মামলা ঢাকায়, আসামি সব লালমনিরহাটের
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার একটি হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে দেশের উত্তরের জেলা লালমনিরহাটের ৩৬ জনকে। আসামিদের ৩ জন লালমনিরহাটের সাবেক সংসদ সদস্য। এছাড়া ঘটনার সময় লালমনিরহাটে দায়িত্ব পালন করা এক সাংবাদিককেও ঢাকার এ মামলায় আসামি করা হয়েছে। এরমধ্যে ১ জনের স্থানীয় ঠিকানা ঢাকার হলেও ৩৬ জনের কেউই মামলার এলাকার বাসিন্দা নন।
নাম বাদ দিতে অপর একটি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতা আসামিদের কাছে টাকা দাবি করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে গত ৫ আগস্ট রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় বিক্ষোভের সময় নিহত হন মিরাজুল ইসলাম (২১)। এই ঘটনায় তার বাবা মো. আব্দুস ছালাম ২৪ আগস্ট যাত্রাবাড়ী থানায় হত্যা মামলা করেন। এ মামলায় নাম উল্লেখ করা সকল আসামি লালমনিরহাটের।
মামলার বাদী মো. আব্দুস ছালাম এ বিষয়ে বলেন, আসামিদের কয়েকজন সংসদ সদস্য। অন্যরাও কোনো না কোনোভাবে ঢাকায় সেটেল্ড (স্থায়ীভাবে বাস করেন)। আমি বলি না তারা আসলে ঘটনার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু তারা সংঘবদ্ধ হয়ে এই কাজটা করে থাকতে পারে, এ রকম সম্ভাবনা থেকেই মামলাটা করেছেন বলে জানান তিনি।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, লালমনিরহাট-১ আসনের সংসদ সদস্য মো. মোতাহের হোসেন, লালমনিরহাট-২ আসনের সংসদ সদস্য মো. নুরুজ্জামান আহমেদ ও লালমনিরহাট-৩ আসনের সংসদ সদস্য মো. মতিয়ার রহমানসহ মোট ৩৬ জনকে আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও ২০০-৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
তবে শুধু সংসদ সদস্য মো. মোতাহের হোসেনের বর্তমান ঠিকানা ঢাকা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নাম উল্লেখ করা বাকি সব আসামির বাড়ি লালমনিরহাটের বিভিন্ন উপজেলায়। তাদের আর কারোরই বর্তমান ঠিকানা ঢাকায় নয়। সবার ঠিকানাই লালমনিরহাট বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ঘটনার বিষয়ে মামলার এজাহারে বলা হয়, ৫ আগস্ট সকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভে যোগ দেন মিরাজুল ইসলাম। তখন যাত্রাবাড়ী মাছের আড়তের সামনে আগ্নেয়াস্ত্র, লোহার রড, বাঁশ, হকিস্টিকসহ মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসীরা মিরাজুলকে গুলি করে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮ আগস্ট মিরাজুল মারা যান।
নিহত মিরাজুলের বাবা মো. আব্দুস ছালামের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের বাড়ি লালমনিরহাটের আদিতমারীর বারঘরিয়া গ্রামে। মিরাজুল ২০২২ সালে স্থানীয় মহিষখোচা হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাস করে ঢাকায় আসেন। দুই বছর ধরে পরিবারের সঙ্গে যাত্রাবাড়ী থানার মাতুয়াইলের রশিদবাগে থাকতেন। স্থানীয় একটি মোবাইল রিচার্জ ও বিকাশের দোকানে কাজ করতেন মিরাজুল।
ছেলের হত্যার বিচারের বিষয়ে জানতে চাইলে আব্দুস ছালাম বলেন, যাদের আসামি করেছি, তাদের বিরুদ্ধে আমার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই। পুলিশ যখন তদন্ত করবে তখন তাদের বাইরে যদি অন্য কেউ থাকে বা তারা না থাকে, তাতে আমার আপত্তি নেই। আমি সুবিচারের স্বার্থে মামলাটা করেছি।
মামলার এজাহারের বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা যাত্রাবাড়ী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. মাহবুব হোসেন বলেন, সব আসামি লালমনিরহাটের, এ বিষয়টি নিয়ে তেমন কিছু বলতে পারব না। তদন্ত চলছে। ঘটনাস্থলের ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে।
জানা যায়, আসামিদের অধিকাংশই ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মী ও সমর্থক। এলাকায় রাজনৈতিক বৈরিতা ও ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে তাদের আসামি করা হয়েছে। মামলার ২৭ নম্বর আসামি মো. শেফাউল (৪০) লালমনিরহাটের মহিষখোচা স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী শিক্ষক। মিরাজুল এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই ছাত্র ছিলেন। শিক্ষক মো. শেফাউলের বাড়ি আদিতমারী উপজেলার গোবর্ধন গ্রামে। মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে শেফাউল বলেন, ঘটনার দিন আমি আদিতমারী ছিলাম। ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে আমার নাম জড়িয়ে থাকতে পারে।
মামলার এক আসামি জানান, মামলা হওয়ার আগেই কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহ-আইনবিষয়ক সম্পাদক জয়নাল আবেদীন পলাশ এক আসামিকে ফোন দিয়ে জানান, তার কাছে ৭২ জনের একটি তালিকা আছে। কয়েকটি মামলায় তাদের আসামি করা হবে। পলাশ তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার কথা বলে কয়েক জনের কাছে লাখ টাকা চেয়েছেন।
সায়েম মোল্লা জানান, আমি একজন অসুস্থ মানুষ, আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি, এ কারনে আমাকে আসামি করা হয়েছে।
এক অডিও কল রেকর্ড থেকে জানা যায়, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহ-আইনবিষয়ক সম্পাদক জয়নাল আবেদীন পলাশ মামলা থেকে বাঁচার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেন শেফাউল। এ সময় পলাশ বলেন, ভবিষ্যতে রাজনীতি করব, কিছু লোক হাতে রাখতে হবে, টাকা দরকার। আপনি এ ক্ষেত্রে কী করতে পারবেন? তখন শেফাউল বলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে ১ লাখ টাকা দেব। আপনি (পলাশ) ২ লাখের কথা বললেন, গরু বেঁচে ১ লাখ টাকা দেই। কয় দিন পর আরও ৫০ হাজার দেব। কথা নড়বে না। এ সময় ৫০ হাজার টাকা মাফ করার অনুরোধ জানালে পলাশ বলেন, আমি অনেক স্যাক্রিফাইস (ত্যাগ স্বীকার) করেছি।
নিজের অডিও কল রেকর্ড ও ঘটনার বিষয়ে ছাত্রদলনেতা জয়নাল আবেদীন পলাশ বলেন, আমি একজন আইনজীবী। শেফাউলের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। জামিনের বিষয়ে তার সঙ্গে কথা হয়েছিল। কীভাবে মামলায় নাম বাদ দেওয়া যায় অথবা জামিন নেওয়ার প্রক্রিয়াটা কী—এই বিষয়ে কথা হয়েছে।
এ মামলার অধিকাংশ আসামি আত্মগোপনে রয়েছেন। হত্যা মামলার ৫১ নম্বর আসামি সরকারী চাকরিজীবী জাকির হোসেন জানান, আমি সরকারি চাকুরী করি। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে আমাকে মামলায় জড়িয়েছে। ঘটনার দিন আমি লালমনিরহাট হেড কোয়ার্টারে দায়িত্বরত ছিলাম। অথচ আমাকে হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে।
আরটিভি/এএইচ
মন্তব্য করুন