কখন নির্বাচন চান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা
শিক্ষার্থীদের পক্ষে এই সরকারের প্রধান হিসেবে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। তিনি সম্মতিও দিয়েছেন বলে তার কার্যালয় ইউনূস সেন্টার নিশ্চিত করেছে।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের একজন বাকের মজুমদার বলেন, আমরা বলেছি, রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারের পরই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিতে হবে। ইতোমধ্যে আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাব করেছি। তিনি আমাদের সম্মতিও দিয়েছেন। আমরা চাই আগামীর বাংলাদেশটা হবে বৈষম্যহীন। আমাদের দাবি মেনে ইতোমধ্যে রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিয়েছেন। ফলে আলোচনায় বসেই সমাধান করা হবে।
শিক্ষার্থীদের সূত্রে জানা গেছে, ছাত্রদের পক্ষে যে সংস্কার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ হবে ৩ থেকে ৬ বছর। সরকারের মেয়াদ শেষের ৩ মাস আগে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রধান বিচারপতির অপসারণ বা পদত্যাগ এবং দলবাজ বিচারপতিদের অপসারণ। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন প্রধানদের অবসরে পাঠানো (তিন বাহিনী বাদে); নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন; সংবিধান সংশোধন করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা বাতিল; সরকারের সকল চুক্তিভিক্তিক নিয়োগ বাতিল; ছাত্র-নাগরিক হত্যায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত, নিহত ও আহত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান; জুলাই মাসকে জাতীয় শোকের মাস ঘোষণা; বিগত ১৫ বছরের দুর্নীতির সাথে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা, শ্বেতপত্র প্রকাশ এবং দুর্নীতি দমন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে।
বঙ্গভবনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মঙ্গলবার বলা হয়েছে,রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধান, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা,সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে সংসদ বিলুপ্ত করা হয়েছে। নির্বাহী আদেশে এই সংসদ বিলুপ্ত করা হলো। এর আগে, বেলা তিনটার মধ্যে সংসদ ভেঙে দেওয়ার আলটিমেটাম দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে এত আলোচনা হলেও এই মুহূর্তে দেশে নেই তিনি। ৮৪ বছর বয়সি এ অর্থনীতিবিদ অলিম্পিক কমিটির আমন্ত্রণে বিশেষ অতিথি হিসেবে প্যারিসে গিয়েছিলেন। তিনি এখনো ফ্রান্সের রাজধানীতেই অবস্থান করছেন। তবে দ্রুতই তিনি দেশে ফিরে আসবেন বলে জানা গেছে।
এদিকে মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) রাতে শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। রাষ্ট্রপতির প্রেসসচিব জয়নাল আবেদীন এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, বঙ্গভবনে আজ (মঙ্গলবার) রাতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কসহ সংশ্লিষ্টদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এর আগে, নোবেলজয়ী এই অধ্যাপককে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের রূপরেখা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। মঙ্গলবার ভোর ৪টার পর ফেসবুকে দেওয়া ভিডিও বার্তায় এ ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম।
ভিডিও বার্তায় নাহিদ বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের রূপরেখা দিতে আমরা ২৪ ঘণ্টা সময় নিয়েছিলাম৷ কিন্তু জরুরি পরিস্থিতি বিবেচনায় এখনই রূপরেখা ঘোষণা করছি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে ছাত্র-নাগরিক অভ্যুত্থানের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে। তার সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে, তিনি দায়িত্ব নিতে সম্মত হয়েছেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির কাছে অনুরোধ থাকবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হোক। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বাকি সদস্যদের নামও আমরা শিগগিরই ঘোষণা করবো। দ্রুতই সরকার গঠনের প্রক্রিয়া দেখতে চাই।
