জন্য দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল, যার আপডেট ওইদিনে দেরিতেই গণনা করা হয়েছিল।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র হেভিওয়েট প্রার্থীদের পরাজয় কিভাবে হলো প্রশ্ন তুলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুভাষ সিংহ রায়। তিনি বলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে বলেই- ঢাকা-১৯ সাবেক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান, যশোর-৫ আসনে স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী ও দুইবারের সংসদ সদস্য স্বপন ভট্টাচার্য, হবিগঞ্জ-৪ আসনে বেসামরিক বিমান চলাচল প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী, গাজীপুর-৫ আসন মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি, কিশোরগঞ্জ-২ আসনে পুলিশের সাবেক ডিআইজি আবদুল কাহার আকন্দ, মাদারীপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রভাবশালী সদস্য আবদুস সোবহান, সুনামগঞ্জ-২ আসনে বর্তমান পুলিশ মহাপরিদর্শকের ছোট ভাই চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মাহমুদ কুষ্টিয়া-২ আসনে সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, পিরোজপুর-২ আসনে সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু হেরে গেছেন।
মন্তব্য করুন