হাসিনার শাসনামলে গণতন্ত্র পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে: ড. ইউনূস
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেছেন, হাসিনার শাসনামলে গণতন্ত্রের মূলনীতি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। টানা তিন মেয়াদে ভোটারবিহীন নির্বাচন করেছিলেন হাসিনা। এর মাধ্যমে তিনি নিজেকে এবং তার দলকে বিজয়ী ঘোষণা করেছিলেন। একজন ফ্যাসিবাদী শাসক হিসেবে এসব করেছিলেন হাসিনা।
৩০ নভেম্বর নিক্কেই এশিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। সোমবার (২ ডিসেম্বর) সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এ বছরের আগস্টে ছাত্র নেতৃত্বাধীন সরকারি চাকরিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে কয়েকশ’ শিক্ষার্থী নিহত হন। এরপরই শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন হাসিনার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। শেষ পর্যন্ত ৫ আগস্ট ছাত্র-নাগরিকের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। তিনি হেলিকপ্টারে চড়ে ভারতে পালিয়ে যান। অক্টোবরে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনা এবং তার বেশ কয়েকজন সহযোগীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।
ড. ইউনূস বলেন, এই বিচারিক কার্যক্রম শেষে রায় হলে হাসিনার প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে ভারতকে জানানো হবে। বিচার শেষে তার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত রায় এলে আমরা ভারতের কাছে হাসিনার আনুষ্ঠানিক হস্তান্তরের অনুরোধ করব। এ ক্ষেত্রে উভয় দেশের স্বাক্ষরিত একটি আন্তর্জাতিক আইনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ আইন মানতে ভারত বাধ্য থাকবে।
তিনি বলেন, ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকার সবকিছু ধ্বংস করে ফেলেছে। নির্বাচনের আগে আমাদের অর্থনীতি, শাসনব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র এবং বিচারব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার করতে হবে।
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা ইস্যুতেও কথা বলেছেন তিনি। রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপনের অনুমতি দেয়নি বাংলাদেশ সরকার। এক্ষেত্রে ড. ইউনূস তাদের (রোহিঙ্গাদের) নিজেদের দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন।
অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান বলেন, এই দায় (রোহিঙ্গা) বাংলাদেশ কতদিন বহন করবে? রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য আমাদের একটি সুস্পষ্ট গন্তব্য ঠিক করা দরকার। মিয়ানমারে জাতিসংঘ-শাসিত নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পক্ষে বাংলাদেশ। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, মিয়ানমার অনুমতি দিলে বিপুল পরিমাণ এই রোহিঙ্গা তাদের দেশেই থাকতে পারবে। সেখানকার পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে তারা অন্য দেশে স্থানাস্তরিত না হয়েই তাদের নিজ ভূমিতে ফিরে যেতে পারবে বলে উল্লেখ করেন মুহাম্মদ ইউনূস।
দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় জাতি সংস্থা-আসিয়ানে বাংলাদেশের যোগ দেওয়ার বিষয়ে জোর দিয়েছেন ড. ইউনূস। কেননা বাংলাদেশ আসিয়ানে যোগ দেওয়াকে একটি প্রতিশ্রুতিশীল সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতে চায়। বিশেষ করে ২০২৬ সালের মধ্যে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। আগামী জানুয়ারি থেকে আসিয়ানের সভাপতিত্ব করবে মালয়েশিয়া।
ড. ইউনূস বলেছেন, তিনি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে বাংলাদেশের সদস্যপদ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বাংলাদেশকে আসিয়ানে যুক্ত করার কথা জানিয়েছেন। এক্ষেত্রে বেশ কিছু ধাপ রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, আসিয়ানে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপটি হবে একটি সর্বসম্মত রেজুলেশন নিশ্চিত করা। আমরা আসিয়ানের মধ্যে একটি সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার হিসেবে স্বীকৃতি অর্জনের আশা করছি। আসিয়ানের সদস্য দেশগুলো বাংলাদেশের এই প্রচেষ্টাকে সমর্থন করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন ড. ইউনূস।
