• ঢাকা মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৭ মাঘ ১৪৩১
logo
কর্মহীনতায় বাড়ছে দারিদ্রতা
মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাংলাদেশের অগ্রগতি যৎসামান্য
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী খাদিজাতুল কুবরা একসময় মুক্ত সংলাপ এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতায় গড়ে ওঠা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয় তখন যখন একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রবাসী সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে তার অনলাইন সাক্ষাৎকার বাংলাদেশ সরকারকে ক্ষেপিয়ে তোলে। প্রশাসনের সমালোচনা করার জন্য কুবরাকে কঠোর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় কারাগারে পাঠানো হয়। প্রায় ১৬ মাস ধরে তার শিক্ষাজীবন বিপর্যস্ত হয়, তার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়, এবং তার কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যায়। কুবরার এই ভোগান্তি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তিনি হলেন এক হাজারেরও বেশি নাগরিক, সাংবাদিক এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে একজন, যারা শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং সাইবার নিরাপত্তা আইনের মতো দমনমূলক আইনগুলোর শিকার হয়েছেন। এই আইনগুলো মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে শ্বাসরোধ করেছে এবং ভয়ের একটি পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, যা আসলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভিত্তিকে দুর্বল করেছে। জুলাই মাসের অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের নাগরিকরা হারিয়ে যাওয়া মত প্রকাশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছিলেন, অন্যদিকে ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী  সরকার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং মানবাধিকারের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। তবে, সাম্প্রতিককালে অ্যাডভাইজরি পরিষদ কর্তৃক সাইবার নিরাপত্তা অধ্যাদেশ এর অনুমোদিত খসড়া গুরুতর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এই খসড়া কেবল পূর্ববর্তী প্রশাসনগুলোর দমনমূলক আইন কাঠামোগুলো প্রতিফলিত করে না বরং একটি আরো উন্মুক্ত এবং গণতান্ত্রিক সমাজের দিকে এগিয়ে যাওয়া অগ্রগতিকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। অধ্যাদেশটি সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সম্পৃক্ততা এবং পর্যাপ্ত জনমত ছাড়াই অনুমোদিত হয়েছিল। আইন প্রণয়নের এই পদ্ধতি শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের স্বৈরাচারী আচরণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এমন একটি অন্তর্বর্তী সরকার থেকে স্বচ্ছতার অভাব খুবই উদ্বেগজনক, যারা অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও একটি উদ্বেগ যেখানে খসড়ার অফিসিয়াল অনুমোদন ও প্রকাশের আগেই তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সম্মানিত উপদেষ্টার সহকারী বিশেষ উপদেষ্টা তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়ায় অধ্যাদেশের বিতর্কিত বিধান শেয়ার করেছেন। এইভাবে অফিসিয়াল প্রকাশনার চ্যানেলগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে এবং এটি অংশীদারদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। এই ধরনের অপেশাদার আচরণ জবাবদিহিতা দাবি করে এবং সরকারের স্বচ্ছতার প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে। কয়েকটি ছোটখাটো পরিবর্তন এবং কম শাস্তির ধারা ছাড়া খসড়া সাইবার নিরাপত্তা অধ্যাদেশটি বাতিল হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থেকে সামান্য পার্থক্য নির্দেশ করে। উদ্বেগজনকভাবে, ধারা ৮ এর উপধারা ১ এবং ২ এর মাধ্যমে জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা সংস্থার মহাপরিচালককে যে কোনো তথ্য অপসারণ বা ব্লক করার একতরফা ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে, যা জাতীয় সংহতি, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি বলে বিবেচিত হয়। এই কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা বৈষম্যমূলক চর্চা এবং ভিন্নমত দমনে কর্তৃপক্ষের অপব্যবহারের একটি উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি তৈরি করে। তদুপরি, অধ্যাদেশে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সরকারি কর্মকর্তারা এখন জাতীয় সংহতি এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ নির্ধারণ এবং বিচার করবেন। এটি কার্যত পূর্ববর্তী শাসনগুলোর দমনমূলক আইন কাঠামোগুলোর প্রতিফলন ঘটায়, যা নাগরিকদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে সামান্য অর্থবহ পরিবর্তন প্রস্তাব করে। খসড়ার অধীনে জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা পরিষদে সরকারি মন্ত্রী, আমলা এবং আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের প্রাধান্য রয়ে গেছে। পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তারের বিধান এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনের অধীনে নিষ্পন্ন না হওয়া মামলাগুলোর অব্যাহত পরিচালনা পূর্ববর্তী আইনগুলোর দমনমূলক প্রকৃতিকে আরো চিরস্থায়ী করে। খসড়ায় গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞাগুলো স্পষ্টভাবে অনুপস্থিত, যা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ব্যাখ্যার দাবি রাখে। উদাহরণস্বরূপ, অধ্যাদেশটি সাইবার অপরাধের ধরন, অনলাইন যৌন হয়রানি, সাইবার বুলিং, অনলাইন গ্রুমিং এবং ব্যক্তিগত ডেটা স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করতে ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়া, পরিষেবা প্রদানকারীদের দায়মুক্তি, বিশেষজ্ঞদের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড এবং একটি বিস্তৃত সাইবার নিরাপত্তা কাঠামোর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অনুপস্থিত। এই অস্পষ্টতা নির্বিচার প্রয়োগ এবং আইনি অনিশ্চয়তার দিকে পরিচালিত করতে পারে। অধ্যাদেশের প্রণেতারা তিনটি ভিন্ন ক্ষেত্রকে একত্রিত করেছেন: সাইবার নিরাপত্তা, সাইবার অপরাধ, এবং বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণ (কনটেন্ট মডারেশন) । এগুলোর সংমিশ্রণ একটি বিভ্রান্তিকর এবং মিসলিডিং খসড়া তৈরি করেছে, যা সামঞ্জস্যহীন এবং প্রতিটি ডোমেইনের নির্দিষ্ট প্রয়োজনগুলোর সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে যা বৈধ অনলাইন কার্যকলাপকে সম্ভবত বাধাগ্রস্ত করতে পারে। খসড়া অধ্যাদেশটি সাম্প্রতিক গ্লোবাল ডেভেলপমেন্টের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এটি ২২শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ভবিষ্যৎ শীর্ষ সম্মেলনে ঘোষিত গ্লোবাল ডিজিটাল কমপ্যাক্ট (জিডিসি) এবং গত বছর ২৪শে ডিসেম্বর সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত জাতিসংঘের সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে কনভেনশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোগুলিকে উপেক্ষা করে। এই গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক মানগুলো উপেক্ষা করে, অধ্যাদেশটি বাংলাদেশের বৈশ্বিক ডিজিটাল সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি করে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি ক্ষুণ্ণ করে। অস্থায়ী সরকারের কাছে বাংলাদেশকে একটি আরও গণতান্ত্রিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যতের দিকে পরিচালিত করার একটি অনন্য সুযোগ রয়েছে। তবে, সাইবার নিরাপত্তা অধ্যাদেশের বর্তমান খসড়াটি অতীতের দমনমূলক অনুশীলনগুলোকে স্থায়ী করার মাধ্যমে এই সম্ভাবনাকে নষ্ট করার ঝুঁকি তৈরি করে। স্বচ্ছ, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং জবাবদিহিতামূলক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সরকার বাংলাদেশের জনগণের জন্য এত কঠিন লড়াই করে আসা গণতান্ত্রিক আদর্শগুলোকে বজায় রাখতে পারে। এর চেয়ে কম কিছু হলে তা তাদের ত্যাগের বিশ্বাসঘাতকতা এবং জাতির গণতান্ত্রিক অগ্রগতির জন্য একটি পশ্চাদপদ বলে হবে।  লেখক: শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী (দ্য ডিপ্লোমেট থেকে বাংলা করা) আরটিভি/কেএইচ
ইলিয়াসের পডকাস্টে মেজর ডালিম: প্রশ্নবিদ্ধ তথ্য ও বিতর্ক
 কেমন চাই গণমাধ্যমের সংস্কার
অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ ‘চরমপন্থা রোধ’
মানুষকে মশা-মাছি ভেবে মাড়িয়ে যেতে চায় ভারত?
