চিকিৎসা ছাড়া ১৭ বছর পার করেছে কিশোরী রোকেয়া
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ডিঙ্গামানিক ইউনিয়নে অজানা রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০ বছরের এক কিশোরী অসহায় জীবন-যাপন করছেন ১৭ বছর যাবৎ। শনিবার বিকালে নড়িয়া উপজেলার ডিঙ্গামানিক ইউনিয়নের মধুপুর গ্রামে তার বাড়ীতে গিয়ে জানা যায়, অসহায় কিশোরী রোকেয়া আক্তারের জীবন কাহিনী।
২০ বছর আগে জন্ম নেয়া অজানা রোগাক্রান্ত রোকেয়া আক্তারকে দেখতে অনেকটা ৮ থেকে ৯ বছরের শিশুর মতো। চেহারা ও শরীরের গঠন জীর্ণ-শীর্ণ। শরীরের গঠন প্রায় কঙ্কালের মতো। অথচ তার বয়স ২০ বছর। ২০ বছরের এই কিশোরী, জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ভিক্ষাবৃত্তি করে কোনমতে অতিবাহিত করছেন অসহায় জীবন। মেয়েটির মা-বাবা কেউ বেঁচে নেই। বর্তমানে মেয়েটি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ডিঙ্গামানিক ইউনিয়নের শেষ বর্ডার মধুপুর গ্রামে তার এক চাচার আশ্রয়ে আছেন। তার এই অসহায় জীবনের বর্ণনা শুনে অনেকেরই শিউরে উঠেন।
গ্রামবাসী ও স্বজনদের ভাষ্যমতে, রোকেয়ার জন্ম ২০০০ সালে। রোকেয়া জন্মের তিন বছর পর ২০০৩ সালে হঠাৎ ঠাণ্ডা-জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এর পর দীর্ঘদিন শ্বাসকষ্টে ভোগেন তিনি। এরই মধ্যে হঠাৎ করে ২০০৪ রোকেয়ার মা পিয়ারা বেগম মারা যান। তখন থেকে তার দুঃখ-দুর্দশা দিনদিন আরও বাড়তে থাকে। সেই সাথে ধীরে ধীরে আরও বাড়তে থাকে তাঁর অসুস্থতা। একপর্যায়ে তার শারীরিক গঠন বৃদ্ধিও হয় বাধাগ্রস্ত এবং ধীরে ধীর তাঁর শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হতে থাকে। এদিকে হতদরিদ্র বাবা আলম শেখ টাকার অভাবে মেয়ের কোন প্রকার চিকিৎসা করাতে পারেননি। উল্টো আরও অসুস্থ মেয়ের চিকিৎসা ও সংসার চালাতে বিক্রি করেছেন ভিটে-মাটি সব।
এরই মাঝে ২০১০ সালে রোকেয়ার মানসিক প্রতিবন্ধী বড় বোন সীমা আক্তার (২৫) হন নিখোঁজ। অপরদিকে ২০১৬ সালের দিকে রোকেয়ার বাবা আলম শেখ মারা যান। এবার চিরতরে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ের অসহায় রোকেয়া আক্তার। অবশেষে আশ্রয় মিলে দরিদ্র চাচা কালাচাঁন শেখ এর ঘরের বারান্দায়। আশ্রয় পেলেও খাবারের জোগান নিয়ে দুশ্চিন্তায় রোকেয়া। কিভাবে চলবে তাঁর জীবন। ভেবে ভেবে কোন উপায় আন্তর না পেয়ে অবশেষে বাধ্য হয়ে হাতে তুলে নিয়েছে ভিক্ষার থালা। তার পর থেকে স্থানীয় ডিঙ্গামানিক ও কার্তিকপুর বাজারে ভিক্ষা করতে শুরু করেন রোকেয়া। এই ভাবে নানা অভাব অনটন আর দুঃখ কষ্টে কোনমতে চলছে রোকেয়ার জীবন। অজানা দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে জীবন মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে পার করলেন ১৭টি বছর। অর্থের অভাবে আজও করাতে পারেননি কোন চিকিৎসা। যাওয়ার সুযোগ হয়নি ডাক্তারের কাছে। কারো কোন সহযোগিতা না পাওয়ায় জোটেনি চিকিৎসা।
