• ঢাকা রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১
logo

প্রশ্নফাঁস: পুরনো পরীক্ষা বা নিয়োগ কি বাতিল হবে?

আরটিভি নিউজ

  ১২ জুলাই ২০২৪, ০৪:৪০
ফাইল ছবি

দেশে সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ নতুন নয়। সব জায়গাতে প্রশ্নফাঁস হলেও চাকরি প্রত্যাশীদের আস্থা ও ভরসার জায়গা ছিল বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (বিপিএসসি)। কিন্তু সম্প্রতি পিএসসির অধীনে হওয়া বিসিএসসহ অন্তত ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের ঘটনা সামনে আসায় চাকরি প্রত্যাশীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন।

আইন অনুযায়ী কোনো নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হলেও সেটি বাতিল বলে ঘোষণা করার সুনির্দিষ্ট কোনও নিয়ম নেই। এর আগে বেশ কয়েকবার সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল করে পুনরায় সেই পরীক্ষা আয়োজন করা হয়েছে। তবে সেটি করা হয়েছে ‘নীতিগত জায়গা’ থেকে।

সবশেষ গত পাঁচই জুলাই পিএসসির অধীনে অনুষ্ঠিত রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ ‘উপ-সহকারী প্রকৌশলী’ পদের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হয়েছে। গত ১২ বছর ধরে পিএসসির অধীনে হওয়া বিসিএসসহ অন্তত ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হয়েছে। সংবাদটি প্রকাশ হওয়ার পর থেকে এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের আলাপ-আলোচনা দেখা গেছে। অনেকেই বলছেন, যেসব নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, সেগুলোকে বাতিল করা হোক।

এ বিষয়ে পিএসসি জানিয়েছে, রেলওয়ের সর্বশেষ নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি প্রমাণিত হলে সেটি বাতিল করা হবে। তবে পূর্বের পরীক্ষাগুলো নিয়ে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

গত ৫ জুলাই রেলওয়ের ‘উপ-সহকারী প্রকৌশলী’ পদে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর গত ৭ জুলাই পিএসসি পরিচালিত নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস বিষয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রচার করে বেসরকারি টেলিভিশন। প্রতিবেদনে বলা হয়, পিএসসির বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি সিন্ডিকেট রেলওয়ের ওই পরীক্ষাসহ গত ১২ বছরে ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস করেছে। খবর প্রকাশের পরদিন প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে পিএসসি’র সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী ও পিএসসির তিন কর্মকর্তাসহ ১৭ জনকে আটক করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে ২৪তম বিসিএস, ২৭তম বিসিএস। এছাড়া প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে ৩৩-তম লিখিত পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছিলো। বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাড়াও আরও অনেক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের খবর বিভিন্ন সময়ে আসতে দেখা যায়। এমনকি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাও এসব অভিযোগ থেকে বাদ যায়নি।

এদিকে গত ৮ই জুলাই একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি অস্বীকার করে পিএসসি। বিজ্ঞপ্তিতে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, গত ১২ বছরে বিপিএসসিতে অনুষ্ঠিত বিসিএস ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষা সম্পর্কে কোনও মহল থেকে কখনোই কোনও ধরনের অভিযোগ বা অনুযোগ ছিল না বলে এটি প্রমাণিত যে, ওইসব পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়েছে, প্রশ্নফাঁস রোধ করতে প্রতিটি বিসিএস পরীক্ষায় ন্যূনতম ছয় সেট প্রশ্নপত্র এবং নন-ক্যাডার পরীক্ষায় ন্যূনতম চার সেট প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হয়। কোন সেটে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে, তা নির্ধারণ করতে পরীক্ষা শুরুর ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট পূর্বে লটারি করা হয়।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রসঙ্গে গত ৯ জুলাই আগারগাঁও কর্ম কমিশন ভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পিএসসি চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন। তিনি বলেন, প্রশ্নপফাঁস করা ভীষণ কঠিন। কারণ, যে প্রক্রিয়ায় প্রশ্ন নির্ধারণ ও সাপ্লাই করা হয়, সেখানে প্রশ্নফাঁসের কোনো সুযোগ নেই। তবে এ কার্যক্রমের সাথে যেহেতু অনেকেই জড়িত থাকেন, তাই শতভাগ নিশ্চিতভাবেও বলা যায় না।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, গত ১২ বছর ধরে যেসব পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে, সেগুলোর ব্যাপারে “কতটা কী হবে,” তা তিনি বুঝতে পারছেন না।

তিনি আরও বলেছিলেন, যখনই কোনও পরীক্ষা হয়, তখন সেখানে কোনও অনিয়ম হলে আপনাদের (সাংবাদিক) মাধ্যমে হোক বা পরীক্ষার্থীদের মাধ্যমে হোক, বা বিভিন্নভাবে (অভিযোগ) আসে। ১২ বছর আগের পরীক্ষা নিয়ে এতদিন পরে প্রমাণ কীভাবে হবে?