একাত্তরের ডিসেম্বর ও বড়দিনের স্মৃতি 
ডিসেম্বর মাস এলেই মাথায় ভর করে বছরের শেষ সময়ের যত হিসাব। সারা বছরে করা ভালো কাজ গুলো পাশে রেখে ভুল গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্লেষন করি। নিজেই নিজেকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় কিয়ে নিজেই বিচারকের ভূমিকা পালন করি। কারণ খুঁজি বিগত দিনে কেন ভুল হয়েছে। সেসাথে আগামীতে ভুল না যেন হয় সে বিষয় পরিকল্পনা করি। কাজ গুলো যখন করি তখনই মনে পড়ে একাত্তরের স্মৃতি কথা। বিশেষভাবে ডিসেম্বর মাস ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। ডিসেম্বর মাস আমরা ছিলাম বাড়ি ছাড়া। যুদ্ধ ভয়াবহতার কারণে জীবন বাচাতে রিফিউজি হয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছি। যুদ্ধ তখন তুঙ্গে। রেডিওতে প্রতি সন্ধ্যায় বড়দের সাথে আশ্রয় নেয়া বাড়ির আঙ্গিনায় পাটি বিছিয়ে সেখানে বসে রেডিওতে যুদ্ধ পরিস্থিতি শুনি। নিজের চোখেও কয়েকবার বোম্বিং এর দৃশ্য দেখেছি। যেকারণে আতংকে দিন কাটে। শুধু তাই নয়, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে সারাদিন বড়দের ভাবতে দেখি। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির পূর্ব দিকের ঢালুতে বসে রোদ পোহাচ্ছিলাম। এমন সময় মাথার উপর দিয়ে কালছা সবুজ রঙের একটা হেলিকপ্টার উড়ে যায়। দৌড়ে বাড়ি এসে বললাম হেলিকপ্টার উড়ে যাবার কথা। ভেবেছিলাম এটা পাকিস্তানের কোনো হেলিকপ্টার হবে হয়তো, তাই। বাড়ি এসে বললে পর বড়রা বললেন, এটা ভারতের হেলিকপ্টার। সামনে হয়তো ভালো কোনো সংবাদ অপেক্ষা করছে। তাদের কথায় সেদিন আমরা উল্লসিত হয়েছিলাম। এর কিছুদিন পর বাড়ির এক জ্যাঠাতো ভাই সিপ্রিয়ান তার এক সঙ্গীকে নিয়ে আমরা কেমন আছি জানার জন্য আমাদের খোঁজ নিতে আশ্রিত বাড়িতে দেখা করতে এলেন। ষনেক রাত পর্যন্ত বাড়ির বাইরে বিলের ধারে বসে ভাই সিপ্রিয়ানের সাথে গল্প করেছি। বিভিন্ন এলাকায় তাদের যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা বলেন। তারাই প্রথম জানায়, কয়েকদিনের মধ্যেই দেশ স্বাধীন হবার কথা। আমরা যে আবার নিজ বাড়িতে ফিরে যেতে পারবো, সে নিশ্চয়তা দিয়ে বলেন, বেশীদিন আর এখানে এভাবে কষ্ট করতে হবে না। বড়দিন যে বাড়িতে করা হবে সেই কথাও বলে বিদায় নেন। দেশের ভিতর পাকিস্তানি সেনাদের সাথে বাঙালি রাজাকারেরা মিলে যখন তান্ডব শুরু করে অর্থাৎ যুদ্ধ পুরো দৃশ্যমান তখন আমরা বাধ্য হয়ে জীবন রক্ষার্থে বাড়ী ছেড়ে উত্তর দিকে কৌচান এলাকায় আশ্রয় নেই। সেখেনে আমাদের দিনগুলো কষ্টের মধ্যেও যেমন ছিল আনন্দের তেমনই ভয়ের। সারাক্ষণ আমাদের অদৃশ্য এক ভয়ে দিন কেটেছে। পুরো ডিসেম্বর মাসের প্রতিটি দিনের কথা আমার এখনও মনে আছে। আমার স্মৃতি যদি বিট্রে না করে থাকে তাহলে বলতে পারি, ডিসেম্বর মাসের ১৫ তারিখ রাতে রেডিওর সংবাদ শুনে আনন্দে বাড়ির সকলকে লাফাতে দেখেছিরেডিওতে পাকিস্তানি সৈনিকদের পরাজয়ের কথা বলা হয়। বলা হয় আত্মসমর্পণ করার কথা। একথা শোনার পর সবার মাঝে যে প্রতিক্রিয়া দেখেছি এখনে যেন আমার চোখে তা স্পষ্ট। সেদিন আমাদের ঘুম যেন আসছিল না। তবুও ঘুমিয়েছি। পরেরদিন খুব সকালে সবার ঘুম ভেঙ্গে গেলে বাড়ি ফেরার আনন্দসবাই নিজেদের কাপড় লতা গোছাতে শুরু করে। কেউ কেউ আটা রুটি চা বানিয়ে খেতে দেয়। আনন্দ উত্তেজনা তখন এতোটাই ছিলো যে কেউ আর খেতে পারছিল না। তারপরেও না খেলে সমস্যা হবে মনে করে খেয়ে নেয়। এরপর সকাল দশটার দিকে বাড়ির কর্তা হিসাবে বাবা বিলের ধারে দাঁড়িয়ে আশেপাশে অন্য বাড়িতে থাকা বাড়ির অন্য পরিবারের লোকদের ডাকাডাকি করে জড়ো করলেন।সবাই জড়ো হলে একসাথে রওনা হয় বাড়ির উদ্দেশ্যে। সবার মাথায় নিজেদের কাপড় লতা, হাড়ি পাতিল, কাথা কম্বল বাধা বোঝা। বাড়ি পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে যায়কাছাকাছি যাবার পর দূর থেকে ভিটা বাড়ি দেখা গেলেও ভিটা ছিল ঘর শূন্য। সব পুড়ে ছাই। বাড়ির ভিটায় পা রেখে বাবা মা খুব কান্না কাটি করলেন। কিছুসময় পর পোড়া ঘরের ছাই সরিয়ে ধর্মীয় মূর্তি, কাপ পিরিচ পেয়ে সেসব আলাদা করে রাখা হয়। আমি আর ছোট বোন খেলার সামগ্রী খুঁজছিলাম। ছাইয়ের আড়ালে থাকা ভাঙা কসচের টুকরা দিয়ে পা কেটে যেতে পারে মনে করে বাবা আমাদের বিরত করলেন। সেদিন ঘরের পোড়া টিন কোনোভাবে একটার সাথে আরেকটা আড়াআড়ি দাঁড় করিয়ে সেখানেই রাত কাটাই। পরের দিন বাঁশ বাগান থেকে বাঁশ কেটে এনে পোড়া টিন দিয়ে ছাপড়া ঘড় বানানো হয়। তার নিচে ঢালাও বিছানা করে রাত যাপন করতে শুরু করি। বিছানা করা হয় খের (ধান গাছ) দিয়ে। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরর আগের দিন গুলো ছিলো এক রকম ভয় আর আতঙ্কের। পরবর্তী দিন গুলো ছিল আনন্দ আর সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার প্রত্য় নিয়ে। বয়সের কারণে সব মনে না থাকলেও যেটুকুই মনে আছে সবটাই এখনও স্পষ্ট। কিছু দিন পরেই ২৫ শে ডিসেম্বর বড়দিন। ভালো কাপড় লতা বলতে কিছু নেই। যা কিছু ছিল সবটাই মানুষের দেয়া। তখনও কোনো রিলিফ পাইনি। কষ্টে আমাদের দিন কাটে। মা তার বাবার বাড়ি বোনের বাড়ি থেকে চেয়ে চেয়ে শীতের কাপড়, কাথা কম্বল, বালিশ নিয়ে আসে। সেসময় মাকে মামার বাড়ি, মাসির বাড়ি গিয়ে মুখ ছোট করে অসহায়ের মতো সাহায্য চাওয়ার দৃশ্য এখনও ভুলতে পারি না। এ যে ভোলার নয়। মামা মাসির ছেলে মেয়েদের মধ্যে কয়েকজন আমার বয়সীও আছে। তাদের কাপড়ও নিয়ে ব্যবহার করেছি। তাদের কাছ থেকে কাপড়, বালিশ আর খেলার পুতুল পেয়ে কি যে খুশি হয়েছিলাম তা মনে করলে এখনও ভিতর লাফায়। বালিশ আর পুতুল নিয়ে ছোট বোনের সাথে ঝগড়াও হতো মাঝে মধ্যে। দেখতে দেখতে বড়দিন চলে এলো। মামার বাড়ি থেকে আনা আমার জন্য শার্ট প্যান্ট ধুয়ে শোকানো হলো। সেগুলো খুব যত্ন করে ভাজ করে বালিশের নীচে রেখে দিলাম আয়রনের মতো ভাজ হবার জন্য। বড়দিনের দিন সকালে সেই শার্ট প্যান্ট পড়ে গির্জায় যাই বড়দিনের মিশায় অংশ নিতে। তখন বড়দিনের অর্থ বা তাৎপর্য বুঝি না। তবে ঘটনা সবই এখনও মনে আছে। লেখক : জাপান প্রবাসী সাংবাদিক   আরটিভি/ ডিসিএনই
হকার মাইকিংয়ে অতিষ্ঠ রাজধানীবাসী, মুক্তি মিলবে কি
বাংলাদেশের সবচেয়ে জনবহুল শহর রাজধানী ঢাকা। যে শহরে বসবাস করে প্রায় ২ কোটি মানুষ। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের এ শহরে কেউ করেন চাকরি, কেউ পড়ালেখা, কেউ আবার ব্যবসা। প্রকৃত অর্থে থেমে নেই কেউ। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই চলমান এ শহরকে ‘অদ্ভুত শহর’ নামেও আখ্যা দেন অনেকে। মূলত, এ শহরে বসবাসকারীদের মধ্যে তিন শ্রেণির মানুষের সংখ্যা বেশি। এর মধ্যে—উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত। যদিও প্রত্যেকেই ব্যস্ত থাকেন আপন কর্মে। জীবিকার তাগিদে সকাল থেকে রাত অব্দি ছুঁটে চলেন এ মানুষগুলো। প্রত্যেকেরই রয়েছে ভিন্ন রকমের কর্ম। আজ কথা বলতে চাই ‘ইদুর মারেন’, ‘তেলাপোকা মারেন’, ‘মাজায় ব্যথা, হাঁটুতে ব্যথা’ প্রভৃতি পেশা নিয়ে।   সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আপনি যেখানেই থাকেন না কেন, কোনো-না কোনো সময় মনের অজান্তে হলেও এ শব্দগুলো আপনার কানে আসবেই। সেটি আপনি অফিসে বসেই হোক আর বাসায় শুয়ে থেকে হোক, শুনবেনই। শোনতে আপনি বাধ্য। কোনো রেহাই নেই আমাদের। তীব্র যানজটের এ শহরে বাসে বসে থাকেন বা পার্কে হাঁটেন কথা একটাই—‘ইদুর মারেন, তেলাপোকা মারেন’, ‘মাজায় ব্যথা, হাঁটুতে ব্যথা’ ইত্যাদি। এ যেন আমাদের পিছু ছাড়ছে না। কিছুতেই না! আচ্ছা একটু মনে করে দেখুন তো, আপনি কারও সাথে একান্ত নীরবে মোবাইলে কথা বলছেন, আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইভ করছেন বা কোনো কন্টেন্ট তৈরি করছেন। এমন সময় আপনার প্রয়োজন হবে একটা নিরিবিলি পরিবেশ। কিন্তু আপনার কাজ শুরু করার পরই হঠাৎ বাতাসে একটি শব্দ ভেসে আসলো- ‘ইঁদুর মারেন, তেলাপোকা মারেন’ বা ‘কাগো...