• ঢাকা শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১
logo

কোথায় যায় পাগলা মসজিদের দানবাক্সের টাকা, খরচ হয় কীভাবে

আরটিভি নিউজ

  ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৩:০৫
কোথায় যায় পাগলা মসজিদের বস্তা বস্তা টাকা, খরচ হয় কীভাবে 
ফাইল ছবি

পাগলা মসজিদ। কিশোরগঞ্জের ইতিহাস-ঐতিহ্যের এক অনবদ্য স্বারক মসজিদটি; দেশ-বিদেশেও রয়েছে সুনাম। প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তরই দেশব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদটি। দানবাক্স খুললেই পাওয়া যায় বস্তা বস্তা টাকা, মিলে স্বর্ণালংকার, বৈদেশিক মুদ্রা ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রীও। শুধু মুসলিমরাই নন, অমুসলিমরাও দুই হাত খুলে দান করেন এ মসজিদে। দানের অর্থ আসে বিদেশ থেকেও।

কিশোরগঞ্জ শহরের হারুয়া এলাকায় অবস্থিত মসজিদটিতে রয়েছে পাঁচতলা উঁচু দৃষ্টিনন্দন মিনার। মসজিদটির সুস্পষ্ট ইতিহাস জানা না থাকলেও জনশ্রুতি আছে, প্রায় ১৫০ বছর আগে প্রমত্তা নরসুন্দা নদীর পানিতে ধ্যানরত এক ভাসমান দরবেশের আবির্ভাব হয়। তার কল্যাণেই নদীর মধ্যে জেগে ওঠে চর। নদীর তীরবর্তী রাখুয়াইল গ্রামের এক গৃহস্থের গাভি নিয়মিত নদী সাঁতরে ওই দরবেশের ভাণ্ডে ওলানের দুধ দিয়ে আসত। এতেই গাভির দরিদ্র মালিক ও স্থানীয় লোকজনের অনেক বৈষয়িক উন্নতি হয়। এমন আরও অসংখ্য কেরামতিতে বিমুগ্ধ মানুষজন ওই দরবেশের খেদমতে হুজরাখানা তৈরি করে। দরবেশের মৃত্যুর পর তার হুজরাখানার পাশেই পাগলা সাধকের স্মৃতিতে নির্মিত হয় এই পাগলা মসজিদ।

আরেক জনশ্রুতি হলো, হয়বতনগর দেওয়ানবাড়ির এক নিঃসন্তান মহিলাকে জনগণ পাগলা বিবি বলে ডাকত। এ মহিলা নরসুন্দার তীরে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে একটি মসজিদ নির্মাণ করলে তা পাগলা বিবির মসজিদ নামে পরিচিতি পায়।

হয়বতনগর দেওয়ানবাড়ির ১০ শতাংশ ওয়াকফ সম্পত্তিতে গড়ে ওঠা পাগলা মসজিদের বর্তমান জমির পরিমাণ ৩ একর ৮৮ শতাংশ। মসজিদের অর্থায়নে গড়ে উঠেছে এতিমখানা ও মাদরাসা। এখানে ছেলেমেয়েদের থাকা-খাওয়া, পোশাকসহ লেখাপড়ার খরচ বহন করা হয় মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে।

১৯৭৯ সাল থেকে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে পাগলা মসজিদের কার্যক্রম চলে আসছে। সেই থেকে পদাধিকার বলে পাগলা মসজিদ কমিটির সভাপতির দায়িত্বপালন করে আসছেন কিশোরগঞ্জের দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসকরা। তার তদারকিতেই হয় মসজিদের অর্থনৈতিক হিসাবনিকাশ। পাগলা মসজিদের বর্তমান কমিটিতে ৩১ সদস্য রয়েছেন। এই মসজিদের দানবাক্সের টাকাতে হয় এলাকার অন্যান্য প্রাচীন মসজিদের সংস্কার ও উন্নয়ন। এলাকার দরিদ্র, অসহায়, অসুস্থ ও অসচ্ছল পরিবারের জন্যও মসজিদ থেকে দেওয়া হয় অনুদান। লেখাপড়া, চিকিৎসা, অভাবী নারীর বিয়ের সময় সাহায্য করা এই মসজিদের গণমুখী কার্যক্রমের অংশ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কিশোরগঞ্জ রূপালী ব্যাংকে পাগলা মসজিদের নামে একটি হিসাব রয়েছে। সেখানেই জমা রাখা হয় মসজিদের আয়ের সব টাকা। তবে, বর্তমানে কত টাকা ওই অ্যাকাউন্টে আছে, এ ব্যাপারে কেউই মুখ খুলতে রাজি হননি। মসজিদ কমিটির দাবি, স্বচ্ছতার সঙ্গে হিসাব রাখা হলেও কৌশলগত কারণে জমা টাকার পরিমাণটি গোপন রাখা হয়। এরপরও ধারণা করা হচ্ছে, বর্তমানে শতকোটি টাকার ওপরে জমা রয়েছে পাগলা মসজিদের ব্যাংক হিসাবে।

পাগলা মসজিদের আয়-ব্যয়ের অডিট করা হয় ওয়াকফ এস্টেটের অডিটর দ্বারা। অডিটের পর প্রতি অর্থবছরে আয়ের ওপর ৫ শতাংশ চাঁদা আদায় করে ওয়াকফ প্রশাসন। আর ব্যাংকে রাখা দানের টাকা থেকে মসজিদ-মাদরাসার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, আনসারের বেতন, বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল বাবদ ব্যয় হয়। এ ছাড়া আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ বছরে প্রায় ৬ লাখ টাকা ব্যয় হয়।

