রাবেয়া বেগম (৫৫)। দীর্ঘদিন চোখে দেখতে পান না ঠিকমত। অন্যের কাঁধে ভর করে চলাফেরা করতে হয় তাকে। চিকিৎসা করাতে পারলে তিনি পুরোপুরি ফিরে পাবেন দুই চোখের আলো। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে সেটি সম্ভব না। এরই মধ্যে মাইকে শোনেন বিনামূল্যে সেবাসহ চোখের সকল প্রকার চিকিৎসা করাচ্ছেন লায়ন ড. ফরিদুল ইসলাম নামের একজন সমাজ সেবক।
খবর শুনেই শুক্রবার (১৭ মে) ভোরে ছেলে মিকাইল সরদারের হাত ধরে বেরিয়ে পড়েন রাবেয়া বেগম। বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার দক্ষিণ চাঁদপাই গ্রাম থেকে রামপাল উপজেলার বড়দিয়া এলাকায় ছুটে আসেন তিনি। এসে দেখেন তার মতো শত শত নারী-পুরুষ চোখের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বিনামূল্যে চিকিৎসা করাতে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সামনে যত্ন করে রোগী দেখছেন কয়েকজন তরুণ চিকিৎসক।
ঢাকা মেগা সিটি লায়ন্স ক্লাবের উদ্যোগে এবং দৃষ্টি উন্নয়ম সংস্থা ও লায়ন ড.শেখ ফরিদুল ইসলামের সহযোগিতায় তিন হাজার মানুষকে বিনামূল্যে চোখের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে সেখানে। ড. ফরিদুলের বাড়িতে বড়দিয়া হাজী আরিফ (রহ:) মাদ্রাসার মাঠে সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই সেবা প্রদান করা হয়। সেবাগ্রহীতাদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয় প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রও।
হারাতে বসা দৃষ্টিশক্তি নিয়ে সেখানে রাবেয়ার মতো লাইন ধরেছেন সখিনা বেগম (৬৬), রজ্জব আলী মোড়ল (৬৭), আবু বক্কর সিদ্দিক শেখ (৬৫), দীন মোহাম্মদ (৭৪), গোনজেরা বেগম (৭০)সহ কয়েকশ নারী-পুরুষ যাদের বেশিরভাগই নিম্নআয়ের মানুষ। রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হচ্ছে তাদের। সুশৃঙ্খলভাবে সেবাপ্রত্যাশীদের নির্দিষ্ট বুথে পৌঁছে দিচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবকরা। বিশৃঙ্খলা এড়াতে করা হচ্ছে মাইকিং। মোট চারটি বুথে এই আই ক্যাম্পের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
রামপাল উপজেলার বাঁশতলী ইউনিয়নের বড়দিয়া গ্রামে রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য এই ক্যাম্পের আয়োজন করা হলেও পুরো রামপাল উপজেলা ছাড়িয়ে মোংলা, মোড়েলগঞ্জ ও বাগেরহাট জেলা থেকেও মানুষজন এসেছেন বিনামূল্যে চোখের উন্নত চিকিৎসা সেবা নিতে। পাঁচজন চিকিৎসকসহ ১৫ জনের একটি বিশেষজ্ঞ টিম এখানে সেবা দিতে আসেন নিয়মিত।
শুক্রবার (১৭ মে) নিজে উপস্থিত থেকে সেবা দেওয়ার সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে দেখা গেছে সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও ঢাকা মেগা সিটি লায়ন্স ক্লাবের সভাপতি লায়ন ড. শেখ ফরিদুল ইসলামকে। তিনি বলেন, আমার জীবনবোধের চিন্তাভাবনা থেকে এই সেবামূলক কার্যক্রম করছি। কারণ আমি বিশ্বাস করি, এই পৃথিবীতে যখন এসেছি, একদিন আবার আমাকে চলে যেতে হবে। পরকালে আমার প্রত্যেকটা কাজের হিসেব দিতে হবে। তাই হতদরিদ্র সাধারণ মানুষের পাশে দাড়িয়ে একটু সেবামূলক কার্যক্রম করছি।