জ, পেয়া...জ, ছা...ই’ ইত্যাদি। ঠিক সে সময় আপনার অনুভূতিটা কেমন হবে? রাজধানী ঢাকা, যেখানে- পরিবেশ দূষণ, বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণসহ এমন কোনো দূষণ নেই যা আপনি পাবেন না! মূলত, প্রয়োজনের তাগিদে শত দূষণ সহ্য করেও ঠিকে থাকতে হচ্ছে আমাদের। ফেরার পথ বন্ধ অনেকের। তাই ইচ্ছে না থাকা সত্যেও ইটপাথরের এ শহরে নিজেকে মানিয়ে নিতে হচ্ছে। আজ যাদের নিয়ে কথা বলছি- তারা মূলত, নিম্নভিত্ত বা নিম্ন আয়ের মানুষ। সহজ ভাষায় যাদের ‘হকার’ বলা হয়। যদিও হকারদের মাঝে রয়েছে বিভিন্ন শেণিবিন্যাস। রাজধানীর ফুটপাতে যারা ব্যবসা করেন তাদেরকেও হকার বলা হয়। এ ছাড়াও বিভিন্ন রকমের হকার রয়েছে। কিছুদিন পূর্বে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান বলেছিলেন, রাজধানীতে সকল প্রকার যানবাহনের হর্ন বাজানো বন্ধ করবেন। মূলত, শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্যই এ উদ্যোগের কথা জানিয়েছিলেন তিনি। যদিও তার সে উদ্যোগ বাস্তবায়নের কোনো পদক্ষেপ পরবর্তীতে আর চোখে পড়েনি। রাজধানীতে শব্দ দূষণের যে কয়েকটি বিশেষ কারণ রয়েছে, তার মধ্যে ‘হকার মাইকিং’ অন্যতম। শহরের বিভিন্ন স্থানে, অলিতে-গলিতে হ্যান্ডমাইক বা ভ্যানে স্থাপিত মাইকে পণ্যের প্রচারাণা চালিয়ে ব্যপক শব্দ দূষণ করা হচ্ছে। যদিও এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে দেখা যায় না পরিবেশবিদদের। তবে, অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে ‘হকার মাইকিং’ খুবই বিরক্তিকর। দেশের দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে সরকারের যারা দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের উচিত হবে রাজধানীর কোটি কোটি মানুষের বিরক্তি ও সুস্থতার কথা বিবেচনায় ‘হকার মাইকিং’ বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ কর। তবে, অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে- কোনো অবস্থাতেই যেন হকারদের ব্যবসা বন্ধ বা তাদের আয়-রুজিতে কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়। লেখক: সাংবাদিক আরটিভি/ ডিসিএনই
ভারতীয় গণমাধ্যমের ‘আকাশ-কুসুম’ অপপ্রচার
ঘোড়া উড়ে গেছে আকাশে, কুকুর ও ছাগল মানুষের মতই কথা বলছে কিংবা দৈত্য গিলে নিয়েছে আস্ত মানুষ - উক্তিগুলি যে রূপকথার গল্পের অংশ  তা শনাক্ত করতে হয়ত খুব বেশি সময় লাগবে না আপনাদের। তবে সেই একই রকম কথা যদি ভারতীয় মূলধারার গণমাধ্যমগুলো বলে তবে কি অবাক হবেন খুব বেশি?  না, অবাক হওয়ার কিছু নেই। ভারতের সাংবাদিকতা বিশ্বব্যাপি আগে থেকেই যথেষ্ট সমালোচিত এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা কারণে হাস্যরসের খোরাক। কখনো দেখা গেছে সাংবাদিক কথা বলছেন রাজনৈতিক দলে কর্মী হয়ে, কখনো বা সংবাদ উপস্থাপনকে বানিয়ে ফেলেছেন টিভিসি বা সিরিয়াল নাটকের অংশ, কখনো আবার উপস্থাপক নিজেই  হয়ে যাচ্ছেন আলোচক, আবার আবেগে ঢলে পড়ছেন এদিক ওদিক। এ ধরণের কোন ধরণের আচরণই আন্তর্জাতিক সাংবাদিকতায় গ্রহণযোগ্য নয়, কিন্তু ভারত এদিক থেকে অনড়। আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার ধার ধারে না দেশটির গণমাধ্যমগুলো, যত যাই হউক তারা রূপকথার গল্পের ভিত্তিতেই করে যাবেন নিউজ রিপোর্ট। ইদানিং ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যেসব সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে তা সত্যিই অনবদ্য। প্রফেশনাল ফেরি টেলস রাইটার ছাড়া   এ ধরনের গল্প লেখা সত্যিই অসম্ভব প্রায়। হয়ত মানের দিক থেকে তারা গুছিঁয়ে আনতে পারছেন না পুরো গল্প বা রিপোর্টটি, তবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন আপ্রাণ।  কিন্তু লক্ষ্যে অনেকটাই সফল দেশটির পোর্টালগুলো। ইতোমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় সংবাদের নামে রূপকথার গল্প প্রচার করে পাচ্ছেন হাজার হাজার ‘হা হা রিয়্যাক্ট’। অর্থাৎ মূলধারার গণমাধ্যম হলেও তারা যে মানুষ হাসাতে কোন অংশেই পিছিয়ে নেই তা বেশ পরিষ্কার। এসব সংবাদ পরিবেশনের ভিত্তিতে অনেক গবেষক বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে- ভারত, বিদ্বেষ বা ঘৃণা থেকে নয় বরং ভয় থেকেই করছে এ ধরনের প্রতিবেদন। কারণ দেশটির সাথে নানা কারণে প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্পর্ক ভালো নয়। তার উপর আওয়ামী সরকার পতনের পর থেকে বাংলাদেশও খুব বেশি পরোয়া করছে না তাদের। যেটি ভারতের জন্য একটি ভীতির কারণ। তবে ভীতি থাকলেও নানা কারণে তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সরাসরি কিছু করবে না। ফলে গণমাধ্যমগুলো এ ধরনের প্রচারণার মধ্য দিয়েই বহি:প্রকাশ করছে তাদের ভয়ের। যদিও ভারতীয় সাংবাদিকতা দীর্ঘদিন ধরে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। তবে, সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতীয় সাংবাদিকতার প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বাড়ছে। এর পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে, যা প্রমাণ ও উদাহরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। সাংবাদিকদের স্বাধীনতা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি। তবে, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের (RSF) ২০২৩ সালের প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ভারত ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬১তম স্থানে রয়েছে। এই অবনমন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। সাংবাদিকদের হুমকি, গ্রেপ্তার এবং আইনগত চাপের ঘটনা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যা স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে তারা পক্ষপাতভিত্তিক সাংবাদিকতার বাইরে চাইলেও যেতে পারে না। বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, ভারতীয় সাংবাদিকতা ধীরে ধীরে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। বিবিসি এবং আলজাজিরার মতো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর রিপোর্টে ভারতের মূলধারার সংবাদমাধ্যমকে পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবে দেখানো হয়েছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন সরকারের কার্যক্রম এবং বিরোধী কণ্ঠস্বর দমন নিয়ে ভারতে সাংবাদিকতার ভূমিকা যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সামাজিক মাধ্যম এবং ইন্টারনেটের যুগে ভুয়া খবরের ব্যাপক প্রসার ঘটছে। ভারতীয় মিডিয়া হাউসগুলোকে মাঝে মাঝে এই ভুয়া খবরের উৎস বা প্রচারক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের সাংবাদিকতার প্রতি আস্থার অভাব তৈরি করেছে। ভারতের কিছু মিডিয়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং বিতর্কিত বিষয়গুলোতে পক্ষপাতমূলক কভারেজ করে থাকে বলে অভিযোগ ওঠে। এটি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নজরে এসেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০১৯ সালে কাশ্মীর ইস্যুতে মিডিয়ার ভূমিকা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দারুণভাবে উদ্বিগ্ন করেছে। এমনকি ২০২৪ এর শেষভাগে এসে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একই আচরণ প্রদর্শন করেছে তারা। লেখক: অনলাইন এক্টিভিস্ট আরটিভি/ডিসিএনই  
বাংলাদেশকে ঘৃণার পাত্র হিসেবে উপস্থাপন করে ভারত কী অর্জন করতে চাইছে: মাহফুজ আনাম
