সাদিক এগ্রোর ‘ব্রাহমা কেলেঙ্কারি’ তদন্তে এবার বিমানবন্দর কাস্টমসে দুদক
জব্দ হওয়ার পরও আমদানি করা ১৮টি আমেরিকান ব্রাহমা গরু কীভাবে সাদিক এগ্রোতে নিয়ে গেলেন প্রতিষ্ঠানটির স্বত্ত্বাধিকারী মো. ইমরান হোসেন, তা তদন্তে এবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাস্টমসে অভিযান পরিচালনা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
মঙ্গলবার (২ জুলাই) দুপুরে এই অভিযান শুরু হয়। এর আগে গতকাল আলোচিত ‘ব্রাহমা কেলেঙ্কারি’তে ইমরান হোসেনের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগে ঢাকার সাভারের কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামারে বিশেষ অভিযান চালায় কমিশন। অভিযানে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র হাতে আসে দুদকের। আমদানি নিষিদ্ধ বিশালাকার গরুগুলো দেশে আনার ক্ষেত্রে সাদিক এগ্রো ও এর স্বত্ত্বাধিকারী ইমরানের দরপত্র জালিয়াতিসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখছে সংস্থাটি।
সম্প্রতি সাদিক এগ্রো থেকে ১৫ লাখ টাকা দাম হাঁকানো বিটল জাতের একটি ছাগল ১২ লাখ টাকায় কিনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি করেন মুশফিকুর রহমান ইফাত নামে এক তরুণ। পরে এ ঘটনাটি সংবাদ আকারে গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলে সামনে চলে আসে তার বাবা মতিউর রহমানের নাম, যিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একজন উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন উঠে যায়, একজন সরকারি আমলা হয়ে কীভাবে তার ছেলে বিলাসবহুল সব শখ পূরণ করেন। এরপর একে একে খোঁজ মিলতে থাকে এনবিআরের এ কর্মকর্তার অবৈধ পন্থায় অর্জিত অঢেল সম্পদের। জোরেশোরে তদন্ত শুরু করে দুদক। এরই মধ্যে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয় সাদিক এগ্রোর স্বত্ত্বাধিকারী ইমরান হোসেন এবং তার উচ্চবংশীয় পশুর খামার নিয়েও। পরবর্তীতে সামনে চলে আসে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে গরু আমদানি করে ইমরানের এগ্রো ব্যবসার ব্যাপারটিও। ফলশ্রুতিতে মতিউর রহমানের পাশাপাশি ইমরান হোসেনের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে নামে দুদক।
গতকাল সাভারের কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামারে অভিযান চলাকালে দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ জানান, ২০২১ সালে ১৮টি আমেরিকান ব্রাহামা জাতের গরু বাংলাদেশে এনে তোলপাড় সৃষ্টি করেন ইমরান হোসেন। কিন্তু ব্রাহমা জাতের গরু আমদানি নিষিদ্ধ থাকায় সেগুলো বাজেয়াপ্ত করে ঢাকা কাস্টমস।
করোনা মহামারির বিধিনিষেধের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা ব্রাহমা জাতের গরুগুলো বিমানবন্দরে ধরা পড়লে সেসময় গ্রহণ করতে যাননি কেউ। পরে জানা যায়, ওই গরুগুলোর আমদানিকারক সাদিক এগ্রো লিমিটেড। তারা কাগজপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে শাহিওয়াল গরুর নাম দিয়ে ব্রাহমা আমদানি করেছিল। আর এটা করা হয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের জাল কাগজপত্র ব্যবহার করে।
জব্দ গরুগুলো প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মাধ্যমে সাভারের কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামারে রাখা হয়। পরবর্তীতে রহস্যজনকভাবে গরুগুলো চলে যায় ইমরানের সাদিক এগ্রোতে। কিন্তু কোন প্রক্রিয়ায় সরকারের এই প্রতিষ্ঠান থেকে নিষিদ্ধ ব্রাহমা জাতের গরুগুলো সাদিক এগ্রোকে দেওয়া হয়েছে, সেসবসহ অন্যান্য বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছে দুদক।
আগের দিন কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামারের পরিচালক ডা. মনিরুল ইসলাম জানান, বাজেয়াপ্ত হওয়ার পর মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কয়েকজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে মাংস বিক্রির শর্তে ব্রাহমা জাতের গরুগুলোকে কৌশলে নিলামে তুলে সাদিক এগ্রোতে নিয়ে যান ইমরান। নিলামে বিক্রি হওয়া গরুগুলো জবাই করে সেই মাংস ঈদুল ফিতরের সময় সুলভ মূল্যে বিক্রির কথা থাকলেও তা করেনি তিনি। পরিবর্তে কম দামী গরুর মাংস বিক্রি করেন এবং ব্রাহমা জাতের সেই গরুগুলো উচ্চ বংশের গরু বলে কোটি টাকা দাম হাঁকেন।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, জাতীয় প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন নীতিমালার আলোকে যেসব গরুর জাত পালনের অনুমতি আছে, সেখানে ব্রাহমা জাতের কোনো অনুমোদন নেই। ফলে এই জাত পালনের কোনো অনুমোদন আমরা দিইনি। কিন্তু অবৈধভাবে আনা ব্রাহমা গরুগুলো ছিল প্রজনন অনুপযোগী। ফলে নিয়ম অনুসারে এসব প্রজনন অনুপযোগী গরু খামারিদের সংগঠনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কোনো ব্যক্তিকে দেওয়া হয়নি। কিন্তু ইমরান কৌশলে এসব গরু নিজের নামে নিয়ে নিয়েছেন। তার ওপর শর্তানুযায়ী এসব গরুর মাংস বিক্রি না করে কোরবানীর পশু হিসেবে বাজারেও বিক্রি করেছেন। ২০২৩ ও ২০২৪ সালের প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনীতে প্রকাশ্যে ইমরান এই ব্রাহমা জাতীয় নিষিদ্ধ গরু উঠিয়েছিলেন।
মন্তব্য করুন