দারিদ্রতা আর টাকা-পয়সার অভাবে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটি। কোন ভাবেই করাতে পারছেনা চিকিৎসা। তাছাড়া এখননো জানতেই পারেনি সে কি রোগে আক্রান্ত হয়েছে তাও কেউ জানে না।
আরটিভি অনলাইনকে রোকেয়া বলেন, আমি আমার চাচার ঘরে থাকি। আমি অনেক অসুস্থ। সরকারের কাছে আমার দাবী, আমাকে যেন চিকিৎসা করানো হয়। আমার থাকার মতো কোন ঘর নাই। সরকার যদি আমাকে একটি ঘর করে দেয় তাহলে আমার থাকতে সুবিধা হয়। আমার চাচার ঘর অনেক উঁচু। ঘর উঠতে নামতে আমার অনেক কষ্ট হয়। ঘরের পিড়া বেয়ে গাছ বা ঘরের কাঠ ধরে নামতে হয়। আমার চাচা-চাচী, চাচাতো ভাই-বোন ও এলাকার সবাই আমাকে অনেক ভালবাসেন আদর করেন। অনেকে আদর করে খাবার দেয়, টাকা দেয়।
চাচা কালাচাঁন শেখ বলেন, আমি গরীব মানুষ বাজান, আমার নিজেরই সংসার চালাতে পারিনা। আমি কিভাবে ওর চিকিৎসা করাইমু। তবুও রোকেয়া আমার কাছে আমার সন্তানের মতোই আছে। আমার ছেলেরা কিছু টাকা পয়সা দেয় তা দিয়েই আমার সংসার চলে। সরকার যদি কোন সহযোগিতা করতো তাইলে, ডাক্তার দেহাইতে পারতাম। মেয়েটা অনেক কষ্ট করে। ওর মা বাবা কেউ নাই। আমার ঘরের বারান্দায় থাকে। এতে আমাদের সমস্যা হয় তবুও থাকতে দিছি। কারণ আমরা থাকতে না দিলে ওর তো আর যাবার কোন জায়গা নাই। কার্তিকপুর বাজারে সারাদিন ভিক্ষা করে। কেউ কিছু খাইতে দিলে খায় না দিলে না খেয়ে থাকে। মানুষের কাছে চেয়ে বা ভিক্ষা করে যা পায়, তা দিয়েই কোনমতে চলে। রাতে আমাদের সাথে খায়। এই অবস্থায় সরকারের কাছে দাবী জানাই। সরকার যাতে এই অসহায় মেয়েটার দায়িত্ব নেন।
শনিবার কার্তিকপুর বাজারে গিয়ে দেখা হয় রোকেয়ার সাথে। তখন দেখা যায়, রোকেয়া বিভিন্ন দোকানে ও ব্যক্তির কাছে ভিক্ষা চাইছেন এবং খাবার চেয়ে খাচ্ছেন। পরে ডিঙ্গামানিক ইউনিয়ন ৫নং ওয়ার্ডের মধুপুর গ্রামে মেয়েটির আশ্রয় স্থলে গেলে কথায় হয় তার চাচাতো বোন তাছলিমা আক্তারের সাথে। তখন তিনি জানান, রোকেয়ার আপনজন বলতে আমরা ছাড়া আর কেউ নাই। আমরা ওকে আমার আপন বোনের মতোই আগলে রেখেছি। ওকে আমরা ভিক্ষা করতে মানা করি, কিন্তু রোকেয়া কিছুতেই শোনে না। অনেক সময় আমাদের কাছে না বলেই চলে যায়। ওর ব্যাবহার ভাল এবং অসহায় দেখে অনেকেই ওকে নগদ টাকা ও খাবার দেয়। আমার বাবা বৃদ্ধ মানুষ। আমরা গরীব মানুষ, ভাইদের টাকায় কোনমতে আমাদের সংসার চলে। এই অবস্থায় ওর ভরন-পোষণ ও চিকিৎসার খরচ বহন করা আমাদের পক্ষে কষ্টকর। নিজেদের চোখের সামনে ওর এমন কষ্ট দেখে আমাদের ভাল লাগে না, আমাদেরও কষ্ট হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় ওর এমন কষ্ট আর সমস্যা দেখেও কিছুই করতে পারছিনা। এটা আমাদের জন্য আরও বেদনা দায়ক। রোকেয়া এ পর্যন্ত সরকারি কোন সাহায্য সহযোগিতাও পায় না। কত প্রতিবন্ধী, অসহায় মানুষ সরকারি ভাবে কত সাহায্য সহযোগিতা পায় রোকেয়া তাও পায় না। ওকে যদি একটা প্রতিবন্ধী ভাতা’র কার্ড করে দেয়া হতো, তাহলে মেয়েটার অনেক বড় উপকার হতো।
