ফিরে দেখা ২০২৪
বায়ুদূষণে রাজধানীবাসীর দুর্ভোগ, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর লম্বা সারি
সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের যে প্রাকৃতিক নিয়ম, সে নিয়মে আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিচ্ছে আরও একটি বছর। আমাদের জীবনে বছর যায়, বছর আসে, কিন্তু বদলায় না রোগ-শোক আর দুর্দশা। বিদায় নিতে যাওয়া ২০২৪ সালের শেষে শীতের শুরুতে হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে ডেঙ্গু, জ্বর, ঠান্ডা, কাশি, বায়ুদূষণজনিত রোগ, নিউমোনিয়া, সাইনোসাইটিসসহ নানা বয়সী রোগীর ভিড়।
বায়ুদূষণ
বছরজুড়ে বায়ুদূষণ ছিল রাজধানীবাসীর নিত্যদিনের সঙ্গী। ধূলাবালি, যানবাহন, কলকারখানার ধোঁয়ায় বছরের বড় অংশজুড়ে ঢাকার বায়ুমান থাকে তলানিতে। সারা বছর চলা নির্মাণকাজ, সড়কের খোঁড়াখুঁড়ি আর আবর্জনা পোড়ানোয় দূষিত হয় বাতাস। মাস্ক ব্যবহার করেও দূষণ থেকে রেহাই পাচ্ছে না মানুষ।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের সূচকে প্রায়ই বিশ্বের দূষিত বায়ুর শীর্ষস্থান দখল করে নেয় ঢাকা।
আইকিউএয়ারের বাতাসের মানসূচকে স্কোর ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত থাকলে বায়ুমান অস্বাস্থ্যকর, ২০১ থেকে ৩০০ হলে খুবই অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০১-এর বেশি হলে তা বিপজ্জনক বলে বিবেচিত হয়।
গত এক মাসের হিসাবে ঢাকার বায়ুমান ১৫১ থেকে ২৯৯ স্কোরে ওঠানামা করেছে। আইকিউএয়ারের বাতাসের মানসূচকে দেখা যায়, গত নভেম্বরের ১৫, ১৬, ২৩, ২৪, ২৫ ও ডিসেম্বরের ৪, ৫, ৮, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩ ও ১৪ তারিখে ঢাকার বায়ুমানের স্কোর ছিল ২০১ থেকে ৩০০-এর মধ্যে। অর্থাৎ এই ১৪ দিন ‘ খুবই অস্বাস্থ্যকর’ ছিল ঢাকার বাতাস।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ৭ মিলিয়ন মানুষের বায়ুদূষণের কারণে মৃত্যু হয়।
বায়ুদূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের গবেষণা অনুযায়ী, শীতকালে বা শুষ্ক মৌসুমের নভেম্বর থেকে মার্চ- এই ৫ মাসে বায়ুদূষণ হয়ে থাকে ৫৭ শতাংশ। কিন্তু চলতি বছরের নভেম্বরে ঢাকার মানুষ একদিনও স্বাস্থ্যকর বাতাসে শ্বাস নিতে পারেনি।
'স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার ২০২৪’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাপী বাতাসের মানের উদ্বেগজনক অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা বায়ুদূষণজনিত রোগের শিকার হয়ে থাকে। এর প্রভাবে অপরিণত অবস্থায় জন্মগ্রহণ, কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ, হাঁপানি ও ফুসফুসের রোগসহ বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দেয়।
ডেঙ্গু
চলতি বছরের ১৪ ডিসেম্বর সকাল পর্যন্ত হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি রোগীর সংখ্যা লাখের ঘর (৯৮ হাজার ৫০৪ জন) ছুঁইছুঁই করছে। পাশাপাশি এ রোগে আক্রান্ত হয়ে ৫৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বছরজুড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ অব্যাহত থাকার কারণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু মূলত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশগুলোতে হয়ে থাকে। সাধারণত ভাইরাসটি শহরাঞ্চলের একটি রোগ, তবে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশেও বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে। ২০২৩ সালের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা কম হলেও এতে আক্রান্ত হয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গুর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ১ হাজার ৫৫ জন, যাদের মধ্যে ১৬ জনের মৃত্যু হয়। এরপর ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল এই তিন মাস আক্রান্ত ও মৃত্যু কিছুটা কম ছিল। ফেব্রুয়ারিতে ৩৩৯ জন ভর্তি হন এবং মারা যান ৫ জন। মার্চে ভর্তি ৩১১ জন, মৃত্যু হয় ৫ জনের। এপ্রিলে ভর্তি হন ৫০৪ জন, মারা যান ২ জন।
