কালের সাক্ষী ১০ টাকার নোটের সেই আতিয়া মসজিদ
বাংলাদেশ ব্যাংকের দশ টাকার নোটে যে মসজিদটি সচরাচর চোখে পড়ে সেটি একটি ঐতিহাসিক মসজিদ। রূপকথার গল্পের মতো সেই দশ টাকার নোটটি এখন অতীত হয়ে গেছে। তবে নোটটি দেখা না গেলেও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আপন মহিমায় দাঁড়িয়ে আছে সেই মসজিদটি।
টাঙ্গাইল শহর থেকে মাত্র আট কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে দেলদুয়ার উপজেলায় আতিয়া মসজিদ অবস্থিত।
করোনাকালীন সময়ে লোকসমাগম কম হলেও বিগত বছর গুলোতে প্রচুর দর্শনার্থীর আগমন ঘটে মসজিদটি দেখতে।
‘আতিয়া’ শব্দটি আরবি শব্দ ‘আতা’ থেকে উৎপত্তি। এর অর্থ হলো ‘দান’। পঞ্চদশ শতকে এ অঞ্চলে আদম শাহ্ বাবা কাশ্মীরী নামে বিখ্যাত এক সুফি ধর্মপ্রচারকের আগমন ঘটে। ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এখানে বসতি স্থাপন করে ইসলাম প্রচার করতে থাকেন। এই পুণ্যবান ব্যক্তির কবরও এখানেই অবস্থিত।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৫৯৮ সালে বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হুসেইন শাহ কর্তৃক আতিয়ার জায়গিরদার নিযুক্ত হন আদম শাহ্ বাবা কাশ্মীরী। ওই সময় থেকে ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালনার ব্যয়ভার বহনের জন্য কররানি শাসক সোলাইমান কররানির কাছ থেকে বিশাল একটি এলাকা ‘ওয়াকফ্’ হিসাবে পান। এলাকাটি তাকে দান করা হলে পরবর্তীতে এ দান বা ‘আতা’ থেকে এ পরগণার নাম ‘আতিয়া’ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
শাহ্ কাশ্মীরীর শেষ বয়সে তার পরামর্শে সাঈদ খান পন্নীকে মোগল বাদশাহ জাহাঙ্গীর আতিয়া পরগণার শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। এই সাঈদ খান পন্নীই করটিয়ার বিখ্যাত জমিদার পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। তিনিই ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে আতিয়া মসজিদ নির্মাণ করেন।
টাঙ্গাইলের অন্যতম প্রাচীন এ মসজিদটি সুলতানি ও মোগল আমলের স্থাপত্য শিল্পরীতির সমন্বয়ে নির্মিত। মসজিদের পরিকল্পনা ও নির্মাণ কাজে নিযুক্ত ছিলেন প্রখ্যাত স্থপতি মুহাম্মদ খাঁ। নির্মাণের পর ১৮৩৭ সালে রওশন খাতুন চৌধুরী ও ১৯০৯ সালে আবুল আহমেদ খান গজনবি মসজিদটি সংস্কার করেন।
মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৪২ ফুট, প্রস্থ ৩২ ফুট এবং উচ্চতা ৪৪ ফুট। একটি বড় আকৃতির গম্বুজসহ মোট চারটি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের দেয়াল আট থেকে সাড়ে আট ফুট প্রশস্ত। মসজিদটির কিবলা-কোটা ও বারান্দাসহ সার্বিক পরিমাণ ১২ মিটার। মসজিদের দেয়াল ২.২২ মিটার প্রশস্ত। সুলতানি ও মোগল আমলের স্থাপত্যরীতির সুষম সমন্বয় এ মসজিদে দেখা যায়। চারকোণে চারটি বিরাট অষ্ট-কোনা আকৃতির মিনার রয়েছে। মিনারগুলো ছাদের অনেক ওপরে উঠে ছোট গম্বুজে শেষ হয়েছে।
বাংলার স্থাপত্য-কীর্তিগুলো মূলত ইটের তৈরি। তাই বাংলার স্থাপত্য এবং তার অলংকরণ সবই বিকশিত হয়েছে ইটের মাধ্যমেই। আতিয়া মসজিদও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে এ মসজিদে সুলতানি স্থাপত্য-বৈশিষ্ট্য রয়েছে দারুণভাবে। বক্রাকার কার্নিশ, দ্বি-কেন্দ্রিক সুচালো খিলান ও গম্বুজ নির্মাণে বাংলা পান্দান্তিভ ব্যবহার এবং পোড়ামাটির টেরাকোটা নকশা চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। মানুষের হাতের কারুকাজ কতটা নিখুঁত আর সুন্দর হতে পারে, এই মসজিদটিই তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
অসংখ্য নকশাখচিত মসজিদটির গায়ে খোদাই করা হয়েছে আরবি হরফ। মসজিদের বারান্দার ওপর ছোট তিনটি গম্বুজ বাংলা পান্দান্তিভ পদ্ধতিতে নির্মিত। পরে সংস্কারের সময় গম্বুজগুলো পলেস্তারা দিয়ে সমান করে দেওয়া হয়েছে যদিও মসজিদ নির্মাণের সময় এমনটা ছিল না। আদিতে গম্বুজগুলো পলকাটা বা ঢেউতোলা ছিল। টাঙ্গাইল অঞ্চলে প্রাপ্ত শিলালিপিগুলোর মধ্যে আতিয়া জামে মসজিদের একটি আরবি আরেকটি ফারসি শিলালিপি রয়েছে। এসবের মাধ্যমে মসজিদের প্রকৃত নির্মাতা ও সময়কাল সম্পর্কে জানা যায়। বিদায়ি সুলতানি আর নবাগত মোগল উভয় রীতির সংমিশ্রণে অপূর্ব এক মুসলিম স্থাপত্য, যা দৃষ্টিনন্দন ও এ অঞ্চলে বিরল।
মসজিদের ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন আহাম্মদ জানান, ২০০১ সালের পর থেকে মসজিদটিতে তেমন কোনো সংস্কার কাজ করা হয়নি। বিভিন্ন অংশে শ্যাওলা জমে কালো হয়ে গেছে। দেয়ালের কিছু ইট-বালিও খসে পড়ছে। দ্রুত মসজিদটির সংস্কার কাজ করা দরকার।
জিএম/পি
মন্তব্য করুন