‘আমার বাচ্চার বাপরে কিতা মারলা, এখন আমি কিতা করমু’
আমার বাচ্চার বাপরে কিতা মারলা। আমার বাচ্চা নিয়া এখন আমি কিতা করমু। আমি অসহায়। এভাবেই বিলাপ করছিল সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) কোতোয়ালি থানাধীন বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে নিহত রায়হান উদ্দিন আহমদের (৩৩) স্ত্রী তাহমিনা আক্তার। রাহনুমা আক্তার নামের দুই মাস বয়সী একটি কন্যাসন্তান রেখে গেছেন রায়হান।
অপরদিকে ছেলের মৃত্যু কিছুতে মানতে পারছেন না রায়হানের মা। তিনি বলেন, ‘যদি আমার ফুয়া ফাঁসিরও আসামি হতো, আমার ফুয়া যদি ছিনতাইকারী হইতো তাইলে তোর বিচার হইতো। কিন্তু তারে তো মার্ডার করা হইছে। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই। নাইলে আরও কত মায়ের কোল খালি হইবো।’
শনিবার রাতে রায়হানকে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে ১০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করে পুলিশের কয়েকজন সদস্য। ফোনে পরিবারের সদস্যদের টাকা নিয়ে আসতে বলেন রায়হান। রোববার সকালে ৫ হাজার টাকা নিয়ে তার পরিবারের সদস্যরা থানায় গিয়ে জানতে পারেন, অসুস্থ হয়ে পড়ায় রায়হানকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সেখানে গিয়ে শোনেন রায়হান মারা গেছেন। পরে রায়হানকে হত্যার অভিযোগে রোববার রাত আড়াইটায় কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন নিহত রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি। প্রথমে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় থানার এসআই আবদুল বাতেনকে। পরে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন- পিবিআইকে।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, গত শনিবার বিকেল ৩টায় রায়হান আহমদ কর্মস্থল নগরীর স্টেডিয়াম মার্কেটস্থ ডা. গোলাম কিবরিয়া ও ডা. শান্তা রাণীর চেম্বারে যান। রাত ১০টার পর রায়হান বাসায় না ফেরায় তার মোবাইলে ফোন দেয়া হয়। তখন তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। ভোর সোয়া ৪টার দিকে অন্য একটি নম্বর থেকে রায়হান তার মায়ের কাছে ফোন দেন। তখন রায়হান জানান, তিনি বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আছেন। তাকে বাঁচাতে টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে আসতে। রায়হানের চাচা হাবিবুল্লাহ ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে যান। তখন একজন পুলিশ সদস্য বলেন, রায়হান ঘুমিয়ে গেছে। আর যে পুলিশ সদস্য রায়হানকে ধরে নিয়ে এসেছেন তিনিও বাসায় চলে গেছেন। ওই পুলিশ সদস্য রায়হানের চাচাকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ফাঁড়িতে আসার কথা বলেন। পরে পুলিশের কথা অনুযায়ী হাবিবুল্লাহ আবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে ফাঁড়িতে যান। তখন দায়িত্বরত পুলিশ তাকে জানান, রায়হান অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে ওসমানী মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে। রায়হানের চাচা ওসমানী হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারেন, রায়হানকে সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে তিনি মারা গেছেন। এ সময় হাবিবুল্লাহ পরিবারের অন্য সদস্য ও আত্মীয়স্বজনকে খবর দিলে তারা গিয়ে ওসমানী মেডিকেলের মর্গে রায়হানের ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ দেখতে পায়।
আরও পড়ুন:
ফাঁড়িতে নির্যাতনে যুবকের মৃত্যুর অভিযোগ, পুলিশ বলছে গণপিটুনি
সিলেটে রায়হান হত্যা: সিসিটিভিতে গণপিটুনির প্রমাণ নেই
পালিয়ে গেছেন বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আকবর (ভিডিও)
রায়হান হত্যা: ‘নায়ক’ থেকে ‘বহুরূপীতে’ এসআই আকবর
এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, ‘তার স্বামীকে কে বা কারা বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে গিয়ে পুলিশি হেফাজতে রেখে হাতপায়ে আঘাত করে এবং হাতের নখ উপড়ে ফেলে। পুলিশ ফাঁড়িতে রাতভর নির্যাতনের ফলে তার স্বামী মারা গেছেন।’
এদিকে এ ঘটনায় প্রথমে পুলিশ দাবি করেছে, নগরীর ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাষ্টঘর এলাকায় ছিনতাইয়ের সময় গণপিটুনিতে নিহত হন রায়হান। তবে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের দেয়া তথ্যমতে, তদন্ত কমিটি সিসিটিভির ফুটেজে দেখেছেন ভোররাত ৩টার দিকে। দুটো সিএনজি অটোরিকশা বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির সামনে এসে থামে। সেখানে পুলিশের সঙ্গে রায়হানকেও পায়ে হেটে ফাঁড়িতে ঢুকতে দেখা যায়। আবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে রায়হানকে দুজন কাঁধে করে বের হয়ে সিএনজিতে উঠায়।
রায়হানের মৃত্যুর জন্য বন্দরবাজার ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যদের দায়িত্বহীনতার প্রমাণ পাওয়ায় গতকাল সোমবার বিকেলে ওই ফাঁড়ির দায়িত্বরত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ চার পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। প্রত্যাহার করা হয় আরও তিন সদস্যকে।
সাময়িক বরখাস্ত হওয়া অন্য পুলিশ সদস্যরা হলেন- বন্দরবাজার ফাঁড়ির কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, তৌহিদ মিয়া ও টিটু চন্দ্র দাস।
প্রত্যাহার হওয়া তিন পুলিশ সদস্য হলেন- সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আশেক এলাহী, এএসআই কুতুব আলী ও কনস্টেবল সজিব হোসেন।
অন্যদিকে এ ঘটনার পর এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া লাপাত্তা। তার মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় সন্দেহ করা হচ্ছে তিনি পালিয়ে গেছেন। তবে তদন্তে যার নাম পাওয়া যাবে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে বলে জানিয়েছেন সিলেট কোতোয়ালি থানা পুলিশ।
এদিকে রায়হান হত্যার প্রতিবাদে আজও সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় মানববন্ধন করেছে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ।
এসএস
মন্তব্য করুন