হিমালয়ের দেশ নেপাল
জুনের মাঝামাঝি অসহ্য ভ্যাপসা গরম ঢাকায়। মন পাখি বলে ঘুরে আসি হিমালয়ের দেশ নেপাল। বইয়ের পাতায় কত পড়েছি, সেই কাঞ্চনজঙ্ঘার আর হিমালয় পর্বতমালার দেশ যেখানে কিনা পৃথিবীর সর্বোচ্চ দশটি পর্বতের মধ্যে আটটিই অবস্থিত। নেপাল আর চীনের সীমান্তজুড়ে হিমালয় পর্বতমালা। আর এই পর্বতের সর্বোচ্চ চূড়া মাউন্ট এভারেস্ট। এ যেন স্বপ্নপূরণ! বাচ্চাদের পরীক্ষা শেষ তাই বাক্স প্যাটরা গুছিয়ে পুরো প্রস্তুতি নিয়ে ফেললাম।
একটা খুব ভাল বিষয় হচ্ছে নেপালে যেতে শুরুতেই ভিসা ঝামেলা নেই। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিমান সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে নেপালের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়ার কথা। আমরা বেশ কিছু আগেই বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলাম। প্রথমেই চেকিং পর্ব। আমাদের কোভিড ভ্যাকসিন সনদপত্র পর্যবেক্ষণ করে কাউন্টার থেকে আমাদের লাগেজ ট্যাগ বোর্ডিং পাস দেওয়ার পর বলাকা লাউঞ্জে অপেক্ষা করছি। এরপর দশটায় বিমানে উত্তরণের জন্য লাইনে দাঁড়ালাম।
ত্রিশ মিনিট দেরিতে বিমান যাত্রা শুরু করল নেপালের ত্রিভুবন এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। চোখ বন্ধ করে কল্পনায় আমি সেই হিমালয় আর এভারেস্টের বিশাল চূড়া নিয়ে ভাবছি। আহা মেঘ এসে নাকি পাহাড় ছুঁয়ে যায়! আর কিছুক্ষণ পর সেই স্বপ্ন দর্শন! আমি যখন ওই ঘোরের মাঝে ঠিক তখনই আমার কন্যাদ্বয়ের খুনসুটিতে বাস্তবে ফিরে এলাম। সাধারণত বড় বোনের কথা শুনে ছোটজন প্রথম পাঁচমিনিট কনফিউজড থাকে; পরে আমার শরণাপন্ন হয়। শুনছি বড় জন বলছে, ‘বোন যদি তুমি তোমার সিটের এই বাটনে চাপ দাও সঙ্গে সঙ্গে প্লেনের একটা চাকা খুলে যেতে পারে তাই খুব সাবধান যেন ভুলেও তোমার হাত না লাগে।’ ছোটজন বিস্মিত হয়ে, ‘তাহলে কি হবে?’ প্রতিউত্তর, ‘তোমাকে তাহলে সারাজীবন আকাশে থাকতে হবে।’ তাদের এইসব কথায় আমি হাসি চেপে কৃএিম রাগ দেখিয়ে থামালাম।
আমি প্লেনের জানালায় নিচে দেখার চেষ্টা করছি। কাঠমান্ডুর কাছাকাছি যেতেই বিমান একটু একটু করে কম উচ্চতায় নেমে আসছিল। আমিও নয়নভরে দেখে নিলাম উঁচু নিচু পাহাড় আর সবুজের সারি। এত সবুজ যে চোখ ফেরানোই দায়।
প্রায় এক ঘণ্টা বিশ মিনিট পর আমরা পৌঁছে গেলাম ত্রিভুবন এয়ারপোর্টে। নেমেই দেখি সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে কেউ ভিসা ফরম পূরণ করছে। ইচ্ছে করলে নিজের ফোন থেকেও করা যায়। সবার ফরম পূরণ শেষ হতেই আমরা ইমিগ্রেশন পার হলাম পর্যটক ভিসা নিয়ে।
প্রথমে আমরা নাগারকোট থাকব দুইদিন তাই পূর্বেই একটা গাড়ি ঠিক করে নিয়েছিলাম পুরো সময়টার জন্য। বাইরে বের হতেই দেখি বাহাদুর ভাই (গাড়িচালক) আমাদের নাম লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে। আমরা গাড়িতে উঠার আগে তিনি আমাদের চারজনের গলায় উত্তরীয় পড়িয়ে হাসিমুখে এভাবে সংবর্ধনা জানালেন। তিনি বললেন, ‘আপকো স্বোয়াগত হে।’ তার সংবর্ধনায় আমি মুগ্ধ। তিনি খুব ভাল ইংরেজিও জানেন।
