গুম-খুনের মাস্টারমাইন্ড কে এই জিয়াউল আহসান
সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অব্যাহতি পাওয়া আলোচিত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ঢাকা কলেজের সামনে ছাত্র ও হকার নিহতের মামলায় ইন্ধনদাতা হিসেবে ৭ আগস্ট রাতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
শুক্রবার (১৬ আগস্ট) সিএমএম কোর্টে হাজির করা হলে আদালত তার আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নানা ব্যক্তিকে গুম-খুনের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে দেখা হয় জিয়াউল আহসানকে। এ ছাড়া আয়নাঘরের ‘জনক’, ফোনকলে আড়িপাতা, মানুষের ব্যক্তিগত আলাপ রেকর্ড ছাড়াও হেফাজতের ঘটনায় যৌথ অভিযানে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
যদিও গতকাল আদালতে আয়নাঘরের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান।
আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, গত ৭ আগস্ট রাতে আমাকে বাসা থেকে ডিজিএফআইয়ের (প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর) একটি দল নিয়ে আসে। ৮ দিন ধরে আমি আয়নাঘরে ছিলাম। আমি কোনো গুম-খুনের সাথে জড়িত নই।
সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা আরও বলেন, যেসব ব্যক্তি আয়নাঘর থেকে বের হয়ে আসছে, তাদের কেউ বলুক আমি তাদের সেখানে রেখেছি। যেভাবে আমাকে নিয়ে দোষারূপ করা হচ্ছে, সেটা সঠিক নয়। আমি অসুস্থ। হার্টে ব্লকসহ অন্যান্য সমস্যা রয়েছে।
ইসরায়েলি আড়িপাতার যন্ত্র পেগাসাস সফটওয়্যারের বিষয়ে আদালত জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন, পেগাসাস বলে কিছু নেই। কোনো মোবাইল ট্র্যাকিং করেননি বলেও দাবি করেন তিনি।
এর আগে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৬ আগস্ট মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে চাকরিচ্যুত করা হয়। পরে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাকে বিমানবন্দর থেকে আটক করা হয় বলে জানায় বিমান বন্দর সূত্র।
কে এই জিয়াউল আহসান
জিয়াউল আহসানের জন্ম ১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর, ঝলকাঠি জেলায়। ১৯৯১ সালের ২১ জুন তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে পদাতিক কর্মকর্তা হিসেবে কমিশন লাভ করেন। তিনি সেনাবাহিনীর একজন প্রশিক্ষিত কমান্ডো ও স্কাই ডাইভার।
জিয়াউল আহসান সেনবাহিনীর পাশাপাাশি র্যাব, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) সংস্থা, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারে (এনটিএমসি) দায়িত্ব পালন করেছেন। কর্মজীবনের বিগত এক দশকের বেশি সময় গুম, খুন ও ব্যক্তিগত ফোনকল আড়িপাতাসহ বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগে তিনি সমালোচিত হয়েছে। তবে তৎকালীন সরকারের আস্থাভাজন হওয়ায় ক্রমান্বয়ে পদোন্নতি পেয়ে মেজর থেকে মেজর জেনারেল হয়েছেন।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার এক বছরের মাথায় ২০০৯ সালে মেজর থাকাকালীন জিয়াউলকে র্যাব-২-এর ভাইস-ক্যাপ্টেন করা হয়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে ওই বছরের ২৭ আগস্ট র্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের (গোয়েন্দা শাখা) পরিচালকের দায়িত্ব পান তিনি। তিন বছরের ব্যবধানে ২০১৩ সালে জিয়াউল আহসান পদোন্নতি পেয়ে কর্নেল হয়ে যান এবং একই সময়ে তাকে র্যারের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আড়াই বছর পর ২০১৬ সালের এপ্রিলে পদোন্নতি পেয়ে বিগ্রেডিয়ার হয়ে গেলে তাকে এনএসআইতে (ইন্টারনাল অ্যাফেয়ার্স) পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