ভারত আর বাংলাদেশ দুই অকৃত্রিম বন্ধুদেশ এ কথা আমরা শুনে আসছি, পড়ে আসছি। কিন্তু সেটা ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত। কারণ, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত বিকৃত বর্ণনা, ভিয়েনা কনভেনশন লঙ্ঘন করে আগরতলায় বাংলাদেশের উপহাইকমিশনে কয়েকটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের হামলা ও দেশটির দায়িত্বশীল নেতাদের যে প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, তাতে প্রশ্ন উঠছে, এভাবে প্রতিবেশী দেশকে ঘৃণার পাত্র হিসেবে উপস্থাপন করে ভারত কী অর্জন করতে চাইছে? এ বিষয়ে ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনামের একটি লেখা পত্রিকাটি প্রকাশ করেছে। ডেইলি স্টারে প্রকাশিত মাহফুজ আনামের লেখাটি হুবহু তুলে ধরা হলো- সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদগুলো দেখলে একটি ধারণাই পরিস্ফুটিত হয়, তা হলো—বাংলাদেশ একটি হিন্দুবিদ্বেষী দেশ। যেভাবে বিষ ছড়ানো হচ্ছে, যে ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে, যেভাবে আমাদের অবমাননাকর ভাবমূর্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে তা থেকে এটা পরিষ্কার যে, ভারতীয় জনগণের মনে আমাদের প্রতি ঘৃণা তৈরির জন্যই এসব প্রচেষ্টা। এর ফলে ভারতীয়দের মধ্যে যে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ছে এবং একইসঙ্গে, বাংলাদেশেও যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে, তা দূর করা বেশ কঠিন হয়ে পড়বে। এভাবে প্রতিবেশী দেশকে ঘৃণার পাত্র হিসেবে উপস্থাপন করে ভারত কী অর্জন করতে চাইছে? এটা উভয় দেশেরই ক্ষতি করছে। এখানে আমাদের ক্ষতি—বাংলাদেশের একটি বিরূপ ভাবমূর্তি তৈরি করা হচ্ছে। আর ভারতের ক্ষতি—এ ঘটনায় আবারও প্রমাণ হচ্ছে যে তারা তাদের সব প্রতিবেশীর ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে চায় এবং কাউকেই নিজেদের নীতি গ্রহণের সুযোগ দিতে রাজি নয়। এসব নীতি ভারতের বিপক্ষে নয়, বরং আমাদের নিজের তৈরি পথে এগিয়ে চলার স্বতন্ত্র প্রকাশ। আমার নেপালি সাংবাদিক বন্ধুরা ভারতের মনোভাব ও ব্যবহার নিয়ে যেসব গল্প শোনান, সেগুলো ভারতের জন্য সম্মানজনক নয়। ভুটানের জনগণের মনেও ভারতের ভাবমূর্তি ভালো নয়। ভারতের সর্বশেষ সামরিক উপস্থিতিটুকুও দূর করার জন্য মালদ্বীপ যেভাবে সচেষ্ট, তা খুবই স্পষ্ট বার্তা দেয়। শ্রীলঙ্কার নতুন নেতৃত্ব কী আমাদের ক্ষমতাধর প্রতিবেশী দেশটিকে বিশেষ বার্তা দেয়নি? সব মিলিয়ে, ভারত সম্পর্কে প্রতিবেশীদের অভিন্ন মনোভাব কী প্রকাশ পায়নি? তারপরও সমালোচনামূলক মতামতকে গুরুত্বহীন, ভিত্তিহীন বা ঈর্ষা দ্বারা প্রভাবিত বলে উড়িয়ে দেওয়া এবং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, কৃতজ্ঞতাহীন বলে বিবেচনা করা কতটুকু বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। তার পরিবর্তে প্রতিবেশীদের আরও ভালোভাবে বোঝার প্রয়োজনীয়তা ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের অনুভব করা উচিত। ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত ভারতীয় গণমাধ্যম ও নেতাদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ ছিল অতি উত্তম প্রতিবেশী। তাদের মতে আমাদের দ্বিপাক্ষিক বন্ধুত্ব নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছিল। তাহলে কী এমন ঘটল যে বাংলাদেশ অতি উত্তম প্রতিবেশীর মর্যাদা থেকে অন্যতম নিন্দিত দেশে পরিণত হলো? তাদের চোখে আমাদের পতনের কারণ হচ্ছেন ৫ আগস্ট আমাদের সরকার পরিবর্তন। অথচ, এটি কোনো ষড়যন্ত্রমূলক ক্ষমতার পালাবদল ছিল না। কিন্তু ভারত সরকার ও তাদের গণমাধ্যম সেটাই ভাবছে। তারা বিষয়টি মানতেই পারছে না যে এই সরকার পরিবর্তন বাংলাদেশের মানুষের মতে প্রতিফলন। তারা বিশ্বাস করে যে, এটি পাকিস্তান, চীন বা যুক্তরাষ্ট্রের কাজ—বাংলাদেশের জনগণের নয়। যে সত্যটি তারা মেনে নিতে পারছে না সেটা হলো, আমাদের আন্দোলন ছিল 'জনতার ইচ্ছা'র একটি শক্তিশালী প্রকাশ, যা বহু বছর আগে ফিলিপাইনের ফার্দিনান্দ মার্কোসের পতন ঘটানো ‘পিপলস পাওয়ার’ আন্দোলন কিংবা মিশরের হোসনি মুবারককে উৎখাত করা ‘আরব বসন্ত’র চেয়েও শক্তিশালী ছিল। কিন্তু এই ঘটনা আমাদের প্রতিবেশীর মন ও মননে দাগ কাটতে পারেনি। এ দেশের মানুষ কয়েক সপ্তাহে যা করে দেখিয়েছে তা করতে অন্যদের বছর না হলেও কয়েক মাস লেগেছে। এটাই ছিল জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শক্তি। ভারত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের শক্তিমত্তা অনুধাবন করতে পারেনি, কারণ আমাদের ছাত্র আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাস সম্পর্কে হয়তো তারা অবগত নয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছরের মধ্যেই দেশটির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বিরুদ্ধে আমাদের শিক্ষার্থীরা রুখে দাঁড়িয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। তারা জেনারেল আইয়ুবের 'ইস্পাত-কঠিন শাসনামল'র অবসান ঘটিয়েছে, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা (১৯৬৬) ও ছাত্রদের ১১ দফাকে (১৯৬৯) পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপ্রতিরোধ্য আন্দোলনে পরিণত করেছিল। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে জয়লাভের পেছনেও ছাত্ররাই সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছিল এবং বলাই বাহুল্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় সশস্ত্র সংগ্রামের ভিত্তি গড়ে তুলতেও ছাত্র ও কৃষকভিত্তিক যুব সমাজ ছিল অগ্রভাগে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও আমাদের ছাত্রদের গৌরবময় ঐতিহ্য অব্যাহত থাকে। তারা মানবাধিকার ও সামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠার পক্ষে এবং স্বৈরাচার, সামরিক শাসন ও সব ধরনের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। '৩৬ জুলাই'য়ে যা কিছু হয়েছে, তা সেই ঐতিহ্যেরই ধারাবাহিকতা, এমনকি তারচেয়েও বেশি কিছু। এই আন্দোলন অনেক বেশি উদ্দীপনাপূর্ণ, শক্তিশালী ও সর্বব্যাপী ছিল। কেউ ভাবতে পারেনি যে গণআন্দোলনের মাধ্যমে হাসিনা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব। কিন্তু আমাদের ছাত্ররা তা করে দেখিয়েছে, যা এই আন্দোলনকে করে তুলেছে অনন্য। গণতান্ত্রিকভাবে নিজেদের সরকার পরিবর্তনের অধিকার যে আমাদের আছে, সেটা ভারত মানতে পারছে না। আমাদের দেশে ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়তো প্রচলিত ধারার নির্বাচনের মাধ্যমে হয়নি। বরং এটা ছিল 'জনতার ইচ্ছা'র বলিষ্ঠ প্রকাশ, যা সাধারণত নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নিজেই নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করেছিলেন। যার ফলে আন্দোলনই ছিল একমাত্র পথ। মজার বিষয় হলো, তিনি যদি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করে পরাজিত হতেন, তাহলে অন্তত দেশে থেকে যেতে পারতেন। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার লজ্জার মুখে তাকে পড়তে হতো না। কাজেই সার্বিকভাবে আমাদের ক্ষমতার পটপরিবর্তন ছিল গণতন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু ভারত প্রথম থেকেই এটা মেনে নেয়নি। উল্টো তারা 'ষড়যন্ত্র তত্ত্ব' তৈরি করেছে এবং আজ অবধি তারা সেই তত্ত্বই আঁকড়ে ধরে আছে। আমরা সবাই জানি, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যান এবং তার সরকারের পতন হয়। ৮ আগস্ট ড. ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আগের তিন দিন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে তৈরি হয় শূন্যতা। এ সময় আওয়ামী লীগের বেশকিছু নেতা ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ আক্রান্ত হন। তাদের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করা হয়। এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য যে, আক্রান্তদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের কর্মী ছিলেন এবং তাদের অনেকে পতিত সরকারের বিশেষ সুবিধাভোগী ছিলেন (তার অর্থ এই নয় যে তাদের ওপর হামলা করা ঠিক হয়েছে)। কাজেই এই হামলার ঘটনাগুলো সাম্প্রদায়িক হামলা বলা সম্পূর্ণভাবে উচিত না, যদিও সেটাই করা হচ্ছে। যদি পুলিশ বাহিনী তাদের স্বাভাবিক দায়িত্বে থাকত, তাহলে এমন ঘটনা ঘটত না। যাইহোক, প্রথম কয়েক দিনের সেই ঘটনাগুলো বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতি সম্পর্কে ভারতীয় সরকার ও গণমাধ্যমের দৃষ্টিভঙ্গিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। নতুন নেতাদের পর্যবেক্ষণ ও সঠিক মূল্যায়ন করার পরিবর্তে ভারতীয় গণমাধ্যমে ভুল ব্যাখ্যা ও ভুল প্রতিবেদন প্রকাশের হিড়িক পড়ে যায়। ভারতের প্রভাবশালী কয়েকটি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় আমি অনুরোধ করেছিলাম, তারা যেন বাংলাদেশকে 'হাসিনার চোখে না দেখে গণতন্ত্রের চোখে দেখে'। দুঃখজনকভাবে তারা সে কথায় কর্ণপাত না করে একই ধারা চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতের গণমাধ্যমগুলো একে অপরকে ইন্ধন জুগিয়েছে এবং শেখ হাসিনার পতনকে পাকিস্তানের আইএসআইয়ের সহযোগিতায় জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্রসংগঠন শিবিরের কাজ বলে আষাঢ়ে গল্প তৈরি করেছে। তাদের যুক্তি হচ্ছে, আন্দোলন হয়তো শিক্ষার্থীরাই শুরু করেছিল, কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এটাকে নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে গেছে। এটা ছিল ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর ভাষ্য, যার টোপে আটকে গেছে ভারতীয় গণমাধ্যম। যখন ভারতীয় গণমাধ্যমে 'হিন্দু হত্যা'র ন্যারেটিভ সবকিছুকে ছাড়িয়ে যাচ্ছিল এবং আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক হুমকির মুখে, তখন বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে সংগঠিত সংগঠন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ৪ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট সময়কালের ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ১৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার দুই হাজার ১০টি ঘটনা ঘটেছে বলে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, এসব ঘটনায় নয় জন নিহত, চারজন নারীকে ধর্ষণ, ৬৯টি উপাসনালয়ে হামলা, ৯১৫টি বাড়ি ও ৯৫৩টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, ৩৮টি শারীরিক হামলা ও ২১টি সম্পত্তি দখলের ঘটনাও ঘটেছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বাংলা পত্রিকা প্রথম আলো ৬৪ জেলায় ও ৬৯ উপজেলায় তাদের নিজস্ব প্রতিবেদকের মাধ্যমে সরেজমিন তদন্ত চালিয়ে ৫ থেকে ২০ আগস্টের মধ্যে এক হাজার ৬৮টি বাড়ি ও ব্যবসায়িক স্থাপনায় হামলার প্রমাণ পায়। এ ছাড়া, ২২টি উপাসনালয়ে হামলার তথ্যও পায়। তাদের প্রতিবেদকরা এসব স্থানের মধ্যে ৫৪৬টিতে (৫১ শতাংশ) সরেজমিনে পরিদর্শন করে এবং বাকিগুলোর পরিস্থিতিও নির্ভরযোগ্য সূত্রের মাধ্যমে যাচাই করে। এসব ঘটনায় দুইজন নিহত হয়েছেন—একজন বাগেরহাটের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মৃণাল কান্তি চট্টোপাধ্যায় এবং অপরজন খুলনার পাইকগাছার স্বপন কুমার বিশ্বাস। সংখ্যালঘুদের ওপর যেকোনো ধরনের হামলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশকে অবশ্যই সবার নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করতে হবে। কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যমে যেভাবে বাংলাদেশকে তুলে ধরা হচ্ছে, সেটা কি ন্যায়সঙ্গত? সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা কি ভারতেরও বাস্তবতা নয়? গুজরাটের গোধরায় একটি ট্রেন জ্বালিয়ে দেওয়া এবং সেখান থেকে শুরু হওয়া দাঙ্গায় ৭৯০ জন মুসলিম ও ২৫৪ জন হিন্দু নিহত হয়েছিলেন, হাজারো মানুষ গৃহহীন হয়েছিলেন। এই তথ্য খোদ ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ২০০২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ভারতে ৩১টি দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ২০টি ছিল হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে। ভারতীয় গণমাধ্যম এখন যা করছে, তখন কি বাংলাদেশি গণমাধ্যম তেমন কিছু করেছিল? সাম্প্রতিক যেসব ঘটনার কারণে ভারতে বিক্ষোভকারীদের হাতে বাংলাদেশি পতাকা এবং আমাদের দেশে কয়েকটি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের হাতে ভারতের পতাকার অবমাননা হয়েছে; চট্টগ্রামে এক মুসলিম আইনজীবী ও ঢাকায় একজন হিন্দু চিকিৎসক হত্যার ঘটনা ঘটেছে, এগুলোর পেছনে ইন্ধন জুগিয়েছে সাবেক ইসকন নেতা গ্রেপ্তারের ঘটনা। আগরতলায় আমাদের সহকারী হাইকমিশনে হামলার ঘটনাটি নিন্দনীয় এবং এটি প্রতিরোধ করা উচিত ছিল, প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল। অপরদিকে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী পাঠানোর জন্য তাদের প্রধানমন্ত্রী মোদিকে যে পরামর্শ দিয়েছেন, তা অত্যন্ত অপমানজনক এবং এর ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় ঐক্যের আহ্বান এবং সব রাজনৈতিক দলকে একত্রিত হয়ে আমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার আহ্বান স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, আমরা এই পরিস্থিতিকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছি। যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু যুদ্ধংদেহী ভারতীয় গণমাধ্যম সেগুলোকে যেভাবে প্রচার করেছে, তা পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে। কিন্তু আমাকে যে বিষয়টি সবচেয়ে হতবাক করেছে তা হলো, তারা প্রতিবেদন তৈরি ও প্রচারের আগে তথ্যগুলো যাচাই করেনি। অথচ, এগুলো সাংবাদিকতার একেবারে মৌলিক ও প্রাথমিক দায়িত্ব। অনেক সাক্ষাৎকার ও টকশোতে অন্য কোনো অপ্রাসঙ্গিক ঘটনার ফুটেজ দেখিয়ে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। সম্প্রতি আরটি ইন্ডিয়ার ওয়েবসাইটে শিব মূর্তি ভাঙার একটি ফুটেজ দেখানো হয়। সেখানে দাবি করা হয়, ভিডিওটি বাংলাদেশ থেকে ধারণ করা। প্রকৃতপক্ষে, এটি ভারতের বর্ধমানের সুলতানপুরের একটি মন্দিরের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ফুটেজ। আমরা আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরলেও আরটি ইন্ডিয়া দুঃখপ্রকাশ করা তো দূরে থাক, ভুল প্রতিবেদনটি সংশোধনও করেনি। এ ধরনের ঘটনা কমতে থাকবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। গণমাধ্যমের উত্তপ্ত ভাষাও হয়তো কিছুটা ঠান্ডা হয়ে আসবে এবং নৈতিক মূল্যবোধের জায়গায় ফিরবে। কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যমের সৃষ্টি করা এই বিকৃত বর্ণনার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব আমাদের দেশে দীর্ঘমেয়াদে বেদনাদায়ক অনুভূতি রেখে যাবে। অহংকারী ও যেকোনো মূল্যে বাড়তি ক্লিক পাওয়ার মানসিকতার কারণে ভারতীয় গণমাধ্যম হয়তো এটা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করবে না, কিন্তু পেশাদার কূটনীতিকরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন বলে আশা করি। মাহফুজ আনাম, সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
এ সমাজে পুরুষ কোথায়?