নেপালে একটা বিষয় মুগ্ধ করার মতো, তা হলো দেশটির আতিথিয়তা। তারা পর্যটকদের সঙ্গে খুব চমৎকার আচরণ করে। সবাই হেসে কথা বলে। তাদের চেহারাতেও সরলতা বিদ্যমান।
নাগারকোট
নেপালের একটা প্রসিদ্ধ গ্রাম যা কিনা ত্রিভুবন এয়ারপোর্ট থেকে প্রায় ২৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই গ্রামটি সমুদ্র ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। এখান থেকে এভারেস্ট পর্বতসহ হিমালয়ের অন্যান্য পর্বতমালা দৃশ্যমান। গ্রামটি থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দৃশ্যের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। নাগরকোট থেকে কাঠমান্ডু উপত্যকার অপরূপ মনোরম দৃশ্যও দেখা যায়।
নাগরকোটের নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। আমরা যখন ধীরগতিতে গাড়ি করে যাচ্ছি তখন চারপাশের রঙ দেখে মাতোয়ারা মন। কিছুদূর পর পরই মিষ্টি হলুদরঙ আর নীল রঙের ঘণ্টার মতো ফুল শোভা পাচ্ছে গাছে। গাছগুলো বেশ বড় ও বিস্তৃত তাই দূর থেকে মনে হবে এক রাশ নীলাভ নয়তো হলুদের ঝোপ। আমি বাহাদুর ভাইকে প্রশ্ন করতেই বললেন, এটা ধুতরা ফুল। আমাদের দেশে আমি গ্রামে সাদা ধুতরা দেখেছি কিন্তু এখানে ধুতরা ফুল আকারে বড় এবং অনেক রঙের।
পাহাড়ের ওপর রাস্তা ছিল খুব সরু এবং রাস্তায় তেমনভাবে লাইটের ব্যবস্থা নেই। তাই সন্ধ্যার পর খুব সাবধানে গাড়ি চালাতে হয়। বাহাদুর ভাই যখন আমাদের হোটেলে পৌঁছে দিলেন তখন মাত্র বিকেল চারটা। কিন্তু আকাশ ছিল মেঘে ঢাকা তাই চারপাশে ঘুটঘুটে আঁধার নেমে এসেছিল।
যাওয়ার পথটা এতটাই নির্জন ছিল যে, আমার কিছুটা ভয় ভয় লাগছিল। বাহাদুর ভাই বুঝতে পেরে আশ্বস্ত করলেন যে, এই জায়গা সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং এতই মনোরম যে পর্যটকদের কাছে এটি একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হাইকিং রুট অর্থাৎ এখানকার প্রাকৃতিক পাহাড়ি দৃষ্টিনন্দন পরিবেশে পায়ে চলা রাস্তা দিয়ে পর্যটকরা হেঁটে বেড়াতে বেশি পছন্দ করেন।
পরেরদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি সূর্যোদয় দেখবো বলে। না বিধিবাম! আকাশ মেঘলা তাই মনবাসনা অপূর্ণ রয়ে গেল। আরেকটি বিষয় আমরা শুনেছি যে, জুন-জুলাই মাসে নাগকোট শীতের কাপড় না নিলেও হয়। আর এই ভুলটাই আমরা করেছিলাম। দুপুরের রোদের তাপ কিছুটা কমলেই চারদিকে কেমন হিম শীতল বাতাস বইতে থাকে। আর সন্ধ্যা নামলে তো কথাই নেই। আমরা গুগলে দেখেছি তাপমাত্রা জুন-জুলাইয়ে ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে তবে রাতে বেশ শীত অনুভব হয়। আমরা যে হোটেলে ছিলাম তার দুতলায় খুব বড় খোলা করিডর ছিল। যেখানে বসে প্রিয় কফির পেয়ালা হাতে প্রিয় মানুষের সঙ্গে সময় কাটাতে সবারই খুব স্বপ্নের মতো লাগবে। আকাশটা নীল তার মাঝে সাদা হীরার মত তারা আর চারদিকে নিরবতা। যেখানে শুধু প্রকৃতির মিষ্টি গান শোনা যায়।
