দিনভর সহিংসতায় সারাদেশে নিহত ৯৮
সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচি ঘিরে উত্তাল হয়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ। ব্যাপক সংঘর্ষ ও হানাহানির ঘটনা ঘটেছে রোববার (৪ জুলাই) দিনভর। সরকার-সমর্থক নেতাকর্মী ও পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে রাজধানী ঢাকাসহ ২০টি জেলা-মহানগরে এ পর্যন্ত ৯৮ জন নিহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে ১৩ জন পুলিশ সদস্যকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে আন্দোলনকারীরা। এছাড়া কুমিল্লার ইলিয়টগঞ্জ হাইওয়ে থানায়ও হামলা চালিয়ে একই কায়দায় হত্যা করা হয়েছে মো: এরশাদ আলী নামে আরও এক পুলিশ সদস্যকে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচি ঘিরে দেশের অন্তত ৫০টি জেলায় সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনা, এমনকি সরকারি দলের মন্ত্রী-এমপিদের বাসাবাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব সংঘর্ষে ব্যাপক প্রাণহানির পাশাপাশি আহতও হয়েছেন শত শত।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা অসহযোগ আন্দোলন ঘিরে রোববার সারাদেশ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন ছিল রাজধানী ঢাকা। দূরপাল্লার বাস, ট্রেন সব বন্ধ ছিল। দিনভর সংঘর্ষের পর সন্ধ্যা ছয়টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কারফিউ জারি করে সরকার। অবশ্য কারফিউর মধ্যেও রাত ১০টা পর্যন্ত কোথাও কোথাও সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে।
অসহযোগ আন্দোলন মোকাবিলায় রোববার সকাল থেকে জেলা ও মহানগরে পাড়ায় পাড়ায় অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলো। সে অনুযায়ী শনিবার রাত থেকেই মাঠে নামার প্রস্তুতি নেন সরকারি দলের নেতাকর্মীরা। রোববার সকালের দিকে পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় আসতে শুরু করেন আন্দোলনকারীরা। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় এক দফা দাবিতে মিছিল নিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন হাজার হাজার মানুষ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারি দলের নেতাকর্মীরা তাদের ঠেকাতে গেলেই শুরু হয়ে যায় সংঘর্ষ।
এরপর দিনভর রাজধানী ঢাকা ছিল বিক্ষোভ আর সংঘর্ষের নগরী। যাত্রাবাড়ী, উত্তরা-আজমপুর, ধানমন্ডি, শাহবাগ, সায়েন্স ল্যাব, জিগাতলা, কারওয়ান বাজার, মিরপুর, গুলিস্তান, লক্ষ্মীবাজার, বাবুবাজার, রায়সাহেব বাজারসহ বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সন্ধ্যায় বিক্ষোভকারীদের কেন্দ্রে পরিণত হয় শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। সকাল থেকেই শাহবাগ মোড় বিক্ষোভকারীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। সন্ধ্যার পর পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষে ১১ জনের মৃত্যু হয়।
ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা শহরের চিত্রও ছিল ভয়াবহ। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সংঘর্ষে সিরাজগঞ্জে পুলিশের ১৩ সদস্যসহ ২২ জন, ফেনীতে ৮, লক্ষ্মীপুরে ৮, নরসিংদীতে ৬, সিলেটে ৫, কিশোরগঞ্জে ৫, বগুড়ায় ৫, মাগুরায় ৪, রংপুরে ৪, পাবনায় ৩, মুন্সিগঞ্জে ৩, কুমিল্লায় পুলিশের সদস্যসহ ৩, শেরপুরে ২, জয়পুরহাটে ২, ভোলায় ১, হবিগঞ্জে ১, ঢাকার কেরানীগঞ্জে ১, সাভারে ১, বরিশালে ১ জন, কক্সবাজারে ১, গাজীপুরের শ্রীপুরে ১ জনসহ ৯৮ জন নিহত হয়েছেন।
নিহত ৯৮ জনের মধ্যে বিস্তারিত নাম-পরিচয় জানা গেছে ৪৩ জনের। তাদের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ জন, পুলিশের ১৪ জন, শিক্ষার্থী ৯ জন, সাংবাদিক ১ জন ও বিএনপির ১ জন আছেন। কয়েকজনের নাম ও পরিচয় জানা গেলেও পেশা বা রাজনৈতিক পরিচয় জানা যায়নি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি ঘিরে দেশের অন্তত ৩৮টি জেলায় জনপ্রতিনিধিদের বাসাবাড়ি, আওয়ামী লীগের কার্যালয় ও থানাসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে কমপক্ষে ১৩টি স্থানে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের নেতাদের বাসভবন ও নিজস্ব কার্যালয় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। চাঁদপুর শহরের জে এম সেনগুপ্ত রোডে সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনির বাসায়, বরিশালে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের বাসা, দিনাজপুরে জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিমের বাসভবনে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, খিলগাঁওসহ ১৫টি থানা, ১টি রেঞ্জ কার্যালয়, ৪টি জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় এবং ২টি পুলিশ ফাঁড়িতে সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়েছে বলে পুলিশ সদর দপ্তরের এক বার্তায় জানানো হয়। এসব ঘটনায় পুলিশের তিন শতাধিক সদস্য আহত হয়েছেন। অপর দিকে বিজিবি সদর দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, সারাদিনের সংঘাত-সংঘর্ষে বিজিবির অন্তত ৫৭ সদস্য আহত হয়েছেন।
মূলত, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত ১ জুলাই থেকে রাজপথে নামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষের পর বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। এর পরদিন থেকে এই আন্দোলন ঘিরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামলা, সংঘর্ষ, সহিংসতা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও হতাহতের ঘটনা ঘটে। মাঝে কয়েক দিন পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত ছিল।
একপর্যায়ে গত শনিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছাত্র-জনতার এক জমায়েত থেকে সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এই দাবিতে রোববার থেকে শুরু হয়েছে তাদের সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন।
এদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায় সোমবার (৫ আগস্ট) থেকে তিন দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, নির্বাহী আদেশে সোম, মঙ্গল ও বুধবার সাধারণ ছুটি থাকবে।
এর আগে, রোববার সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ঢাকা মহানগরসহ সব বিভাগীয় সদর, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, শিল্পাঞ্চল, জেলা সদর ও উপজেলা সদরে সান্ধ্য আইন (কারফিউ) জারি করেছে সরকার।
মন্তব্য করুন