বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ঢাকার লড়াই
বর্জ্যের ঠিকঠাক ব্যবস্থাপনা নগর কর্তাদের প্রতিদিনের লড়াই। এ কাজে নাগরিকদের সচেতনতার দিকেও তাকিয়ে থাকতে হয় তাদের। বর্জ্যের সবশেষ ঠিকানা গড়ার কাজে কতটা সফল শহর প্রশাসন?
সদ্যই শহর ঢাকায় হয়েছে বর্জ্য প্রদর্শনী। নাগরিকরা খালে কী কী ফেলে, তা উপস্থাপন করা হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)-র এ আয়োজনে। শো-পিস থেকে রিকশা, সোফা থেকে তোশক- নানা কিছু দেখা গেছে সেখানে।
নাগরিকদের ভুল ধরিয়ে দেওয়ার এই আয়োজন প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন রাজধানীর গুলশানের বাসিন্দা আজিম বখশ। তবে তিনি বলেন, ‘গুলশান লেকের পানিতে সব তরল বর্জ্য যাচ্ছে। দুর্গন্ধের কারণে এলাকার ঘর-বাড়ির দরজা-জানালা খোলা যায় না। এর জন্য তো নাগরিকরা দায়ী না।’ বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অনেক ঘাটতি রয়ে গেছে, দাবি করেন তিনি।
পুরান ঢাকায় বড় হওয়া আজিম বখশ আরো যোগ করলেন, ‘বর্জ্য একটা সময় পুরান ঢাকার সমস্যা ছিল। এখন পুরো ঢাকাই একটা বর্জ্যের শহর। যেখানে-সেখানে ময়লা না ফেলতে নাগরিক সচেতনতা যেমন দরকার, তেমনি অবকাঠামোগত উন্নয়নও দরকার। এ বিষয়ে ঢাকার দুই মেয়রকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।’
নিজেদের অধীনে থাকা ১৫টি খাল পরিচ্ছন্ন রাখতে কেবল নিয়মিত কাজ নিয়ে আছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। তবে ঢাকা উত্তর তথা ডিএনসিসি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিডি ক্লিনকে সঙ্গে নিয়ে খালের আবর্জনা অপসারণে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে, যার মাধ্যমে ঢাকা উত্তরের ২৯টি খাল থেকে এই বছর মে মাস পর্যন্ত দুই লাখ ৫৮ হাজার ১৬৫ টন ভাসমান বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে।
অভিযানের সময় খালে পাওয়া বর্জ্য নিয়ে মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘খাল ও ড্রেন দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ার কথা। সেখানে যদি পলিব্যাগ, বোতল, তোশক, কমোড, রিকশা, টেলিভিশন, টায়ার, ফ্রিজ ফেলা হয়, তাহলে অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা তৈরি হবে। কোরবানির সময় নাগরিকরা সচেতন হয় বলে, সঙ্গে সঙ্গে পুরো শহরটা পরিষ্কার করা সম্ভব হয়।’
ঢাকা উত্তরের মেয়র আরো যোগ করলেন, ‘নাগরিকদের সচেতন করতেই বর্জ্য প্রদর্শনীর আয়োজন। নগর ভবনে এটা শুরু হয়েছে। এরপর অঞ্চলে অঞ্চলে প্রদর্শনী হবে। স্কুলের বাচ্চাদের এগুলো দেখানো হবে। মানুষ সচেতন হলেই শহর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবে।’
জনসচেতনতার ঘাটতি মেটাবে ‘দণ্ড’
ঢাকা শহর থেকে উঠে-গেছে পাড়া-মহল্লার ছোট ছোট ডাস্টবিন। কারণ, সেগুলোয় ময়লা না ফেলে নগরবাসী তা ফেলতো পাশের রাস্তায়। এ নিয়ে নানা প্রচারণা চালিয়েও জনসচেতনতা তৈরি সম্ভব হয়নি। তাই ছোট ডাস্টবিন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর বদলে ঢাকার দুই নগর প্রশাসনই বাসস্থান থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করছে বেসরকারি সংস্থার সহায়তায়। কর্মীরা নাগরিকদের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে বাঁশি বাজিয়ে ময়লা রাখে রিকশাভ্যানে। তারপর তা দিয়ে আসে সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস)-এ।
নগর প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ঢাকা উত্তরের ৫৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৭টিতে আছে এসটিএস। আর দক্ষিণ সিটির ৭৫টি ওয়ার্ডের ৬১টিতে এসটিএস নির্মিত হয়েছে। স্থায়ী এই অবকাঠামো আকারে যথেষ্ট বড়। এর ভেতরে একাধিক কনটেইনার ডাস্টবিন রাখা যায়। তাই এলাকার রাস্তাঘাটে সেভাবে আর রাখতে হচ্ছে না কনটেইনার ডাস্টবিন। এভাবে বাসার আবর্জনা রাস্তায় পড়ে থাকার বিষয়টি কমে আসছে। এগুলো চলে যাচ্ছে মাতুয়াইল ও আমিনবাজারের দুই ল্যান্ডফিলে।