গাছেদের ফিসফিস পাতার খসে পড়া, দূরে পাহাড়ের চূড়ায় কোনো গ্রামে মিটিমিটি আলো আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ। কোথাও জোনাকি জ্বলছে মিটিমিটি। আহা এ যেন কবির কবিতার মত মনের একান্ত নিজস্ব স্বপ্নীল ভুবনে মুহূর্তে ভেসে যাওয়া। বাস্তবেও বুঝি এমন হয়! আমি আর পতি দুজনেই ভাবছি আমরা আবার এই ভুবনে আসবো।
তাই সবাইকে বলব যখনই নাগরকোট যাবেন অবশ্যই হালকা কিছু শীতের কাপড় নিয়ে নেবেন। রাতে বেশ ঠান্ডা পড়ে।
দুদিন অপেক্ষায় থাকার পর তৃতীয় দিনে আমরা কিছুক্ষণের জন্য সূর্যাস্ত দেখার সৌভাগ্য হলো। কি মনোলোভা নয়ন জুড়ানো সেই দৃশ্য! যেন পাহাড়ের চূড়া থেকে আস্তে- ধীরে একটা লাল টকটকে আগুন বল ডুবে যাচ্ছে তলিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের পাদদেশে। একসময় মিলিয়েও যায়। নাগরকোট গ্রামটি পৃথিবীর সবচাইতে উঁচু স্থানে অবস্থিত; যেখানে সবাই আকাশ দেখে ওপরে তাকিয়ে অথচ নাগরকোট থেকে আকাশ দেখতে গ্রামবাসী মাঠ থেকে নিচে তাকায় যেন তারা স্বর্গীয় সৌন্দর্য উপভোগ করছে মর্তালোক থেকে।
এখানকার মানুষ খুব পরিশ্রমী। বাচ্চারা পিঠে ব্যাগ নিয়ে উঁচু নিচু পাথুরে পথ দিয়ে দূরে কোন স্কুলে যায়। মহিলারা পিঠে ব্যাগ বেঁধে একপাল ভেড়া কখনো ছাগল, শুকর নিয়ে হেঁটে যায় তার গন্তব্যে।
পথে দেখা যাবে পাহাড় থেকে খুব সরু ঝিরিঝিরি ঝরনা নেমে এসেছে বিভিন্ন জায়গায়। ছোট ছোট ঘর আর তার উঠোনে মুরগি, শুকরছানা, ছাগল, ভেড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এখানে খুব সাধারণ যা দেখতে আমাদের মুদি দোকানের মত সেখানেও বিক্রি হচ্ছে ওয়াইন এবং নাম না জানা অনেক ধরনের রঙিন পানীয়। সবাই কিনছে কিন্তু দীর্ঘ পাঁচদিনে একবার ও আমাদের চোখে পড়েনি কেউ মদ খেয়ে রাস্তায় মাতলামি করছে বা কোন উচ্ছৃঙ্খলতা। সবাই আচরণে খুব পরিমিত এবং নিয়ন্ত্রিত, যা আমাকে মুগ্ধ করেছে।
ভক্তপুর
নাগরকোট থেকে ভক্তপুরের দূরত্ব প্রায় ১২.৪ কি.মি.। আমরা সকালের নাস্তা সেড়েই রওনা হলাম বাহাদুর ভাইয়ের গাড়িতে। রাস্তা যেহেতু সরু আর পাথুরে তাই সময় একটু বেশিই লাগলো। আমরা যাত্রাপথে চারপাশের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে প্রায় চল্লিশ মিনিট পর পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে।
ভক্তপুর এলাকার সামনে দাঁড়ালে মনে হবে কোন এক প্রাচীন সভ্যতার যুগে আমি চলে এসেছি। আমার ছোট কন্যা সম্প্রতি বিভিন্ন সভ্যতা নিয়ে পড়ছে। সে চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন রেখে বলে, মা আমরা কি মহেঞ্জোদারো নাকি হারিপ্পা সভ্যতায় এসে গেছি?
