গুলিতে নিহত আনসার সদস্য জুয়েল, খেলনা নিয়ে বাবার ফেরার অপেক্ষায় ছেলে
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সাম্প্রতিক সংঘর্ষে শুক্রবার (১৯ জুলাই) রাতে ফকিরাপুল এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন আনসার সদস্য জুয়েল। ডিউটি শেষে সহকর্মীদের সঙ্গে মতিঝিল থানায় আসছিলেন তিনি। পথে একদল নাশকতাকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ চলছিল, এমন সময় তার শরীরে গুলি লাগে। দ্রুত তাকে তার সহকর্মীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
শনিবার (২০ জুলাই) পরিবারের সদস্যদের খবর দিলে তার মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। রাতেই জানাজা শেষে পার আশাপুর কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন করা হয়।
নিহত জুয়েল শেখ ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার মেগচামী ইউনিয়নের পার আশাপুর গ্রামের মৃত আকিদুল শেখের ছেলে। তিনি ২০২১ সালের ২২ ডিসেম্বর অঙ্গীভূত আনসার সদস্য হিসেবে ডিএমপিতে যোগদান করেন তিনি। মতিঝিল থানায় অঙ্গীভূত আনসার সদস্য হিসেবে কর্মরত ছিলেন জুয়েল শেখ।
আনসার সদস্য জুয়েল শেখের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে চলছে শোকের মাতম। একমাত্র উপার্জনক্ষম জুয়েলকে হারিয়ে দিশেহারা পরিবারের সদস্যরা। হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে পরিবারের সদস্যরা ও স্থানীয় এলাকাবাসী।
ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ মা নাজমা বেগম। কান্নাজড়িত কণ্ঠে নাজমা বেগম জানান, জুয়েলের বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন বাবা আকিদুল শেখ মারা যান। অনেক কষ্ট করে ছেলেকে মানুষ করেন তিনি। পড়ালেখা শিখিয়ে আনসার ট্রেনিং শেষে ২০২১ সালের ২২ ডিসেম্বর অঙ্গীভূত আনসার সদস্য হিসেবে ডিএমপিতে যোগ দেন।
তিনি বলেন, জুয়েলের বাবা মারা যাওয়ার পর অনেক কষ্ট করে ওকে বড় করেছি। অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালিয়েছি। জুয়েল চাকরিতে যোগদানের পর সংসারটা ভালোই চলছিল। এখন সব শেষ হয়ে গেলো আমার। জীবনে শুধুই কষ্ট পেলাম, সুখ পেলাম না। জুয়েলের হত্যাকারীদের বিচারের দাবি জানান তিনি।
২০১৭ সালে জুয়েল শেখ ভালোবেসে বিয়ে করেন পাশ্ববর্তী এলাকার শ্রাবণী খাতুনকে। ভালোবাসার মানুষটির অকাল মৃত্যুতে পাগলপ্রায় শ্রাবণী। তিনি বলেন, জুয়েল খুব ভালো মানুষ ছিল। মারা যাওয়ার আগে বিকেলের দিকে আমার সঙ্গে মোবাইলে কথা হয়েছিল। আমার ও ছেলের খোঁজ নিয়েছিল। ছেলে কি করছে, আমি কি করছি। কথা বলতে বলতে বলল রাতে বাসায় গিয়ে কথা হবে। এটাই ছিল শেষ কথা। পরে রাতে সংবাদ পাই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। পরদিন গিয়ে দেখতে পাই হাসপাতালের মর্গে মরদেহ পড়ে রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ছেলে কিছুই বুঝতে পারছে না। ও ভাবছে বাবা তার জন্য খেলনা নিয়ে আসবে। আমাদের এতিম করে চলে গেলো জুয়েল। আমার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। চাকরি পাওয়ার পর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম, কিন্তু আমার স্বপ্ন এতো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে ভাবিনি। ছোট্ট শিশু সন্তান, শাশুড়ি, দাদা শ্বশুর ও দাদী শাশুড়ি নিয়ে কিভাবে বাঁচবো। জুয়েলই ছিল একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
এদিকে, জুয়েল শেখের পাঁচ বছর বয়সী ছেলে আবু ফুরাইরা জানে তার বাবা চাকরি করতে গেছেন ঢাকায়। সে অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করছে, কেউ ডাকলে দৌড়ে তার কাছে ছুটে যাচ্ছে। অপেক্ষায় রয়েছে বাবা তার জন্য খেলনা নিয়ে বাড়িতে আসবেন। কিন্তু সে জানে না তার বাবা আর কখনও খেলনা নিয়ে আসবে না, চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
আনসার ও ভিডিপি’র ফরিদপুরের জেলা কমান্ড্যান্ট নাদিরা ইয়াসমিন জানান, নিহত আনসার সদস্য জুয়েল শেখের পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা করা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আর্থিক সহযোগিতা করা হয়েছে। ডিএমপি, ডিএমএ ও আনসারের পক্ষ থেকেও আর্থিক সহযোগিতা করা হবে। এছাড়া জুয়েলের স্ত্রীকে যোগ্যতা অনুসারে চাকরির ব্যাবস্থাও করা হবে বলেও জানান তিনি।
মন্তব্য করুন