এখন আলোচনা চলছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন কখন ও কীভাবে হচ্ছে? কারা থাকছেন এ সরকারে? সংবিধানের মধ্যে থেকে কি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন সম্ভব? জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, সবকিছু হয়ত সম্ভব হবে না। কারণ এখনকার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিতে হবে। যদি কিছু সংবিধানের বাইরে যায়, সেগুলোও নতুন সরকার এসে সংবিধানের মাধ্যমে বৈধ করে নেবে। এর আগেও তো আমাদের এই ধরনের পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে, সমাধানও হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের আরেকজন আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, এখানে দুটো জিনিস দেখতে হবে। একটি হলো সংবিধান, অন্যটি হলো গণঅভ্যুত্থান। গণঅভ্যুত্থান কোনো আইন না। সংবিধানের কোথাও গণঅভ্যুত্থান নেই। সংবিধানে এরকম কিছু নাই। তবে গণঅভ্যুত্থানে যারা জয়লাভ করে, তাদের ইচ্ছা মতোই সবকিছু হবে। যে ইচ্ছা তারা করবে, সেটা আইনে যাওয়ার সুযোগ আছে। তবে বলা যাবে না যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে করলাম। গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ীরা করতে পারেন, সেটা পরে আইনে রেটিফাই করতে হবে। সেটি সংবিধান অনুযায়ী ফ্রম করতে হবে। সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর সরকার গঠন হবে। ১৯৯১ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর তিন জোটের রূপরেখার ভিত্তিতে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। তেমনিভাবেই এখন সারাদেশের ক্রিয়াশীল রাজনীতিবিদ তথা আমাদের অহংকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমাজের প্রতিনিধির মাধ্যমে ১৯৯১ সালের রূপরেখা অনুযায়ী, ওই কনসেনসাসের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হতে পারে।
তবে সংবিধানের মধ্য থেকেই সমাধান সম্ভব বলে মনে করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর তিন মাসের মধ্যে যদি নির্বাচন হয় তাহলে সংবিধানের কোন বরখেলাপ হবে না। তবে এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন করা না গেলে রাষ্ট্রপতি ও উচ্চ আদালত বরাবর নির্বাচন কমিশন একটা আবেদন দেবে। সেখানে কী কারণে তারা পারল না, সেটার ব্যাখা দেবে। আমাদের সময় ২০০৭ সালে যেটা হয়েছিল, আমরা আদালতে গিয়েছিলাম। আদালত আমাদের ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা তৈরি করাসহ কিছু কাজ দিয়েছিল, সে অনুযায়ী আমরা করেছিলাম। তখন আমরা আদালতকে বলেছিলাম, দুই বছর সময় লাগবে। আদালত সেই সময় দিয়েছিল। ফলে আমাদের কাছে একটা বৈধ কাগজ ছিল। যদিও সেটা পরের সংসদে ব়্যাটিফাই করে নিতে হবে।
অপরদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্রুত গঠন করার জন্য রাষ্ট্রপতির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। মঙ্গলবার গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকের পর তিনি এ আহ্বান জানান। মির্জা ফখরুল বলেন, আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই যে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নির্দলীয় সরকার গঠনের কাজ সমাধান করতে হবে। আমি রাষ্ট্রপতির কাছে আহ্বান জানাচ্ছি, কালবিলম্ব না করে আপনি অন্তর্বর্তীকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন করুন। অন্যথায় দেশে আবার রাজনৈতিক শূণ্যতা দেখা দিতে পারে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী ছাত্ররা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তবর্তীকালীন সরকার প্রধান হিসেবে চান, আপনারা সমর্থন করেন কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে আমাদের সমর্থন করার ব্যাপার না। এটা হচ্ছে যে, যখনই প্রেসিডেন্ট আমাদের কাছে প্রস্তাব দেবেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নামের জন্য আমরা সেই সময়ে রাষ্ট্রপতির কাছে নাম দেব। এখানে এখন কনস্টিটিউশনাল হেড অব স্টেট প্রেসিডেন্ট। উনি হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রধান। তারই একমাত্র এখতিয়ার আছে এই ধরনের ব্যবস্থাগুলো নেওয়ার। তবে ছাত্রদের প্রতি আমাদের সম্পূর্ণ আস্থা আছে, তাদের আন্দোলনের প্রতি একাত্মবোধ করেছি।
মন্তব্য করুন