প্রবেশ পথে টিকিট নিতে হয়। টিকিটের দাম একটু বেশি মনে হয়েছে আমার কাছে। আমাদের চারজনের দুই হাজার রুপি লেগেছে। প্রবেশপথে আমাদের একটা লিফলেট দেওয়া হলো যাতে ভাক্তপুরের মানচিত্র আছে।
টিকিট নিয়ে সরু রাস্তা ধরে যতই এগিয়েছি ততই বিস্মিত হয়েছি। রাস্তার দুপাশে ছোট স্টলে থরে থরে সাজানো বিভিন্ন রকমের পুঁতি, পাথর আর মেটালের মালা, ইয়াকের হাড়ের তৈরি গহনা, ব্রেস্লেট, চাবির রিং, পশমিনো চাদর, পিতল কাসার ওপর খোদাই কারুকাজ করা মগ, গ্লাস পাত্র। তবে বেশ দামাদামি করতে হয় কিনতে গেলে। এর সঙ্গে আছে বিভিন্ন চিত্রশিল্পীর আঁকা ছবির স্টল। শিল্পী নিজে উপস্থিত থেকে তার আঁকা ছবি বিক্রি করছেন। আমি অনুমতি নিয়ে তাদের স্টলের ছবি তুলেছি।
ভক্তপুরে প্রবেশদ্বারে দেখবেন অনেকে বলবে তাদের গাইড হিসেবে নেওয়ার জন্য। তবে এ জায়গাটা মানচিত্র দেখে নিজেরাই ঘুরে দেখা যায় কোন গাইডের সাহায্য ছাড়াই।
ভক্তপুরকে স্থানীয়রা খ্যোপা ( Khwopa) বলে। ইতিহাস বলে এই স্থান দ্বাদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত নেপালের রাজধানী ছিল। এই অঞ্চলের আয়ত ন ৬.৮৮ বর্গ কিলোমিটার এবং প্রায় ১ লাখ লোকের বসবাস। এখানকার জন সাধারণের পেশা হাতে বুনা নকশি কারুকাজ গহনা, বুনন, ব্যাবসা, চিত্রশিল্প, কুমার এবং সাধারণ চাকরি। তারা তাদের বংশ পরম্পরায় কাজের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।
এখানে আছে অসংখ্য মন্দির, প্যাগোডা, স্টুপা, সিটি গেট, টেরাকোটা টেম্পল, পুরাতন বাড়ি, বুদ্ধিস্ট ধর্মাশলায়, শত বছর আগের পানির টানক, দরবার স্কয়ার, গোল্ডেন গেইট, টাওমাধি স্কয়ার, পটারী স্কয়ার এবং আরো অনেক নাম না জানা শত শত বছর আগের ঐতিহাসিক স্থাপনা।
দরবার স্কয়ার এবং টাওমাধি স্কয়ারকে সবচাইতে লোকপ্রসিদ্ধ মনে করা হয়। দরবার স্কয়ারের গোল্ডেন গেটের উপরে রাজা ভোপাতিন্দ্রা মাল্লার খোদাই করা পাথরের মূর্তি যা এত জীবন্ত যেন চোখ ফেরানো দায়। এই দরবারে আরও আছে ৫৫টি জানালা, ভাঁটসালা মন্দির, পশুপতিনাথ মন্দির, বিগ বেল যাতে আছে নান্দনিক কাঠের কারুকাজ। আছে পাথরের খোদাই করা স্থাপত্য।
