লাভের স্টেশন চেনে না রেল, দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতিই গলার কাঁটা
লোকসান আর বাংলাদেশ রেলওয়ে একে অপরের হাত ধরে তাদের পথচলা যেন যুগ-যুগের। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় গণপরিবহন, গত কয়েক বছরে টিকিটের মূল্যও বেড়েছে অনেক, সঙ্গে বিনিয়োগ হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এরপরও কোথায় যেন একটা সমস্যা, কোনো এক মন্ত্রবলে যেন লাভের স্টেশনে আর ভেড়া হয় না রেলের।
বছর বছর আয়ের হিসাব থাকলেও ব্যয়ের সঠিক হিসাবটা নিয়ে মুখ খুলতে চান না কোনো কর্মকর্তা। দুর্নীতি-অনিয়ম আর স্বজনপ্রীতি যেন রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে এই খাতে। হিসাব বলছে, বিগত এক যুগে অন্তত ১৭ হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে রেলের।
এদিকে আয় বাড়াতে নতুন খাত সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছে রেলওয়ে। খাতওয়ারি আয়-ব্যয়ের হিসাব নির্দিষ্ট করার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এরপরও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা দুর্নীতি-অনিয়ম আর স্বজনপ্রীতির শৃঙ্খল ভাঙা না গেলে, সামনের উদ্যোগগুলোও কতটা ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়।
সবশেষ লাভের আশায় বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় লিজ হিসেবে ছেড়ে দেওয়া হয় ৩৭টি ট্রেন। কিন্তু এখানেও গুরুতর অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ।
জানা গেছে, বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া ট্রেনগুলোর মধ্যে ৩২টি ট্রেনই পরিচালনা করছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সালাউদ্দিন রিপন ও তার স্ত্রী। অভিযোগ আছে, সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক ও নুরুল ইসলাম সুজনের কল্যানে রেলের সঙ্গে অসম চুক্তি বহাল রাখতে সমর্থ্য হয়েছেন তারা। ট্রেনগুলো তাদের ইজারায় থাকলেও জ্বালানি-মেরামত-রক্ষণাবেক্ষণ সব খরচই বহন করছে রেল কর্তৃপক্ষ। শুধু প্রতি ট্রিপে কোচপ্রতি নির্ধারিত টাকা দেন ইজারাদাররা।
ব্যাপক সমালোচনার মুখে চলতি সপ্তাহে বেসরকারি খাতে পরিচালিত ২৪টি ট্রেনের ইজারা ডিসেম্বর থেকে বাতিল করে নতুন দরপত্র আহ্বান করার কথা জানায় রেল মন্ত্রণালয়। তবে রিপন-লুনা দম্পত্তির ইজারার বিষয় ও ব্যয়ের হিসাবের ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি রেল কর্তৃপক্ষ।
রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার শাহাদাত আলী শুধু বলেন, আসলে লিজকৃত ট্রেনের যে বিষয়টি, সেটি নিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে নতুনভাবে টেন্ডার দেওয়া হয়েছে। যেহেতু ট্রেনের কার্যক্রম পূর্বাঞ্চল-পশ্চিমাঞ্চল থেকে দেওয়া হয়, তাই ওই জোনে মন্ত্রণালয় নির্দেশনা পাঠিয়েছে। আশা করছি, দ্রুত কার্যক্রম শুরু হবে।
বিগত সরকারের সবশেষ রেল মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ব্যয়ের হিসাব দিতে না পারায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন কমিটির সদস্যরা। সেখানে উপস্থাপিত হিসাবে বলা হয়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রতি কিলোমিটারে যাত্রীপ্রতি খরচ হয়েছে দুই টাকা ৪৩ পয়সা, আর আয় হয়েছে ৬২ পয়সা। এ ছাড়া পণ্য পরিবহনে প্রতি কিলোমিটারে টনপ্রতি খরচ হয়েছে প্রায় ৯ টাকা। সে হিসাবে প্রতি বছর প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার লোকসান গুনতে হয় রেলকে।
রেলওয়েতে দায়িত্ব পালন করা সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির মিলন বলেন, এই ট্রেনগুলোর পেছনে রেলওয়ের যা ব্যয়, তা কখনোই হিসাব করে না কর্তৃপক্ষ। হিসাব করার সক্ষমতা আদৌ আছে কি না, সে বিষয়েও আছে সন্দেহ। এই ব্যয় হিসাব করতে গেলে অনেক কিছু বেরিয়ে আসবে। ধরা যাক, যদি গত বছরের ব্যয় হিসাব করতে হয়, তাহলে কত ক্রয়, নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণসহ অনেককিছু চলে আসে।
খাতওয়ারী ব্যয়ের কোনো হিসাব না রাখায় লোকসানের সঠিক হিসাব মিলছে না। এ অবস্থায় রেলকে সহসাই লাভজনক করা কঠিন বলে মনে করেন কর্মকর্তারা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনিয়ম-দুর্নীতি কমাতে না পারলে পরিস্থিতি উন্নতির আশা নেই।
মাহবুব কবির মিলন বলেন, লোকসানের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হলে প্রথমত, রেলওয়েকে দুর্নীতির সবরকম ফাঁকফোকর বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রত্যেকটি প্রোজেক্টে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। সেইসঙ্গে পরিবহন সংখ্যাও আরও বাড়াতে হবে। সারা পৃথিবীতে, রেল সবচেয়ে বেশি আয় করে মাল পরিবহনের মাধ্যমে, যাত্রী পরিবহনের মাধ্যমে নয়।
অন্যদিকে রেল মহাপরিচালক সরদার শাহাদাত আলী বলেন, রেলের মূল সমস্যা ইঞ্জিন। বিশেষকরে, মিটারগেজ ইঞ্জিনে বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে। যার কারণে, মালবাহী ট্রেনগুলো ভালোভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয় না।
আরটিভি/এসএইচএম
মন্তব্য করুন