ফিরে দেখা ২০২৪
এ কোন মৃত্যু, কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন!
বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশসহ বিভিন্ন সশস্ত্র বাহিনী ও তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন মুক্তিকামী বহু তরুণ-তরুণী। এই নৃশংসতা গা শিউরে ওঠার মতো ভয়াবহ! দীর্ঘ এই লাশের মিছিলের মধ্য বেশ কিছু মৃত্যু বিশ্ব বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে। বছর শেষে পেছন ফিরে তাকানোর এই আয়োজনে দেখে নেওয়া যাক পুলিশের গুলিতে সে রকম কিছু মৃত্যুর ঘটনা—
আবু সাঈদ
কোনো কোনো মৃত্যু জীবনের চেয়েও সতেজ, মহিমান্বিত। আবু সাঈদের মৃত্যু জাতিকে দিয়েছে নতুন প্রাণ। ২০২৪-এর কোটা সংস্কার আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন সাঈদ। তিনি এই আন্দোলনের রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সমন্বয়ক ছিলেন। ১৬ জুলাই আন্দোলন চলাকালে পুলিশ সদস্যের গুলিতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কোটা আন্দোলনকারীরা তাকে আন্দোলনের প্রথম শহীদ বলে আখ্যায়িত করে।
১৬ জুলাই দুপুর আড়াইটা থেকে তিনটার দিকে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করে। ছাত্রদের সবাই সরে গেলেও আবু সাঈদ হাতে একটি লাঠি নিয়ে দুহাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে যান। এই অবস্থায় পুলিশ খুব কাছ থেকে থেকে তার ওপর ছররা গুলি ছোড়ে। পুলিশের অবস্থানের জায়গাটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে। তারপরও অবস্থান থেকে সরেননি আবু সাঈদ, দাঁড়িয়েই ছিলেন। একপর্যায়ে কয়েকটি গুলি খেয়ে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পর মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। অন্যান্য শিক্ষার্থীরা তাকে হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
মীর মুগ্ধ
জমজ দুই ভাই, স্নিগ্ধ মুগ্ধ। আইডেন্টিকাল টুইন তারা। একই চেহারা তাদের, একই মায়ের উদরে একসাথেই বড় হয়েছেন তারা। ছোটবেলা থেকেই একসাথে খাওয়া ঘুম, পড়াশোনা, সবকিছুই। তবে স্নিগ্ধ বেঁচে থাকলেও না-ফেরার দেশে মুগ্ধ। ঘাতকের বুলেট কেড়ে নিয়েছে এই উদীয়মান তরুণের জীবন। এই মৃত্যুর ঘটনা কাঁদিয়েছে গোটা দেশকে। শুধু দেশই নয়, জেনেছে বিশ্বও।
বাংলাদেশ ইউভার্সির্টি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) ছাত্র ছিলেন মুগ্ধ মৃত্যুর আগমুহূর্তেও তিনি আন্দোলনকারীদের মধ্যে পানি বিতরণ করছিলেন। সেই ঘটনার একটি ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হয় ইন্টারনেটে। মুগ্ধর কণ্ঠের ‘পানি লাগবে, পানি?’ এই বাক্য কানে বেজেছে দেশের কোটি মানুষের।
কিশোর তাহমিদ ভূঁইয়া
কিশোর তাহমিদের স্বপ্ন ছিল সেরা ক্রিকেটার হবে। বিশ্ব জয় করবে। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মুহূর্তেই ঝরে গেল কচি প্রাণ। নিভে গেল জীবন প্রদীপ। অধরাই থেকে গেল তাহমিদের সেরা ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন।