রোকেয়ার প্রতিবেশী চাচী লক্ষ্মী বিবি জানান, রোকেয়া ছোট বেলা থেকেই অসুস্থ। ওর যখন ৪ বছর বয়স, তখন ওর মা মারা যায়। এর পর ওর বাবা আলম শেখ আবার নতুন করে বিয়ে করেন। সেই সংসারে ওর দুইটা ভাই জন্ম নেয়। সেই দুই ভাইকে ছোট রেখে রোকেয়ার বাবা কে ডিভোর্স দিয়ে চলে যায়। এর ৪ থেকে ৫ বছর পরে ওর বাবাও মারা যান। সে সময় রোকেয়া দিনদিন আরও অসুস্থ হতে থাকে। একদিকে রোকেয়া অসুস্থ, অন্যদিকে ছোট দুই ভাইকে নিয়ে বিপাকে পড়ে যান চাচা কালাচাঁন শেখ। পরে আর কোন উপায় আন্তর না দেখে ওর চাচা-চাচী ভাই দুইটাকে অন্য মানুষের কাছে পালক (দত্তক) দিয়ে দেন। আর রোকেয়াকে রেখে দেন তাদের সাথে। ওর চাচা-চাচী রোকেয়াকে ভালই জানেন।
রোকেয়ার এক প্রতিবেশী চাচী জানান, এলাকার চেয়ারম্যান-মেম্বার গণ্যমান্য অনেকেই ওর এই সমস্যার কথা জানেন। তবুও এখন পর্যন্ত কেউ এগিয়ে আসেনি ওর সহযোগিতার জন্য। মেয়েটা অনেক কষ্টে আছে। ওর থাকার জায়গা জমি কিছুই নাই। এমনকি থাকার মতো একটা ঘরও নাই। এই অবস্থায় সরকার যদি ওর পাশে দাঁড়ায় তাহলে মেয়েটা উপকৃত হবে। তা না হলে এভাবেই হয়তো একদিন অনাদরে-অবহেলায় তাকে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে।
রোকেয়ার আশ্রয় দাতা চাচা কালাচাঁন শেখ বলেন, আমার ভাই আলম শেখ (রোকেয়ার বাবা) মারা যাওয়ার পর থেকে রোকেয়া আমাদের কাছেই আছে। আমি ওকে আমার মেয়ের মতই জানি। ওর মা মারা যাওয়ার পর ওর বাবা আবার বিয়ে করে জায়গা জমি যা ছিল ওদের তা সবই বিক্রি করে গেছে। বাড়িতে সামান্য কিছু জায়গা আছে, তাও আবার অন্য লোকজন তাদের নামে গোপনে রেকর্ড করায়ে নিয়ে গেছে। সে জায়গা উদ্ধার করতে না পারলে কিছুই থাকবে না। এছাড়া দোকানের মতো ছোট একটি টং ঘর আছে। তা ডোবার মাঝে পড়ে আছে। ওখানে থাকার মতো কোন পরিবেশ নাই। তাই আমাদের সাথেই, আমাদের ঘরের বারান্দায় থাকে। ও থাকার জন্য একটি চকি (খাট) ছিল তা এ বছর বর্ষা নষ্ট হয়েছে গেছে। তাই এখন মাটিতে ঘুমায়। খাট কিনে দেয়ার মতো তেমন সামর্থ্যও আমার নাই। তবুও চেষ্টা করতাছি কাঠ দিয়ে একটা চকি (খাট) বানায়ে দেবার। ওর বাপের দ্বিতীয় স্ত্রীর সংসারে দুটি ছেলে সন্তান ছিল, তাদের রেখে ওর সৎ মা ওর বাবাকে ফেলে চলে যায়। তার পর ওর ভাই দুইটা অন্য মানুষ খুশি হয়ে পালতে নিয়ে যায়। আমরাও দিয়ে দিয়েছি। কারণ তিন জনের ভরন পোষণ আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তখন আমার ছেলেরাও কোন কাজ কাম করতো না। এসময় অবস্থায় সরকার যদি ওর জন্য আগায়ে আসতো, তাহলে ওর অনেক উপকার হইতো।