আমাদের জীবনটাই হয়ে গেছে দিবসময়। আজ এই দিবস তো কাল সেই দিবস। এরই মাঝে আজ চলে এসেছে আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস। যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে এত দিবস পালনের পক্ষে নই। কিন্তু আজ লিখতে হচ্ছে। গতকাল রাত থেকেই ইনবক্সে অনেকেই লিখেছেন, নারী দিবসে তো আপনাকে শুভেচ্ছা জানাই কিন্তু পুরুষ দিবসে কেন আমাদের শুভেচ্চা জানাবেন না? এত এত মেসেজ দেখে কিছুটা বিরক্ত হলেও অবাক হইনি।  একজন অভিনেত্রী হিসাবে সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আমার যোগাযোগ রয়েছে। তারা আমার কাছ থেকে শুভেচ্ছা চেয়েছেন। আমি অবশ্যই নিজের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে পৃথিবীর সব পুরুষকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। পাশাপাশি এ সমাজে পুরুষ কোথায়? এ প্রশ্নটাও তুলে রাখলাম।  কেননা আমার কাছে পুরুষ মানে পিতা, পুরুষ মানে স্বামী, পুরুষ মানে ভাই-বন্ধু-স্বজন। কিন্তু আজকের একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে বলতে বাধ্য হচ্ছি, এ সমাজে পুরুষ (মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন) কোথায়? তাদের সংখ্যা খুবই নগণ্য।  এত বসন্ত পার করেও জীবনে চলার পথে পুরুষ দেখেছি, কিন্তু মানবিক মূল্যবোধে পরিপূর্ণ, নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল পুরুষ তেমনভাবে দেখিনি। আজকে আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবসে আমার প্রত্যাশা থাকবে, পৃথিবীর সব নারীর প্রতি পুরুষের সহনশীলতা ও শ্রদ্ধাবোধ থাকুক। তাহলেই এই সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যে যে দূরত্ব তা সরে যাবে। একটি সমতাভিত্তিক সমাজের প্রত্যাশায় যেখানে নারী-পুরুষ সমধিকার নিয়ে চলতে পারবে।  উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস প্রতি বছর ১৯ নভেম্বর তারিখে পালিত হয়। সারা বিশ্বব্যাপী পুরুষদের মধ্যে লিঙ্গ ভিত্তিক সমতা, বালক ও পুরুষদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা এবং পুরুষের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরার প্রধান উপলক্ষ হিসেবে এই দিবসটি উদ্‌যাপন করা হয়ে থাকে। পুরুষ দিবস পালনের প্রস্তাব প্রথম করা হয় ১৯৯৪ সালে। তবে ইতিহাস বেশ পুরোনো। ১৯২২ সাল থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে পালন করা হতো রেড আর্মি অ্যান্ড নেভি ডে। এই দিনটি পালন করা হতো মূলত পুরুষদের বীরত্ব আর ত্যাগের প্রতি সম্মান জানিয়ে। ২০০২ সালে দিবসটির নামকরণ করা হয় ‘ডিফেন্ডার অফ দ্য ফাদারল্যান্ড ডে’। রাশিয়া, ইউক্রেনসহ তখনকার সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে এই দিবসটি পালন করা হতো। বলা যায়, নারী দিবসের অনুরূপভাবেই দিবসটি পালিত হয়। ষাটের দশক থেকেই পুরুষ দিবস পালনের জন্য লেখালেখি চলছে। ১৯৬৮ সালে আমেরিকান সাংবাদিক জন পি হ্যারিস নিজের লেখায় এ দিবসটি পালনের গুরুত্ব তুলে ধরেন। নব্বই দশকের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও মাল্টায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ফেব্রুয়ারিতে পুরুষ দিবস পালনের জন্য বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। যদিও অনুষ্ঠানগুলো খুব একটা প্রচার পায়নি। অংশগ্রহণও ছিল কম। পরবর্তী সময়ে ১৯ নভেম্বর পুরো বিশ্বে পুরুষ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরিশেষে বলতে চাই, আমার সোনার বাংলাদেশে সোনার পুরুষ হোক। মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন পুরুষ থাকুক। নারীর প্রতি বিদ্বেষ, হিংসা না ছড়িয়ে নিজের পরিবারে যে নারী আছে, তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকুন। তাহলেই এ সমাজে কোনো নারী পুরুষের লালসার শিকার হবে না। সমাজে শান্তি ফিরে আসবে। পুরুষের শক্তি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধেই নিহিত। জয় হোক সকলের। শুভ কামনা মানবিকবোধ সম্পন্ন পুরুষদের জন্য। লেখক: অভিনয়শিল্পী   আরটিভি/ডিসিএনই  
এক মহাজীবনের সান্নিধ্যে কিছু দুর্লভ মুহূর্ত
দুই যুগ পেরিয়ে গেছে সাংবাদিকতার বয়স। এই লম্বা সময়ে মনে রাখার মতো প্রাপ্তি হলো কিছু মহাজীবনের সান্নিধ্য, যাদের মধ্যে অন্যতম হুমায়ূন আহমেদ। কখনো দখিন হাওয়া কখনো নুহাশপল্লী, হুমায়ুন স্যারের সঙ্গে বহুবার কথা বলার সুযোগ হয়েছে। একান্ত সাক্ষাৎকার নিয়েছি একাধিকবার। পেশাগত প্রয়োজনের বাইরেও হুমায়ূন আহমেদের সম্মোহনী কথার আসরে হাজির থাকার সৌভাগ্য হয়েছে। তিনি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন, পছন্দও করতেন। মাত্র ৬৪ বছর আয়ু নিয়ে পৃথিবীতে আসা ক্ষণজন্মা এই মনীষির জন্মদিন আজ। হুমায়ূন আহমেদের ৭৬ তম জন্মদিনে লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তার  সঙ্গে কাটানো কিছু দুর্লভ মুহূর্ত স্মরণ করছি। ঠিক কবে কখন হুমায়ূন আহমেদের লেখা কোন বইটি পড়েছিলাম মনে নেই। মনে আছে, বাবা-মা-ভাই-বোন সবাই একসঙ্গে বসে ‘এইসব দিনরাত্রি’ দেখার কিছু টুকরো স্মৃতি। ১৫ দিন পর পর ধারাবাহিকটির একেকটি পর্ব প্রচার হতো। যেদিন বিটিভিতে ‘এইসব দিনরাত্রি’ দেখানো হবে, সেদিন আমাদের পরিবারে আগে থেকেই শুরু হতো প্রস্তুতি। খুব সম্ভবত রাত ৯টায় দেখানো হতো ধারাবাহিকটি। আগে ভাগেই সেদিন রাতের খাওয়াদাওয়ার পালা শেষ করে আমাদের ৬ সদস্যের পরিবারের সবাই বসতাম টিভি সেটের সামনে। মনে পড়ে নাটকটির টুনি চরিত্রের মৃত্যুর ঘটনাটি। মা-বাবা দুজনের চোখেই দেখেছিলাম জল। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়ে যাচ্ছে। পড়ার টেবিলে বসে আছি। হঠাৎ কানে ভেসে উঠল ‘বাকের ভাইয়ের কিছু হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’। বইখাতা আর বাবার চোখ রাঙানি ভুলে দে ছুট। বিশাল মিছিল। মিছিলে লোকজন কেবল বাড়ছে। সবার সঙ্গে গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার দিলাম ‘বাকের ভাইয়ের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র’। তারপর কত নাটক আর কত উপন্যাস! কলেজ জীবনে পরিচয় হলো হিমুর সঙ্গে। ইচ্ছে হলো, আমিও হিমু হই। ওমা শুধু কী আমি, সহপাঠী অনেকের মধ্যেও দেখলাম হিমুর প্রচণ্ড প্রভাব। সাংবাদিকতা শুরু করি দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায়, আমার দ্বিতীয় কর্মস্থল ছিল অন্যদিন। এ পত্রিকার সহযোগী প্রতিষ্ঠান অন্যপ্রকাশ, যেখান থেকে হুমায়ূন আহমেদের বেশির ভাগ বই প্রকাশিত হয়েছে। আমার ওপর দায়িত্ব পড়ে হুমায়ূনের তৃতীয় ছবি ‘দুই দুয়ারী’ নিয়ে একটি কভার স্টোরি তৈরির। সেটা ছিল ১৯৯৯ সাল। প্রথম সুযোগ হয় হুমায়ূন আহমেদের মুখোমুখি হওয়ার। প্রথমবার হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকারে কেবল ‘দুই দুয়ারী’ আর নাটক-চলচ্চিত্র প্রসঙ্গেই কথাবার্তা হয়। স্বাভাবিকভাবেই আমি মুগ্ধ। যথাসময়ে কভার স্টোরি বের হলো। সময় এলো ‘দুই দুয়ারী’ মুক্তির।  