জয়পুরহাটে হঠাৎ করেই বেড়েছে অস্বাভাবিক ও দীর্ঘমেয়াদী জ্বরসহ টাইফয়েড রোগের প্রকোপ। গেল বছরগুলোতে স্বাভাবিক ওষুধে ২ থেকে ৩ দিনে জ্বর ভালো হলেও এ বছর এ জ্বরের মেয়াদ থাকছে দীর্ঘদিন। বাধ্য হয়ে রোগীরা ভর্তি হচ্ছেন সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। রোগের কারণ নির্ণয় করতে পারলেও রোগীদের সংখ্যার সুষ্পষ্ট কোনো তথ্য বা পরিসংখ্যান নেই জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে।
এতো দিন সর্দি-জ্বর রোগ মৌসুমী জলবায়ু বা আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে হতো বলে জানা গেছে। সর্দি-জ্বর-কাশি হলে অধিকাংশ মানুষ সাধারণত কোন ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনে অথবা স্থানীয় কোনো পল্লী চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খাওয়া হতো। তবে এ বছর সর্দি-কাশি তেমন না হলেও দীর্ঘমেয়াদি জ্বরের কারণে ওষুধ বিক্রি কয়েকগুণ বেড়ে গেছে বলে জানালেন ওষুধ ব্যবসায়ীরা।
টাইফয়েড জ্বরে জয়পুরহাট আধুনিক জেলা হাসপাতালেগুলোতে শিশু রোগীদের চাপ বেড়েছে। প্রতিদিনই চিকিৎসা নিতে প্রায় ৫০ জন আক্রান্ত শিশু ও বিভিন্ন বয়সের রোগীরা ছুটে আসছেন জেলা সদরের আধুনিক হাসপাতালে। গড়ে ভর্তি থাকছেন ১০০ থেকে ১২০ জন রোগী। গত ১৫ দিনে টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ১২শ’ শিশু জয়পুরহাট আধুনিক জেলা হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়েছে। এতে করে হাসপাতালের ২২ বেডে শিশু ওয়ার্ডে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। পানি ও খাবারে সমস্যার কারণেই পানিবাহিত এ রোগের প্রাদুর্ভাব দাবি শিশু বিশেষজ্ঞের।
জেলার ৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বিভিন্ন ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আক্রান্ত রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগ রোগী নিয়ে জয়পুরহাট আধুনিক জেলা হাসপাতালে আসছেন তাদের স্বজনেরা। হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় নির্ধারিত ওয়ার্ডে স্থান সংকুলান না হওয়ায় বাধ্য হয়ে রোগীদের অধিকাংশকেই হাসপাতালের বারান্দা কিংবা করিডোরের মেঝেতে শয্যা পেতে গাদাগাদি করে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। টাইফয়েডে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে এ হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিক এর প্রকোপ বাড়তে থাকে। আবহাওয়ার তারতম্যের পাশাপাশি অপরিস্কার কারণে ব্যাকটেরিয়া প্রাদুর্ভাব ঘটে। প্রায় প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০ জন রোগী আধুনিক জেলা হাসপাতালে ভর্তি হয়। এদের মধ্যে অধিকাংশই শিশু। পানি, অপরিচ্ছন্ন ও খোলা খাবার খাওয়ার কারণেই এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। হাসপাতালে ভর্তির পর টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত রোগীরা ৭ থেকে ৮ দিন চিকিৎসা নেওয়ার পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, টাইফয়েড জ্বরে স্যালমোনেলা টাইফি নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমণ হয়ে থাকে। জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে ও অন্ত্রনালীতে এই ব্যাকটেরিয়া অবস্থান করে। এই ব্যাকটেরিয়া দূষিত খাবার ও পানি গ্রহণের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে জীবাণুগুলো গুণিতক আকারে বেড়ে গিয়ে রক্তে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে জ্বরসহ নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। এটি প্রাপ্তবয়স্কদের হতে পারে তবে সাধারণত বাচ্চাদের এবং কমবয়সীদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়। মানুষই এই রোগের একমাত্র বাহক।