এরপর থেকে আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল বাড়তে থাকে। মে মাসে ৬৪৪ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন এবং ১২ জন মারা যান। জুন মাসে ভর্তি হন ৭৯৮ জন, মারা যান ৮ জন। জুলাই মাসে এক লাফে বেড়ে ২ হাজার ৬৬৯ জন ভর্তি হন, যার মধ্যে ১২ জনের মৃত্যু হয়। আগস্টে ভর্তি হন ৬ হাজার ৫২১ জন, মারা যান ৩০ জন। সেপ্টেম্বরে এই সংখ্যা প্রায় তিনগুণ বেড়ে যায়। এই মাসে ভর্তি হন ১৮ হাজার ৯৭ জন এবং মোট মৃত্যু হয় ৮৭ জনের।
চলতি বছর ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি ১৭৩ জনের মৃত্যু হয়েছে গত মাসে। নভেম্বরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন ২৯ হাজার ৬৫২ জন। তার আগের মাসে অক্টোবরে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩০ হাজার ৮৭৯ জন এবং মৃত্যু হয়েছিল ১৩৫ জনের। এ ধারাবাহিকতায় চলতি ডিসেম্বরের প্রথম ১৪ দিনে আক্রান্ত হয়েছেন ৭ হাজার ৩৫ এবং মারা গেছেন ৬০ জন।
বিভাগভিত্তিক ডেঙ্গু আক্রান্তের তথ্যে দেখা গেছে, গত বছর (২০২৩ সাল) ঢাকায় ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১ লাখ ৬৯ হাজার ৩২১ জন, এবার এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ৫৬ হাজার ৬১২ জন। ২০২৩ সালে চট্টগ্রামে ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ৪৪ হাজার ৪৩৫ জনের, এ বছর বিভাগটিতে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে ১৫ হাজার ১০৫ জন।
গত বছর খুলনা বিভাগে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছিল ৩৮ হাজার ৪৯ জনের, আর এ বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে ৯ হাজার ৭২১ জনের। বরিশালে গত বছর ৩৪ হাজার ৭২২ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হলেও এ বছর হয়েছে ৮ হাজার ৪৪৬ জনের। ময়মনসিংহে গত বছর ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছিল ১৯ হাজার ৪০৯ জনের, এ বছর ২ হাজার ৯৮৪ জন আক্রান্ত হয়েছে। রাজশাহীতে গত বছর ৮ হাজার ২৬৮ জন এবং এ বছর ৩ হাজার ৮১৪, রংপুরে গত বছর ৫ হাজার ৫৪০ জন এবং এ বছর ১ হাজার ৪৯৪ জন, সিলেটে গত বছর ১ হাজার ৪৩৫ জন এবং এ বছর ৩২৮ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে।
ডায়রিয়া
সাধারণত মার্চের শেষ ভাগ থেকে মে মাস পর্যন্ত বাড়ে ডায়রিয়ার প্রকোপ। তবে চলতি বছর কিছুটা ব্যতিক্রম রূপ দেখা গেছে রোগটির। স্বাভাবিক সময়ে দৈনিক গড়ে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩৫০ রোগী ভর্তি হলেও ২৯ মে এক লাফে রোগী বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫৩ জনে। এরপর গত ৩১ মে থেকে ৫ জুন পর্যন্ত প্রতিদিনই হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল হাজারের ঘরে। তবে ধীরে ধীরে সেই সংখ্যা কমে এসেছে।
নিউমোনিয়া
ঢাকার শিশু হাসপাতালে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিনই রোগী ভর্তি হচ্ছে। হাসপাতালের ১৯ শয্যার নিউমোনিয়া ওয়ার্ড এরই মধ্যে পূর্ণ হয়ে গেছে। হাসপাতালের কর্মকর্তারা জানান, গত বৃহস্পতিবার ১ হাজার ২০০ রোগীকে বর্হিবিভাগে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক বলেন, হাসপাতালে প্রতিদিনই ঠান্ডাজনিত শিশু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
মন্তব্য করুন