টাওমাধি স্কয়ারের প্রধান বৈশিষ্ট এর ভবন নির্মাণশৈলীতে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং এর নান্দনিক অবকাঠামো যা দেখতে অনেকটা চতুষ্কোণ পিরামিডের মত এবং এর পাঁচটি ধাপ।এত আগে কিভাবে এই স্থাপত্য নির্মাণ করা হয়েছে এটা এক বিস্ময়। সিঁড়ির দুপাশে পাথরের খোদাই করা সিংহের মূর্তি। এখানে আছে কাঠের আর পাথরের ওপর কারুকাজ করা অসংখ্য স্থাপত্য নির্দশন।
পটারী স্কয়ার
মাটির তৈরি সারি সারি পাত্র, খেলনা, শো পিস উঠোনে শুকাতে দিচ্ছে। কেউবা লাল মাটির মন্ড মাখছে নতুন কিছু সৃষ্টিতে। কুমারের কাজ ভক্তপুরের মানুষের পূর্বপুরুষদের পেশা; যা তারা সযত্নে লালন করছেন।
ভক্তপুরের ভেতর কিছু হোটেল আছে যেখানে চাইলে রাতে থেকে যাওয়া যায়। আমরা তখন এই পরিকল্পনা করে নিলাম এরপর এলে অবশ্যই ভক্তপুরে দুদিন থাকব। জায়গাটা প্রাচীন সভ্যতার যুগে নিয়ে যায়। মুহূর্তেই মন চলে যায় সেই ইতিহাসের যুগে। ভক্তপুর পুরোটাই যেন এক ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন।
কাঠমান্ডু
আমরা ভক্তপুর থেকে হোটেল হায়াত প্লেসে পৌঁছালাম একঘণ্টায়। যাওয়ার পথে আমরা একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে দুপুরের খাবার খেলাম বাহাদুর ভাইকে নিয়ে। নেপালের খুব প্রচলিত বিখ্যাত খাবারকে তারা বলে থালি। এই থালিতে থাকে বাসমতি চালের সুগন্ধি ভাত আর চারপাশে থরে থরে সাজানো বিভিন্ন ব্যঞ্জন। আমরা ভেজ থালি নিয়েছি। ঢেঁড়স, করল্লা এত মচমচে করে ভেজে দেয়, যেন মনে হয় কুরকুরে চিপস, আছে ডাল মাখানি যা বিভিন্ন ডালের সঙ্গে কচু শাক দিয়ে রান্না, আলুর দম, পালং শাক, পাপড়, দই ও আচার। তারা ভাতের উপর সুগন্ধি খাঁটি ঘি ছিটিয়ে দেয়। এখানে ভাত, ঘি বা ডাল মাখানি রিফিল নেওয়া যায় চাইলেই। আমার কাছে থালি খেতে অমৃতসম লেগেছে।
হোটেল রুমের জানালা দিয়ে শম্ভুনাথ মন্দির দেখা যায়। আশেপাশেই আছে বিভিন্ন স্পা ও ম্যাসেজ ক্লিনিক।
একটা বিষয় আমাদের অবাক করেছে পাঁচতারা হোটেল অথচ আশেপাশে নেই কোন আলোকসজ্জা। তারা প্রয়োজনের বাইরে বাতি জ্বেলে রাখে না। আমরা রাত নয়টায় বাইরে হাঁটব বলে বের হবো ভাবছি। হোটেলের দরজার চারপাশে খুব নিরবতা দেখে পিছিয়ে এসে যখন রিসিপশনে জানতে চাইলাম, বাচ্চাদের নিয়ে কি বের হওয়া নিরাপদ। তারা অবাক হয়ে হেসে বলল, কোন সমস্যা নেই আপনারা নিশ্চিন্ত মনে ঘুরে আসুন। নেপাল আমার কাছে পর্যটকদের জন্য খুব নিরাপদ স্থান মনে হয়েছে।