ছবি মুক্তির ঠিক আগের দিন সম্পাদক মাজহারুল ইসলামের রুমে আমার ডাক পড়ল। ভিতরে ঢুকে দেখি বসে আছেন হুমায়ূন আহমেদ। তিনিই আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। বললেন, তোমার লেখা কাভার স্টোরি আমার পছন্দ হয়েছে। কাল তো ছবি মুক্তি পাচ্ছে। তুমি এত সুন্দর একটা লেখা তৈরি করলে, ছবি মুক্তি পাবে আর তুমি দেখবে না, তা হয় না। পকেট থেকে দুইটা টিকিট বের করে দিলেন। মধুমতি সিনেমা হলের টিকিট। বললেন, বিয়ে করেছো? - জ্বি না, করিনি। - প্রেম করো? - আসলে সেইভাবে … - এই বয়সে প্রেম না করলে আর কবে করবে? একটা টিকিট তোমার জন্য আরেকটি টিকিট তোমার প্রিয় কারও জন্য। এই হলেন হুমায়ূন আহমেদ। এর অনেক দিন পর হুমায়ূন আহমেদের আরেকটি সাক্ষাৎকার নিতে তার দখিন হাওয়ার বাসায় যাই। অ্যাপয়েনমেন্ট করা ছিল শাওনের সঙ্গে। ড্রয়িং রুমে বসে আছি। হুমায়ূন আহমেদ এলেন। আমি জানতে চাইলাম, স্যার আমাকে চিনতে পেরেছেন? হুমায়ূন আহমেদ বললেন, তুমি কী আমার স্মৃতিশক্তির পরীক্ষা নিতে আসছো? - জ্বি না স্যার… এমনিই… - তোমার নাম বিপুল হাসান। বিপুল মানে বিশাল। পৃথিবীতে এসেছো, নামকরণে স্বার্থকতা প্রমাণ করে যাবে, ঠিক আছে? কী আশ্চর্য, মাত্র একবার সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর থেকেই আমার মতো অভাজনকে তিনি মনে রেখেছিলেন। এরপর কতবার চাকরি বদল... অন্যদিন, ভোরের কাগজ, আনন্দ আলো, বাংলানিউজ। হুমায়ূন স্যারকে নিয়ে কিংবা তার সৃষ্টি নিয়ে স্টোরি করার জন্য সময় চাইলে তিনি কখনও বিমুখ করেননি। এমনকি জানতেও চাননি কোন পত্রিকার জন্য কাজটি করছি। এমনও হয়েছে ধানমন্ডির দখিন হওয়া কিংবা গাজীপুরের পিরুজালী গ্রামের নুহাশপল্লীতে অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে গেছি। কিন্তু হুমায়ূন স্যারের সঙ্গে আড্ডায় বসে তার সম্মোহনী কথোপকথনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ভুলে গেছি কী কাজে সেখানে যাওয়া! একবার গেলাম নুহাশ পল্লীতে। হুমায়ূন আহমেদ তখন সবেমাত্র ওষুধি গাছপালা চাষাবাদ শুরু করেছেন। দেখলাম গাছপালা নিয়ে তার ভীষণ উৎসাহ। আমাদের নিয়ে গেলেন তার সেই বাগানে। - এটা হলো উলট কম্বল। কোষ্ঠকাঠিন্য হলে এ গাছের ডালপালা বেটে রস দিয়ে শরবত খেলে মুহূর্তেই মামলা খালাস। - জ্বি, স্যার। - এখন পর্যন্ত ১৩৪টি গাছ লতাপাতা সংগ্রহ করেছি। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের কোনো বাগানে একসঙ্গে এত ওষধি গাছপালা নেই। হঠাৎ স্যার বলে ওঠলেন, ‘মানুষের চেয়ে গাছ অনেক বেশি ভাগ্যবান!’  মনে মনে বলি, এ কেমন কথা? গাছরা বেশি ভাগ্যবান হয় কী করে?  ব্যাখ্যা দিলেন হুমায়ূন আহমেদ নিজেই। বললেন, ‘এটা টের পাবে প্রতি বসন্তে। দেখো, বছর বছর বসন্ত আসে। কৃষ্ণচূড়া লালফুলে ছেয়ে যায়, আমগাছে মুকুল আসে, গাছে গাছে নতুন করে কচিপাতা গজায়। এর মানে বসন্ত এলে বৃক্ষরা ফিরে পায় নতুন যৌবন। প্রতি বসন্তেই গাছপালা যৌবন ফিরে পায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, মানুষের জীবন থেকে একবার যৌবন চলে গেলে আর ফিরে আসে না।’ সেদিন স্যারের এ কথা শোনার পর অ্যাসাইনমেন্টের কথা ভুলে গিয়েছিলাম। মনে আক্ষেপ, বৃথাই এ মানবজীবন। কেনো বৃক্ষ হয়ে পৃথিবীতে এলাম না।  নুহাশপল্লীতেই আরেকবার হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে এক আড্ডায় বসার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। এমন এক যাদুকরী ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তিনি যে, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনতে হতো। বিশাল তার জ্ঞানের পরিধি। এটা সেটা নানা বিষয়ে কথাবার্তার পর উঠলো ধর্মবিষয়ক কথাবার্তা। একপর্যায়ে স্যারের কাছে আমি প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা স্যার, ভালো কাজ করে বেহেশতে গেলে তো পুরুষরা ৭০ জন হুর পাবে। নারীদের ক্ষেত্রে কী হবে? হুমায়ূন স্যার প্রথমেই কোরআন শরীফের একটা আয়াত পড়লেন। অবাক হলাম, কোরআনের আয়াত তার মুখস্ত দেখে। তারপর তিনি ব্যাখ্যায় এলেন। স্যার বললেন, পুনরুত্থানের পর তোমার স্বত্বা কী হবে, তা কী তুমি বলতে পারো? বেহেশতে যাওয়ার পর নারী বা পুরুষ স্বত্বা তুমি নাও পেতে পারো। ফেরেশতারা না নারী, না পুরুষ? তারা যেমন কোনো লিঙ্গের নয়। তোমার পরিণতিও তো তাই হতে পারে। আর হুররাও যে নারী বা পুরুষ হবে, তা নিশ্চিত হও কী করে। শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়ার মধ্যে তখন তীব্র সংঘাত। দুই নেত্রীর মধ্যে ঐক্য তৈরির জন্য নানারকম উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে কিন্তু কাজ হচ্ছে না। সে সময় হুমায়ূন স্যারের এক সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে প্রশ্ন করলাম, আপনাকে যদি দুই নেত্রীর মধ্যে সমঝোতার উদ্যোগ নিতে বলা হয় তাহলে কী করবেন? হুমায়ূন আহমেদ বললেন, আমি দুই নেত্রীকে অনুরোধ জানিয়ে বলব, আপনারা এক ঘণ্টার জন্য আমাকে সময় দেন। আমার নুহাশ পল্লীতে আপনারা একবার এসে এককাপ চা খান। তারপর জায়গাটা একটু ঘুরে ফিরে দেখেন। আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে। আমি নিশ্চিত এই অল্পসময়েই দুই নেত্রীর মধ্যে ভাব হয়ে যাবে। কারণ, তারা দুজনেই খুব ভালো মানুষ। দেশের স্বাধীনতার জন্য তাদের দুই পরিবারেরই অবদান আছে। দুজনই দেশকে ভালোবাসেন। কিছু সময়ের জন্য তারা একসঙ্গে হলেই তাদের মধ্যে মিলমিশ হয়ে যাবে। দুজন মিলে তখন দেশ গড়ার উদ্যোগ নেবে। তখন আর আমাদের দেশকে ঠেকায় কে। দেখবে ধেই ধেই করে বাংলাদেশ কোথায় চলে যাবে। অসম্ভব প্রাণবন্ত মানুষ হুমায়ূন আহমেদ শুয়ে আছেন নুহাশ পল্লীতে লিচু গাছের নিচে মাটির বিছানায়। কিন্তু তার সংস্পর্শ পাওয়ার মুহূর্তগুলো এখনও ছায়াছবির মতো চোখের সামনে ভাসে। লেখক : উপপ্রধান বার্তা সম্পাদক, আরটিভি  