কিন্তু নর্দমা ও খালে কঠিন বর্জ্য ফেলার প্রবণতা এখনো কমেনি। ঢাকা উত্তরের বর্জ্য প্রদর্শনীই তার প্রমাণ। ফলে জনসচেতনতামূলক প্রচারের পাশাপাশি অসচেতন নাগরিকদের হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন ঢাকা উত্তরের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। কখনো তাদের বাড়ির সামনে বর্জ্যের স্তূপ করার ঘোষণা দিচ্ছেন তিনি। কখনো আবার কলাগাছ গেঁথে তাদের বাড়ির পয়োবর্জ্য চলাচল বন্ধ করার কথা বলছেন।
তবে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালায় (২০২১) যেখানে-সেখানে ময়লা ফেললে দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এতে উল্লেখ আছে, নির্ধারিত স্থানের বাইরে বর্জ্য ফেললে দুই বছরের কারাদণ্ড বা দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেয়া যাবে।
পরিচ্ছন্ন নগর নিশ্চিতে আইন প্রয়োগ জরুরি বলে মনে করেন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-র সম্পাদক সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নাগরিকদের সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ- এগুলো না হলে নগরকে পরিস্কার করা যাবে না। শুধু সচেতনতা নয়, জরিমানা ও শাস্তিও দরকার। সিঙ্গাপুরে একটি চুইংগাম ফেললে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ এসে জরিমানা করে। বাংলাদেশেও এমন ব্যবস্থা দরকার। জরিমানা নাগরিক সচেতনতামূলক প্রচারেরই অংশ।''
এখন শুধু শহর নয়, গ্রাম পর্যায়েও বর্জ্য তৈরি হচ্ছে- এ প্রসঙ্গে সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন বলেন, ‘‘বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় সরকারকে ক্ষমতা দিতে হবে। নাগরিকরা যাতে তাদের নির্দেশনা মেনে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করে, সেটা না করলে জরিমানা বা শাস্তির আওতায় আনার ক্ষমতা তৃণমূল স্তরে দিতে হবে।''
বর্জ্য থেকে সম্পদ: উদ্যোগ কত দূর?
এই ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় সংসদে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘‘দেশের ১২টি সিটি কর্পোরেশন এলাকায় প্রতিদিন ১৭ হাজার টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়, যেখানে ঢাকা দক্ষিণে দৈনিক উৎপাদিত বর্জ্য তিন হাজার ২১৩ টন, আর উত্তরে তিন হাজার ৪০০ থেকে ৬০০ টন।''
সেই সময় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সংসদে আরো জানান, ঢাকা উত্তরের বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এরই মধ্যে উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ, যাতে অর্থায়ন করছে চায়না মেশিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন। এর আওতায় আমিন বাজার ল্যান্ডফিলে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। ঢাকা দক্ষিণের এমন ছয়টি প্রস্তাব যাচাই করা হচ্ছে- সংসদে বলেন মন্ত্রী।
বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে ডিএসসিসির উপপ্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহাব উদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা অবশ্যই হবে। উদ্যোগটি প্রক্রিয়াধীন আছে। বাস্তবায়নে আরো সময় লাগবে।''
এদিকে ঢাকা দক্ষিণের মাতুয়াইল ও উত্তরের আমিনবাজার- দুটি ল্যান্ডফিলের ধারণক্ষমতাই শেষের পথে, বলছেন খোদ নগর প্রশাসনের কর্মকর্তারাই। তবে এ দুটি সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তরের কর্মসূচিও থাকছে।
এ নিয়ে ডিএসসিসির উপপ্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহাব উদ্দিন বললেন, মাতুয়াইল ল্যান্ডফিল আধুনিকায়ন করা হচ্ছে, যার ফলে বর্জ্য আর বর্জ্য থাকবে না, রিসাইক্লিং করা হবে। এতে ল্যান্ডফিলে জায়গাও কম লাগবে বলে মনে করেন তিনি।
মন্তব্য করুন