কাঠমান্ডুতে আমার স্বামীর সহকর্মী ছিলেন সেই সময়, তিনি আমাদের তার বাড়িতে নেমন্তন্ন করলেন। তিনি থাকেন কীর্তিপুর। এটা একটা আবাসিক এলাকা। এলাকাটি সমতল থেকে বেশ উঁচু জায়গায়। এখানকার সব বাড়িই ডুপ্লেক্স বা ত্রিপ্লেক্স এবং যা একটি পরিবারের একান্ত আবাসস্থল। প্রতিটি বাড়ির সামনে ছোট উঠোন যেখানে নানা ফুল আর পাতাবাহারের সমাবেশ আরও আছে নাম না জানা ক্যাকটাস। নিচে বসার ঘর সঙ্গে ডাইনিং এবং রান্নাঘর। বাড়ির পেছনেও বাগান তবে সেখানে বিভিন্ন শাকসবজি শোভা পাচ্ছে। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই ওপরে শোবার ঘর। ছাদে সুন্দর দোলনা পাতা। প্রতিটি বাড়ির ছাদেই সোলার সিস্টেম আছে যা প্রতিটি বাড়ির পানি সাপ্লাই এবং বেসিক কিছু কানেকশন দেয়া। নেপালিরা বিদ্যুৎ ব্যবহারে খুব সাশ্রয়ী। তাদের বেশিরভাগ বাড়িতে এসি তো নয়ই অতিরিক্ত ফ্যান পর্যন্ত নেই। বাড়িগুলো দেখে আমার লন্ডন শহরের বাড়ির মতো মনে হয়েছে। সব বাড়ির ডিজাইন এক ধরনের। নেপালের এই এলাকাটি অনেক অভিজাত এবং ছবির মতো সাজানো।
শুরুতেই আমাদের নেপালের ঐতিহ্যবাহী রুটির সঙ্গে একপ্রকার সবজি যা কিনা আচার দিয়ে রান্না করা আর সঙ্গে পানীয় হিসেবে জুস দিয়ে আপ্যায়ন করা হলো। রুটি খুব মজার অনেকটা জিলেপীর মত, রিং রিং এবং খুব মচমচে। হালকা মিষ্টি স্বাদের তাই খেতে খুব সুস্বাদু। আমার শুধু খেতেই বেশি ভাল লাগছিল। যদিও নেপালিরা সেই আচারী সবজি দিয়েই খায়।
রাতে ডিনারে ছিল এলাহি কারবার। নেপালিরা খুব অতিথিপরায়ণ। তারা আমাদের মতো এত মশলা ব্যবহার করেনা। এমনকি মাংস রান্নায়ও কোন গরম মশলার ব্যবহার করে না। তারা কালোজিরা রাইস রান্না করে। বাসমতি চাল কে খুব হালকা ভাপে রেখেই নামিয়ে ঘি আর কালোজিরা ছিটিয়ে পরিবেশন করে। সাথে মুরগির ঝোল, কচু শাকের ডাল, মাছের কারি, পালং শাক, করলা ভাজি। আমরা যেমন সবজি দিয়ে চিংড়ি বা অন্য মাছ দিয়ে রান্না করি নেপালিরা কখনোই তা করে না। তারা সবজি খুব মচমচে করে ভেজে না হয় আধা সিদ্ধ খায়। সবার শেষে ডেজার্ট হিসেবে চিনির পায়েস ছিল সঙ্গে নেপালি মিষ্টি।
নেপালিরা আমের আচার খেতে খুব পছন্দ করে। বাড়ির ছাদ ভর্তি আম শুকোতে দেওয়া। আমার মনে হয়েছে এত আম এ দিয়ে অনায়েসে ৫০ বৈয়াম আচার করা যাবে। রাতে আমাদের তারা হোটেলে পৌঁছেও দিলেন। এত আন্তরিক এত অমায়িক একটা পরিবার আমাদের কাছে পুরো সময়টা খুব উপভোগ্য ছিল।