হাসপাতালেন চিকিৎসা নিতে আসা জয়পুরহাট সদর উপজেলার সগুনা গ্রামের ৯ বছরের শিশু শাহানা ও কাদোয়া ঢোলপাড়া গ্রামের ৫ বছরের সুমাইয়া, আক্কেলপুর উপজেলার জামালগঞ্জ মহব্বতপুর গ্রামের ৯ বছরের সাব্বির হোসেন, সৈকত পাঁচবিবি উপজেলার জীবনপুরের সাদ্দামের অভিভাবকরা আরটিভি নিউজকে জানিয়েছেন, সন্তানদের টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত সাতদিন থেকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের এলাকার প্রায় শিশুরা টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে।
তারা বলেন, ইদানিং প্রায় শিশুদের এই অসুখ হচ্ছে। কেউ হাসপাতালে আসে, আবার অনেকে বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছে। এ জ্বর অনেকদিন যাবত ভোগাচ্ছে। হাসপাতালের বারান্দায় ফ্যানের ব্যবস্থা না থাকলেও প্রচন্ড গরমের মধ্যে গাদাগাদি করে সেবা নিতে হচ্ছে।
হাসপাতাল এলাকার ওষুধ ব্যবসায়ী গাফফার ফার্মেসির স্বত্তাধিকারী গাফফার হোসেন, রোকেয়া ফার্মেসির শরিফুল ইসলাম,জালাল ফার্মেসির জাজাল রব্বানীসহ একাধিক ওষুধ ব্যবসায়ীরা আরটিভি নিউজকে জানিয়েছেন, টাইফয়েড জ্বরের ওষুধ বেশি বিক্রি হচ্ছে। এজন্য কোম্পানিকে এই সংক্রান্ত ওষুধ বেশি বেশি করে দেওয়ার জন্য অর্ডার করছি।
জয়পুরহাট জেলা আধুনিক হাসপাতালের শিশু বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. ফারহানা ইয়াসমিন শিখা আরটিভি নিউজকে জানিয়েছেন, বেশির ভাগ শিশুসহ সব শ্রেণির রোগীই হাসপাতালে আসছে। খোলা খাবার ও পানির কারণে এই রোগ হয়। এজন্য খাবারের আগে হাত সাবান দিয়ে ধৌত করতে হবে। শৌচকাজের পর ছোট থেকে বড় সবারই ভালোভাবে জীবাণুমুক্তকরণ সাবান দিয়ে হাত ধোয়া অত্যন্ত জরুরি। এছাড়াও টাইফয়েড হলে হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে। রোগীদের অতি প্রয়োজনীয় ওষুধসহ সার্বক্ষনিক চিকিৎসা সেবা দিয়ে ২৪ ঘণ্টা তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে পানি ফুটে খেতে হবে।
জয়পুরহাট আধুনিক জেলা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সরদার রাশেদ মোবারক আরটিভি নিউজকে জানিয়েছেন, এই টাইফয়েড রোগ মুখের মাধ্যমে খাবার ও পানির মাধ্যমে এইটা ছড়াই। এই প্রাদুর্ভাবটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। পানি ও খাবারে সমস্যার কারণেই পানিবাহিত এ রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবারের মাত্রাটা বেশি।গত দুই সপ্তাহে টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ১২শ’ শিশুকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। প্রতিনিয়ত এ রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। কয়েকদিনের মধ্যে এর প্রাদুর্ভাব কমে আসবে। তবে চিকিৎসার পাশাপাশি সচেতনভাবে চলাফেরা করতে হবে।
জয়পুরহাট জেলা সিভিল সার্জন ডা. ওয়াজেদ আলী আরটিভি নিউজকে জানিয়েছেন, ব্যাকটেরিয়ার কারণে এর প্রাদুর্ভাব ঘটছে। মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি নেওয়া হয়েছে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। যা অস্বাস্থ্যকর খাবার ও দুষিত পানির মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করে এ রোগের সৃষ্টি করে।
এমআই/এসকে