২০১৭ সালে জিয়াউলকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন এনটিএমসির পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০২২ সালের ২১ জুলাই এনটিএমসিতে মহাপরিচালক (ডিজি) পদ তৈরি করা হয় এবং জিয়াউলকে মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। তিনি এনটিএমসির প্রথম মহাপরিচালক হন। এই পদে থাকা অবস্থায় ৬ আগস্ট তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
আয়নাঘরের ‘জনক’
গোপন বন্দিশালা আয়নাঘর তৈরি করে সেখানে বিরোধী মতাবলম্বীদের তুলে নিয়ে বছরের পর বছর গুম করে রাখার অভিযোগ রয়েছে জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তার ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে করা আবেদনে পুলিশেরও দাবি, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জিয়াউল আহসান আয়নাঘর এবং ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের ওপর আক্রমণ ও হত্যার সঙ্গে থাকার কথা স্বীকার করেছেন। যদিও আদালতে শুনানির সময় এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জিয়াউল আহসান।
গুম-খুনের ‘মাস্টারমাইন্ড’
আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের শতাধিক নেতাকর্মী গুম-খুনের শিকার হন। এই তালিকায় ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম, সাজেদুল ইসলামসহ একাধিক হাইপ্রোফাইল নেতাও ছিলেন। অভিযোগ আছে, বিচারবহির্ভূত এসব হত্যাকাণ্ডের মিশন বাস্তবায়ন করেছেন পুলিশের এলিটে ফোর্স র্যাব।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল বিকাল ৩টার দিকে ইলিয়াস আলী সিলেট থেকে বিমানযোগে ঢাকা আসেন। ওইদিন রাতে হোটেল শেরাটন থেকে বাসায় ফেরার পথে তাকে গুম করা হয়। ইলিয়াস আলীর গুমের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন জিয়াউল আহসান। তিনি ওইদিন ইলিয়াস আলী যে ফ্লাইটে সিলেট থেকে ঢাকা এসেছিলেন, সেই ফ্লাইটেরই যাত্রী হয়ে তাকে অনুসরণ করছিলেন।
ইন্টারনেট শাটডাউনেও জড়িত ছিল জিয়াউল আহসান
কোটা সংস্কারের দাবি বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের ব্যানারে আন্দোলন চলাকালে গত ১৭ জুলাই থেকে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে ১৮ জুলাই থেকে ব্রডব্র্যান্ড ইন্টারনেট সেবাও বন্ধ করা হয়। পাঁচ দিন বন্ধ থাকার পর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু করা হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা যায়, তৎকালীন তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক ও মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান ডাটা সেন্টারগুলো বন্ধ করতে নির্দেশ দেন।
নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের নেপথ্যেও ছিল জিয়াউল আহসান
২০১৪ সালে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের ঘটনায় সম্পৃক্তার অভিযোগ উঠেছিল মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে। সেই সময় তিনি র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ছিলেন। ওই সময় হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করেন।
সূত্রের দাবি, জিয়াউল আহসান ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন; কিন্তু তৎকালীন সরকারের আস্থাভাজন হওয়ায় তিনি বেঁচে যান।
মানুষের ব্যক্তিগত ফোনালাপ রেকর্ড
এনটিএমসিতে দায়িত্ব পাওয়ার পর জিয়াউল আহসান সরকারদলীয় ও বিরোধীদলীয় হাইপ্রোফাইল নেতাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ব্যক্তিগত ফোনালাপ রেকর্ড করতেন। বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের ব্যক্তিগত ফোনকল ফাঁস করে তা বিভিন্ন টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রচার করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
সর্বশেষ ছাত্র আন্দোলনের সময় মন্ত্রিপরিষদ সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ (আইজিপি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কয়েকজন মন্ত্রীর ফোনালাপ রেকর্ডের সারাংশ গণভবন থেকে উদ্ধার হয়। তাতে আন্দোলন দমনে ইন্টারনেট বন্ধসহ নানা কৌশলের তথ্য উঠে আসে।
মন্তব্য করুন