রক্ষক যখন ভক্ষক 
বাংলাদেশের পুজিবাজারে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ হওয়া উচিত ছিলো সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থার স্থান, সেখানে খোদ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ কমিশন অবৈধ বাণিজ্যের সাথে জড়িত খায়রুল বাশার এবং তার সহযোগী গংদের দিয়ে চলেছে সুরক্ষা।  গত ১১ নভেম্বর সোমবার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে একটি দল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের উর্ধ্বতন কমকর্তাদের সাথে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য যায়। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এজিএম সাত্তিক আহমেদ বিনিয়োগকারীদের সাথে কথা বলেন, যার ভিডিও আমাদের কাছে আছে। বিনিয়োগকারীরা স্পষ্টভাবে ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালককে জানিয়ে আসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান নিয়ন্ত্রক কমকর্তা খায়রুল বাশার আবু তাহের মোহাম্মদ, বজলুর রহমান (এজিএম), মোহাম্মদ ইকরাম (মনিটরিং ম্যানেজার), মো. জাকির (সিনিয়র এক্সকিউটিভ) এবং মো. আফজালুর রহমান (ইনভেস্টিগেশন এন্ড এনফোর্সমেন্ট, এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার) এই পুরো টিমটি পুঁজিবাজারের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করছে।  তারা বর্তমান সরকারকে বিব্রত করার জন্য কাজ করছে, বর্তমান সিকুউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান খন্দকার মাকসুদের কমিশনের  বিরুদ্ধে কাজ করছে। তারা বিগত সরকারের সালমান এফ রহমান - শিবলী রুবাইয়াত (সাবেক চেয়ারম্যান বাংলাদেশ সিকুউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন) এর পক্ষ হয়ে কাজ করছে। এই চক্রটি ২৫০ টি ব্রোকার হাউজের কাছে আতংকের নাম, এরা সাপ্তাহিক চাঁদা উত্তোলন করে প্রতিটি ব্রোকার হাউজ থেকে। যদি কোন ব্রোকার হাউজ চাঁদা দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে তারা তার বিরুদ্ধে আইনের তকমা দিয়ে হেনস্থা করে। বিগত সরকারের শেষ সময়ের চাঞ্চল্যকর তদন্তের নামে হয়রানির শিকার আভিভা ইকুউটি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড। সালমান এফ রহমান ৪০ কোটি টাকার মারজিন লোন নেয় তার কোম্পানির স্পনসর শেয়ার দিয়ে। এই টাকা এখন পর্যন্ত অনাদায়ী পাওনা হিসেবে পড়ে আছে। সালমান এফ রহমানের কাছে পাওনা টাকা ফেরতের জন্য তাগাদা দিলে উনি উনার খায়রুল বাশার গং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পেটুয়াবাহিনী লেলিয়ে হয়রানির নামে তদন্ত চালিয়ে যায়। সেই টাকা সালমান এফ রহমানের কাছে থেকে কোনভাবেই উদ্ধার করা সম্ভব হয় নাই এবং উনি সেই ক্রয়কৃত শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রেও বাধা দেয়। এ অবস্থায় আভিভা ইকুইটি ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে বারংবার চাপ দেওয়া হলে সালমান-শিবলী ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তাদের পেটোয়া বাহিনী খায়রুল বাশার আবু তাহের এবং তার পালিত প্রভুভক্ত টিমকে লেলিয়ে দেয়। তারা নিয়মবহির্ভূতভাবে চিরুনি অভিযানের নামে তদন্ত চালায়। শেষমেষ কোন অভিযোগ না পেয়ে জহিরুল হক জুয়েল (সাবেক কমকর্তা আভিভা ইকুইটি ম্যানেজমেন্ট লি:) এর মাধ্যমে ব্যক্তিগত মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে এখনো কড়া ভাষায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে চিঠি পাঠাচ্ছে। যা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের আইন বহির্ভুত। এই জহিরুল হক জুয়েল হলেন খায়রুল বাশার এবং বজলুর রহমানের খুবই বিশ্বস্ত সহচর এবং পুরানো বন্ধু। ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকেই এই ব্রোকার হাউজের সম্মানহানির মাধ্যমে খায়রুল বাশার গং প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করছে।  অভিযোগ আছে, এই খায়রুল বাশার গং বাজারের মাফিয়া এবং গেম্বালারদের সাথে চুক্তিবদ্ধ। বাজারের যেসব বস্তাপচা বন্ধ কোম্পানি আছে সেগুলো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে উচ্চ মূল্যে পাবলিককে শেয়ার গছিয়ে দিচ্ছে এবং বিপুল পরিমান অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। উল্লেখ্য, এমারল্ড অয়েল কোম্পানি  বা লাভেলো কোম্পানির শেয়ার যখন উচ্চমুল্যে ছাড়া হয়, তখন এই খায়রুল বাশার গং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে কোন আইনগত পদক্ষেপ নেয় নাই। তখন তারা নিরবতা পালন করে। কারণ এই গেম্বালারদের কাছ থেকে তারা মোটা অংকের টাকা পায়। আর যখন তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ ছাড়া কোন ভালো কোম্পানির শেয়ার বাজারে নিজস্ব গতিতে বেচাকেনা হয় তখন তারা ইনকুয়েরি দিয়ে চিঠি পাঠায় কোম্পানিকে, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের, ব্রোকার হাউজগুলোতে। এর মাধ্যমে তারা তাদের ভাগের টাকা আদায়ের চেষ্টা করে, নয়ত আইনের গ্যাড়াকলে ফেলে শেয়ার কেনাবেচা বন্ধ করে দেয়। আফসোস, বিগত সরকারের এই জঞ্জাল এখনো কিভাবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ভিতর চাকরি করে!  সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, এই চিহ্নিত দুষ্ট চক্রের সকল অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পদের পরিমাণ জানতে চেয়ে দুদকের মাধ্যমে তদন্ত করার। গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী সরকার পতনের পর এই খায়রুল বাশার আমেরিকা পালানোর চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু সফল হয়নি। অভিযোগ আছে, বর্তমানে তিনি সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থার একজন ডিডি বা অফিসারের প্রভাব খাটিয়ে তার চাকরি বাঁচিয়ে রাখার আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা খায়রুল বাশারের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানালেও খোদ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ তার এবং তার সহযোগীদের পক্ষে সাফাই গাইছে। এ অবস্থায় প্রশ্ন ওঠতেই পারে, আমরা কি আসলেই বিজয় আনতে পেরেছি? চোখের সামনে দেখছি, কিছু চাটার দল কোনো না কোনোভাবে দেশটাকে চেটে খাচ্ছে। লেখক: পুঁজিবাজার বিশ্লেষক এবং বিনিয়োগকারী আরটিভি/  ডিসিএনই