তবে পিএসসি তাদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি অস্বীকার করলেও এসকল অভিযোগ তদন্ত করার জন্য গত ৯ জুলাই তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। ১৫ কার্যদিবসের প্রতিবেদন জমা দেবে তদন্ত কমিটি।

এদিকে যে ৩০টি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ এসেছে, সেগুলোর ব্যাপারে পিএসসির চেয়ারম্যানের সাথে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু আপাতত তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। তার দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, যেহেতু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও পিএসসি, উভয় সংস্থাই এ বিষয়ে তদন্ত করছে, তাই তদন্ত রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে নতুন কোনও মন্তব্য করবেন না তিনি।

পিএসসি’র সাবেক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে আইনজীবী, সকলেই বলছেন যে নিয়োগ হওয়ার আগ অবধি পরীক্ষা বাতিল করা গেলেও নিয়োগ বাতিল করা অসম্ভব ব্যাপার।

এ প্রসঙ্গে সাবেক শিক্ষাসচিব মো. নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‌‘নিয়োগ পুরোপুরি বাতিল করলে আরেকটা জটিলতা হবে। ইতোপূর্বে যেসব নিয়োগ হয়েছে, সেগুলো বাতিল করার এখতিয়ার পিএসসির নাই। তবে দোষীকে আইনের আওতায় আনা যাবে। পুরনো সব পরীক্ষা যদি বাতিলও করা হয় তবে তা হাইকোর্টে টিকবে না।

সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খানও প্রায় একই মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, যেগুলো অনেক আগে নিয়োগ হয়ে গেছে, সেগুলো বাতিল করার সুযোগ নাই।

‘পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইন ১৯৮০’ থেকে দেখা যায় যে প্রশ্ন ফাঁস হলে পরীক্ষা বাতিল করতে হবে কি না, এ বিষয়ে সেখানে সুনির্দিষ্ট কিছু বলা নেই।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘আইনে সুনির্দিষ্টভাবে সেরকম কিছু বলা না থাকলেও এটি জেনারেল কনসিকুয়েন্সেস। যদি প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় ও তা যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে তো পরীক্ষা বাতিল হওয়া ছাড়া আর কোনও বিকল্প নেই।’

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘যে আইনে সুর্নির্দিষ্টভাবে এ বিষয়ে কিছু বলা না হলেও প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে পরীক্ষা বাতিল করে দিতে পারবে পিএসসি। সেই ক্ষমতা পিএসসির আছে। তবে পিএসসিকে সেটি প্রমাণ করতে হবে। এর আগে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন ফাঁসের কারণে পরীক্ষা বাতিল করেছিলো পিএসসি।’

তিনি বলেন, ‘আইনে যাই থাক, কিন্তু যদি শোনা যায় যে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, তাহলে প্রশাসনিক দিক থেকেই তো সেই পরীক্ষা বাতিল করা উচিৎ।

তিনি আরও বলেন, ‘এক যোগে পুরো নিয়োগ বাতিল করা সম্ভব না। আগে চিহ্নিত করতে হবে যে কে ফাঁস করলো ও ফাঁসের পরীক্ষায় কে পাশ করলো। এটা তদন্ত ছাড়া সম্ভব না। তদন্ত হলেও আইনগত অনেক জটিলতা আছে। এটা কঠিন।’

আবেদ আলী’র স্বীকারোক্তি ব্যাপারে খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘সেটি যাচাই করতে হবে যে তিনি স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন কি না বা সঠিক বলছেন কি না। তার স্বীকারোক্তির ওপর ভিত্তি করে মন্তব্য করা যাবে না।’

সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, ‘যে আইনে না থাকলেও যেকোনও পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে নৈতিকতার মানদণ্ড অনুযায়ী ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে তা বাতিল করতে হবে। ১০-১৫ বছর আগের পরীক্ষা বাতিলের কোনও সুযোগ এখন নাই। রিক্রুট্মেন্ট হয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে পরিপূর্ণ তদন্ত করে বের করতে হবে যে বেনিফিশিয়ারি কারা।’

তিনি আরও বলেন, ‘যারা বেনিফিশিয়ারি, অর্থাৎ যারা প্রশ্নপত্র ফাঁসের সুযোগ নিয়েছেন এবং প্রশ্ন কিনে উত্তর মুখস্থ করে পরীক্ষা দিয়েছেন, তাদেরকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করতে হবে এবং তারা যাতে অন্য কোনও সরকারি চাকরির জন্যও বিবেচিত না হয়, সেটি নিশ্চিত করা উচিৎ।’

প্রশ্নফাঁসে সাজার বিষয়ে খুরশিদ আলম বলেন, ‘১৯৮০ সালের পাবলিক পরীক্ষা আইনে পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে প্রশ্নপত্রের প্রকাশনা ও বিতরণ সম্বন্ধে উল্লেখ আছে যে কেউ যদি পরীক্ষার আগে কোনও উপায়ে প্রশ্ন ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণ করেন, তাহলে তিনি চার বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড কিংবা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। তবে এই আইনে সাজা কম হলেও দুদকের আইনে প্রশ্নফাঁসের সাজা সাত বছর ‘

এ বিষয়ে সাবেক শিক্ষাসচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, ‘এটি বাংলাদেশের কমন চিত্র। কোর্টে গেলে কেউ হুমকি দেয়, সাক্ষী পাওয়া যায় না। তখন কোর্টের অর্ডারে এরা ফিরে আসে। তাই এদেরকে কেউ ঘাঁটায় না। আইনের এদিকটা আরও কঠোর হওয়া দরকার।’-বিবিসি।

মন্তব্য করুন

Radhuni
  • বাংলাদেশ এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
আশ্বাস না পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা চাকরিপ্রত্যাশীদের
চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ করার দাবিতে শাহবাগ অবরোধ
এইচএসসি পাসে নৌবাহিনীতে চাকরির সুযোগ
আকর্ষণীয় বেতনে টিআইবিতে চাকরির সুযোগ