এ সময় তিনি আরও বলেন, বিনামূল্যে চোখের চিকিৎসা দিতে আমরা এখন পর্যন্ত চারটি ক্যাম্প করেছি এখানে। এ উপজেলায় আরো দুটি ক্যাম্প করার ইচ্ছে আছে আমাদের। তাহলে পুরো উপজেলার সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে বিনামূল্যের এই সেবা পৌঁছে যাবে। এই উপজেলায় অনেক অসহায় মানুষ আছেন- যারা জানেও না চোখের ছানির জন্য মানুষ অন্ধ হয়ে যেতে পারে। চোখে কম দেখাসহ অনেকের চোখে সমস্যা রয়েছে কিন্তু তারা বুঝতেও পারেন না চোখে সমস্যা আছে। এমন মানুষদের চোখকে সুস্থ রেখে তাদের মুখে হাসি ফোটাতে এই উদ্যোগ নিয়েছি আমরা।
২০০৯ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত ৬০ হাজার রোগীর বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি ৬ হাজার ২০০ জনের চোখের অপারেশন করা হয়েছে বলেও জানান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম।
বিনামূল্যে উন্নত চোখের সেবা পেয়ে মোংলা উপজেলার সোনাইলতলা গ্রামের রজ্জব আলী মোড়ল (৬৭) বলেন, অনেকদিন চোখ নিয়ে কষ্টে ছিলাম। টাকার জন্য ডাক্তার দেখাতে পারিনি। তারপর এখানে এসেছি। ডাক্তার সাহেবরা ভালোভাবে আমার চোখ দেখছে। এখন বলেছে, আমার চোখের ছানি অপারেশন লাগবে। তারা নিজেরাই আমাকে নিয়ে গিয়ে অপারেশন করিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেবে।
রামপাল উপজেলার মর্জিনা বেগম (৫০) বলেন, টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারি না। আজকে বড় ডাক্তাররা বিনা টাকায় সেবা দিয়েছে, আবার ওষুধও দিয়েছে।
বাঁশতলী গ্রামের গোনজেরা বেগম (৭০) বলেন, চোখে ছানি পড়েছে। ডাক্তাররা বলছে, ঢাকায় নিয়ে অপারেশন করাবে। আমার বাড়িতে দিয়ে যাবে। সব খরচ তাদের। আমি তাদের জন্য দোয়া করি। চোখ নিয়ে অনেক কষ্টে ছিলাম।
আই ক্যাম্পের চিকিৎসক এস এন সাহা বলেন, ঢাকা মেগা সিটি লায়ন্স ক্লাবের ডাকে সাড়া দিয়ে আমরা এখানে এসেছি। আমরা দেশের অনেক জায়গায় আই ক্যাম্প করেছি। তবে রামপাল উপজেলায় বেশি সাড়া পেয়েছি। চিকিৎসা নিয়ে এ এলাকার মানুষের আগ্রহ দেখে ভালো লেগেছে। ভবিষ্যতে দেশের অন্য কোথাও কেউ ডাক দিলে আমরা সেখানে আই ক্যাম্প করতে যাব। আজকের ক্যাম্পে যেসব রোগীদের অস্ত্রোপচার দরকার- তাদের তালিকা করে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করা হয়েছে। ওইসব রোগীকে ‘ঢাকা দৃষ্টি আই’ হাসপাতালে বিনামূল্যে অস্ত্রোপচার করানো হবে। তাদের আসা-যাওয়াসহ অন্যান্য আনুষাঙ্গিক ব্যয়ভার বহন করবেন ঢাকা মেগা সিটি লায়ন্স ক্লাবের সভাপতি লায়ন ড. ফরিদুল ইসলাম।