চন্দ্রাগিরি কেবল কার
কাঠমান্ডু থেকে চন্দ্রাগিরি যেতে গাড়িতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লেগে যায়। আমরা সকাল দশটায় পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। সেদিন ছিল বেশ আলো ঝলমলে; সোনালী ঝিকিমিকি রোদ্দুর চারদিকে। আমরা টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট নিলাম। সার্কভুক্ত দেশের পর্যটকদের জন্য ১২০০ নেপালি রুপি আর অন্য দেশের ক্ষেত্রে দামটা আরও বেশি।
কেবল কার প্রায় ২৫৫১ কি.মি. উচ্চতার উপর দিয়ে আপনাকে নিয়ে যাবে অপর প্রান্তে যেখানে আছে হোটেল, কার রাইডারদের জন্য বিশ্রামস্থল ও বাচ্চাদের জন্য খেলার পার্ক। ঝুলন্ত কেবল কারে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যেতে ১৫ মিনিটের মত সময় লাগে। একটা কেবল কারে ৮ জন বসতে পারে।
কেবল কার যখন প্রায় ৮০০০ ফুট উচ্চতায় উঠে যায় তখন আপনি বিমোহিত না হয়ে পারবেন না। চারদিকে সবুজ বনানী আর পাহাড়ের সারি। আকাশ পরিষ্কার থাকলে আপনি অনায়েসে কেবল কার থেকে হিমালয় সঙ্গে অন্নপূর্ণা ও এভারেস্টের চূড়া দেখতে পারবেন। এখানে চারপাশের শীতল বন্য ফুলের সুবাসিত স্নিগ্ধ বাতাসে নিশ্বাস নিলে অনায়েসে মন প্রফুল্লিত হয়। এ যেন চারদিকের দূষিত জঞ্জাল যান্ত্রিকতা থেকে কোন এক স্বর্গে পৌঁছে যাওয়া; চোখ বন্ধ করে অনুভবে প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে যাওয়া। মাঝে মাঝে মেঘ আপনাকে ছুঁয়ে যাবে। মেঘের ঠান্ডা শীতলতা আপনার চোখে মুখে দোলা দিয়ে যাবে। যারা একটু শীতকাতর তাদের কেবল কার ভ্রমণে শীতবস্ত্র পরিধান করতে হবে। কেবল কারের পথের দৈর্ঘ্য প্রায় ২.৫ কি.মি.।
কাঠমান্ডু থামেল মার্কেট পর্যটকদের কাছে খুব জনপ্রিয়। রাস্তার দুপাশে ছোট ছোট দোকানে আপনি পাবেন বাহারি হাতের নকশা করা ব্যাগ, পশমিনা চাদর, কুশন কাভার, বিছানার চাদর, মিহি সিল্ক বুননের রঙ বেরঙ কুর্তি এবং উলের চাদর ও পুতুল। আছে ঘর সাজানোর নানা সরঞ্জাম, পিতল ও কাসার মূর্তি, পানির পাত্র, ফুলদানি ও অলংকার। তবে তারা প্রায় দ্বিগুণ দাম হাঁকায়; তাই আপনাকে কিছু কিনতে হলে একটু সময় নিয়ে দরদাম করে কিনতে হবে।
নেপালে যে পাঁচদিন আমরা ছিলাম, আমার বার বার একটা কথাই মনে হয়েছে আরও সময় নিয়ে আসা উচিত ছিল। যেন মনের আশ মেটে না।
লেখক : কথা সাহিত্যিক