ক্ষমতাচ্যুত বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছেন বলেও মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনী সংশোধনীসহ সাংবিধানিক ও বিচার বিভাগীয় সংস্কারের পর সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ড. ইউনূস। নির্বাচনের আগে দেশের অর্থনীতি, শাসনব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র এবং বিচার ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন ৮৪ বছর বয়সি নোবেলজয়ী ক্ষুদ্রঋণের এই অগ্রদূত।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনী ব্যবস্থা, সংবিধান এবং বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে। জানুয়ারির মধ্যে ওই কমিশনগুলোর সুপারিশ হাতে পাওয়ার পর পূর্ণাঙ্গ সংস্কার বাস্তবায়ন করার কথা জানিয়েছে সরকার। তবে এই সংস্কার বাস্তবায়নে সময় লাগবে বলে জানান তিনি। বলেন, এই সংস্কার বাস্তবায়নে সময় লাগবে, কেননা ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়তে আমরা একদম গোড়া থেকে কাজ শুরু করেছি। তবে নির্বাচন ঠিক কখন হবে সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেছেন, নির্বাচনের সময় নির্ভর করছে সংস্কার কাজের ওপর। কাজের ফলাফলই সময় নির্ধারণ করে দেবে।
সাধারণ নির্বাচনে ড. ইউনূস প্রার্থী হবেন কি না তা জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়টি নাকচ করে দেন। বলেন, আমি রাজনীতিবিদ নই। আমি সবসময়ই রাজনীতি থেকে দূরে থেকেছি। রাষ্ট্রের যেসকল ব্যক্তিরা নীতিকে সমুন্নত রাখেন, নিয়ম-কানুন অনুসরণ করেন এবং নিজেকে দুর্নীতিমুক্ত রাখেন তাদের নির্বাচনে দাঁড়ানো উচিত বলে মনে করেন ড. ইউনূস।
তিনি বলেন, হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে দেশের শাসনকাঠামো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গছে, আমরা এখন তা পুনর্গঠনের গুরুত্বপূর্ণ কাজের মুখোমুখি হয়েছি। গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করা আমাদের কাজ।
কূটনৈতিক ফ্রন্টে বাংলাদেশের উচিত ভারতের সঙ্গে শক্তিশালী ও সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা। এক্ষেত্রে ড. ইউনূস দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) পুনরুজ্জীবিত করার প্রস্তাব করেছেন। ভারত এবং পাকিস্তানের বৈরি সম্পর্কের ফলে সার্ক কার্যত নিষ্ক্রিয় রয়েছে। সার্কের লক্ষ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোর মতো নিজেদের মধ্যে চলাফেরার স্বাধীনতা, আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যকে উৎসাহিত করা। সার্কের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে ভারতেকে পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনা নিরসনের আহ্বান জানিয়েছেন ড. ইউনূস।
ওদিকে হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে ভারত সরকার। তাদের দাবি বাংলাদেশে হিন্দুদের ঘরবাড়ি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং মন্দিরে ‘হামলা’ করা হয়েছে। এ বিষয়ে ঢাকাকে অবশ্যই হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে বলে জোর দিয়েছে দিল্লি। তবে ভারত সরকারের এসব ঢালাও বক্তব্য নাকচ করে দিয়েছেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, সংখ্যালঘু ইস্যুতে যা বলা হচ্ছে তার বেশির ভাগই প্রোপাগান্ডা। এগুলো সঠিক তথ্যের উপর ভিত্তি করে বলা হচ্ছে না বলে পাল্টা অভিযোগ করেছেন ড. ইউনূস।
তিনি ভারতীয় সাংবাদিকদের বাংলাদেশে এসে তদন্তসাপেক্ষে সঠিক তথ্য তুলে ধরার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা এসব ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে ভারত সরকারকে ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য কাজ করছি।
আরটিভি/এমএ
মন্তব্য করুন