শহীদ তাহমিদ ভূঁইয়া (১৫) নরসিংদী সদর উপজেলার চিনিশপুর ইউনিয়নের নন্দীপাড়া গ্রামের রফিকুল ইসলাম ভূঁইয়ার ছেলে। নাছিমা কাদির মোল্লা হাইস্কুল অ্যান্ড হোমসের নবম শ্রেণির ছাত্র। তিন ভাই-বোনের মধ্যে বড় ছিল সে। ১৮ জুলাই ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে নরসিংদী শহরের জেলখানার মোড়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলছিলো। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার মাঝখানে পড়ে তাহমিদ। পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝড়া হয়ে যায় তার বুক। ঘটনাস্থলেই মারা যায় তাহমিদ।
মুক্তির নেশায় নেশাতুর ফারহান ফাইয়াজ
‘একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। এমন জীবন গড়ো, যাতে মৃত্যুর পর মানুষ তোমাকে মনে রাখে।’ নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের ইন্ট্রোতে রেসিডেনসিয়াল মডেলে কলেজের ছাত্র ফারহান ফাইয়াজ ইংরেজিতে এ কথা লিখেছিলেন।
ফারহান কোটা সংস্কার আন্দোলনে রাজপথে নেমে আর ঘরে ফিরতে পারেনি। রাজধানীর ধানমন্ডিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে ফারহান ফাইয়াজ নিহত হন।
ধানমন্ডি ২৭ নম্বর এলাকায় ১৮ জুলাই বিকেল সাড়ে ৩টার পর থেমে থেমে সংঘর্ষ চলছিল। সে সময় আহত হন ফারহান ফাইয়াজ। সেখান থেকে আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে মোহাম্মদপুর সিটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে তার মৃত্যু হয়। বুলেটে তার শরীর ঝাঁঝড়া হয়ে গিয়েছিল।
শিশু রিয়া গোপ
২০২৪ সালের জুলাইয়ের শেষ দিকে বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলন তীব্র রূপ নেয়। ১৯ জুলাই, দুপুরের খাবারের পর রিয়া খেলতে ছাদে যান। বাড়ির নিচে তখন পরিস্থিতি থমথমে ছিল; ছাত্র-জনতা ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ চলছিল। গোলাগুলির শব্দ শুনে রিয়াকে নিরাপদে আনার জন্য তার পিতা দীপক কুমার গোপ ছাদে যান। এই সময় পুলিশের গুলিতে রিয়ার মাথার পেছনে আঘাত লাগে।
আহত অবস্থায় রিয়াকে প্রথমে স্থানীয় নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয় এবং সেখানে অস্ত্রোপচার করা হয়। ডাক্তাররা রিয়াকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (ICU) রাখেন এবং ৭২ ঘণ্টার মধ্যে উন্নতি আশা করেন। ২১ ও ২২ জুলাই রিয়ার শারীরিক কিছু নড়াচড়া লক্ষ্য করা গেলেও ২৪ জুলাই চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন এবং কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন ‘গানশট ইনজুরি’। শিশু রিয়ার এমন মৃত্যৃ বিশ্বকে ধাক্কা দিয়ে গিয়েছিল।
ইমাম হাসান ভূঁইয়া
‘পুলিশের ছেলে পুলিশেরই গুলিতে মরল, আমার স্বামী এই প্রতিদান পাইল? আমার ছেলেরে কতগুলা গুলি দিছে, ছেলে তো চোর-সন্ত্রাসী ছিল না। যে মারল, তার একটুও মায়া লাগে নাই? মারতে কয়টা গুলি লাগে?...আমি সঠিক বিচারটা চাই’—এসব কথা গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ১৯ বছর বয়সী ইমাম হাসান ভূঁইয়া তাইমের মা পারভীন আক্তারের। তার বুকফাঁটা গগনবিদারী আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে উঠছিল চারপাশ। নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল শহরে।
রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের জ্যেষ্ঠ উপপরিদর্শক মো. ময়নাল হোসেন ভূঁইয়ার ছেলে ইমাম হাসান। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পুলিশের গুলিতে ২০ জুলাই যাত্রাবাড়ীর কাজলা পদচারী–সেতুর কাছে মারা যান ইমাম হাসান।
শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন
‘এ-কোন মৃত্যু? কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন,/শিয়রে যাহার ওঠে না কান্না, ঝরে না অশ্রু?/হিমালয় থেকে সাগর অবধি সহসা বরং/সকল বেদনা হয়ে ওঠে এক পতাকার রং’—কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ এই কবিতা লিখেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদারদের বর্বোরচিত হত্যাকাণ্ড নিয়ে। চব্বিশে কবি বেঁচে থাকলে তার কবিতায় কতটুকু শোক ঝরত, বলার অপেক্ষা রাখে না।
পুলিশের একটি সাঁজোয়া যানের ওপর থেকে একজনকে টেনে নিচে ফেলা হলো। তিনি সাঁজোয়া যানের চাকার কাছে সড়কে পড়ে থাকেন। এরপর পুলিশের এক সদস্য সাঁজোয়া যান থেকে নিচে নামেন। এক হাত ধরে তাকে টেনে আরেকটু দূরে সড়কে ফেলে রাখেন। এখানেই শেষ নয়, পরে কয়েকজন পুলিশ মিলে তাকে টেনে সড়ক বিভাজকের ওপর দিয়ে ঠেলে অপর পাশে ফেলে দেন।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাভারের পাকিজা মডেল মসজিদের কাছে গত ১৮ জুলাই ঘটনাটি ঘটে। বর্বোরচিত এমন হত্যাকাণ্ডের শিকার শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন নামে ওই যুবক রাজধানীর মিরপুরের মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন, থাকতেন এমআইএসটির ওসমানী হলে। বাসা সাভারের ব্যাংক টাউন আবাসিক এলাকায়। তাকে পরিবারের সদস্য ও বন্ধুরা ইয়ামিন নামেই ডাকতেন।
শহীদ নাফিস
এক পাশে শূন্যে ঝুলছে দেশের পতাকা মোড়ানো মাথা, অন্যপাশে ঝুলছে গুলিবিদ্ধ নিথর পা দুটো। একজন রিকশাচালক প্যাডেল চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন দেহটি। হৃদয়বিদারক এ দৃশ্য দেখে যে কারোর পক্ষেই চোখের পানি আটকে রাখা কঠিন ছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বেশ ভাইরাল হয় এ ছবিটি। এতে যার দেহ পরে থাকতে দেখা যায় তার নাম নাফিস। বয়স মাত্র ১৭ বছর। সবেমাত্র বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাস করেছেন যুকটি।
জানা যায়, ৪ আগস্ট সকালে নাফিস শাহবাগ হয়ে ফার্মগেটে মুভমেন্টে যোগ দেয়। দুপুর দেড়টার দিকে সর্বশেষ তার মাকে কল দিয়ে জানায় সে নিরাপদে আছে। মা তাকে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরতে বলে। এরপর সময় গড়াতে থাকে, নাফিসের আর কোনো সন্ধান পাচ্ছিল না তার মা। মোবাইলেও কোনোভাবে সংযোগ করতে পারছিল না। সন্ধ্যা নাগাদ তার বাবা বের হয় ছেলের খোঁজে। শাহবাগ থেকে ফার্মগেট, হাসপাতাল টু হাসপাতাল খোঁজাখুজি করে কোথাও ছেলের সন্ধান না পেয়ে রাত বারোটায় ফিরে যান বাসায়। এরমধ্যে নাফিসের সেই হৃদয়বিদারক ছবি ফেসবুক ভাইরাল হয়ে যায়। বড় ভাই সেই ছবি দেখায় বাবাকে। সেখান থেকে তারা শনাক্ত করতে পারে নাফিসকে। পরবর্তীতে বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গে খোঁজাখুঁজি করে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত নাফিসের বাবা মানবজমিন পত্রিকার অফিসে ছুটে যান সেই ছবিটির ফটোগ্রাফারের কাছে৷ মানবজমিনের অফিসে থাকা অবস্থায় তার শালা (মানে নাফিসের মামা) কল দিয়ে জানায় সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলের মর্গে পাওয়া গেছে নাফিসের লাশ।
মন্তব্য করুন