ডিঙ্গামানিক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসাইন খান বলেন, এই অসহায় মেয়ে রোকেয়ার ব্যাপারে আমাকে কেউ কিছু জানায়নি। মেম্বার, চৌকিদার (গ্রাম পুলিশ) বা স্থানীয় কেউ যদি আমাকে জানাতো তাহলে ওর জন্য আমি অবশ্যই কিছু এতদিনে করতাম। তার পর এখন যেহেতু আরটিভির মাধ্যমে আমি মেয়েটির বিষয়ে জানতে পেরেছি। আমি যত দ্রুত সম্ভব আমার ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে সাহায্য সহযোগীর ব্যবস্থা করবো। এছাড়া আমি ব্যাক্তিগতভাবেও সহযোগিতা করবো। এলাকার সবাই জানেন এবং দেখেন আমি সব সময় মানুষের কল্যাণে আমার টাকা পয়সা ব্যয় করি। ওর জন্যও করবো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নড়িয়া উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. মোমিনুর রহমান আরটিভি অনলাইনকে বলেন, আমরা আরও দেড় মাস আগে মেয়েটির কথা জানতে পারি এবং তখনি ওর খোজ খবর নেই এবং ওকে কোন ক্যাটাগরিতে প্রতিবন্ধী ভাতা দেয়া যায় সে ব্যাপারে ডাক্তারি রিপোর্টের অপেক্ষায় আছি। ডাক্তারের রিপোর্ট পেলেই আমরা তাকে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিবন্ধী ভাতার আওতায় নিয়ে আসব। এছাড়া দু-একদিনের মধ্যে আমরা ইউএনও মহোদয়কে নিয়ে ওর বাড়িতে যাব। ওর খোজ-খবর নিয়ে আসবো এবং তখন আমরা ওকে কিছু আর্থিক সহায়তা দিবো। এর বাইরেও আমরা ওর চিকিৎসা সেবার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে অনুরোধ করেছি। তারা দেখার পর যে সিদ্ধান্ত দিবে সে অনুযায়ী দিবো। প্রয়োজনে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে আমরা ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করবো।
নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানভীর আল-নাসীফ, আরটিভি অনলাইনকে জানান, এই মেয়েটির অনেক বছর যাবৎ রোগাক্রান্ত অবস্থায় আছেন। প্রথমদিকে তাঁর হাতে পায়ে পানি চলে আসছিল। রোকেয়ার বাবা মা কেউ না থাকায় চাচা কালাচাঁন শেখ তখন ওকে ঢাকার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। সে সময় ডাক্তারের দেয়া ঔষধ খাওয়ার পর থেকে তার শরীরের পানি শুকিয়ে ক্রমশ চিকন হয়ে যেতে থাকে। তার পর থেকেই মেয়েটির অবস্থা এমন হয়ে যায়। বাবা মা না থাকায় পরবর্তীতে আর চিকিৎসা করানো হয় না। এভাবেই চলতে থাকে। তবে ইতোমধ্যে আমরা সরকারি ভাবে তাকে সাহায্য সহযোগিতা ও প্রতিবন্ধী ভাতা দেয়ার জন্য উদ্যোগ নিয়েছি। এর পাশাপাশি সমাজ সেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে চিকিৎসা করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। চলমান দুর্গা পূজার ব্যস্ততার পর, খুব শিগগিরই ঢাকা নিয়ে সরকারি ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা করানো হবে। এছাড়া রোকেয়ার বাকি জীবনে সরকারিভাবে সব ধরনের সহযোগিতা দেয়া হবে।
জিএ
মন্তব্য করুন