মসজিদ কমপ্লেক্সে প্রতিষ্ঠিত নুরুল কোরআন হাফিজিয়া মাদরাসায় অসহায় পিতৃ-মাতৃহীন শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করে। প্রতি মাসে কয়েক লাখ টাকা শুধু এ শিক্ষার্থীদের খাবারের পেছনে ব্যয় হয়। শিক্ষার্থীদের যাবতীয় ভরণপোষণের ব্যয়ও নির্বাহ করা হয় মসজিদের দানবাক্স থেকে পাওয়া অর্থে। প্রতিবছরই মসজিদের অর্থায়নে নতুন জামাকাপড় দেওয়া হয় তাদের।

দানবাক্স থেকে প্রাপ্ত অর্থের লভ্যাংশের একটি বিশেষ অংশ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত দরিদ্র ও অসহায় মানুষের সহায়তা প্রদানের জন্য অনুদান হিসেবে দেওয়া হয়। ২০২১ অর্থবছরে ১২৪ জন দুরারোগ্য ব্যাধিতে (ক্যানসার, ব্রেন স্ট্রোক, হার্ট স্ট্রোক, কিডনি রোগ, প্যারালাইসিস ইত্যাদি) আক্রান্ত দরিদ্র ও অসহায়কে চিকিৎসা এবং দরিদ্র ও দুস্থ মেধাবী শিক্ষার্থীদের পড়ার খরচ বাবদ ১৭ লাখ ৬৩ হাজার টাকা পাগলা অনুদান দেওয়া হয় মসজিদের ফান্ড থেকে। এ ছাড়া করোনাকালে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে দেওয়া হয় ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

সবশেষ শনিবার (৩০ নভেম্বর) খোলা হলো আলোচিত এ মসজিদটির দানবাক্স। এবার পাওয়া গেছে ২৯ বস্তা টাকা। এই মুহূর্তে টাকা গণনার কাজ চলছে। মসজিদ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য এবং মসজিদ কমপ্লেক্সে অবস্থিত মাদরাসা ও এতিমখানার শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ প্রায় ৩৫০ জনের একটি দল এই ২৯ বস্তা টাকা গণনার কাজে অংশ নিয়েছে।

কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও পাগলা মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ফৌজিয়া খান ও পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরীর উপস্থিতিতে দানবাক্সগুলো খোলা হয়। এ ছাড়াও এ সময় বিপুলসংখ্যক সেনাবাহিনী, পুলিশ ও আনসার সদস্য উপস্থিত ছিলেন।

জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খান জানান, এবার তিন মাস ১৪ দিন পর শনিবার সকালে পাগলা মসজিদের ১১টি দানবাক্স খোলা হয়েছে। এতে ২৯ বস্তা টাকা পাওয়া গেছে। পরে মসজিদের দোতালায় এনে টাকা গণনার কাজ শুরু হয়েছে। তিন মাস পর পর দানবাক্সগুলো খোলা হলেও এবার তিন মাস ১৪ দিন পর দানবাক্সগুলো খোলা হয়েছে। এবারও তাই একটি টিনের ট্রাঙ্ক বাড়ানো হয়েছিল। আশা করা যাচ্ছে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হবে এবার।

এর আগে গত ১৭ আগস্ট পাগলা মসজিদের ১০টি দানবাক্স খোলা হয়েছিল। তখন তিন মাস ২৬ দিনে ৭ কোটি ২২ লাখ ১৩ হাজার ৪৬ টাকা পাওয়া যায়। এছাড়া দানবাক্সে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণালঙ্কার পাওয়া গিয়েছিল।

জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে পাগলা মসজিদে মানুষ দান-খয়রাত করে আসলেও বড় পরিমাণে টাকা পাওয়া শুরু হয় ২০১৫ সালের শুরুর দিকে। তখন ৮টি লোহার সিন্দুক খুলে একসঙ্গে প্রায় ৬৫ লাখ টাকা ও স্বর্ণালংকার পাওয়া যায়। তখনকার সময়ে ছয় মাস পরপর সিন্দুক খোলা হতো। এর পরেরবার পাওয়া গিয়েছিল প্রায় ৭৮ লাখ টাকা। ২০১৬ সালের শেষের দিকে ১ কোটি ১০ লাখ টাকার ওপরে মিলেছিল দানসিন্দুকে। দিন দিন টাকা ও বৈদেশিক মুদ্রা দানের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় এরপর থেকে ছয় মাসের জায়গায় তিন মাস পরপর টাকার সিন্দুক খোলার প্রথা চালু হয়।

প্রতিবার প্রশাসন, ব্যাংক কর্মকর্তা, মসজিদ কমিটির লোকজন, গণমাধ্যমকর্মীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে দানবাক্স খোলা হয়। দিনভর গণনা শেষে ঘোষণা করা হয় দানের টাকার পরিমাণ।

আরটিভি/এসএইচএম

মন্তব্য করুন

Bangal
rtv Drama
Radhuni
  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
৬৩৪ কোটি টাকায় এক লাখ ৩০ হাজার টন সার কিনবে সরকার
ভারতে অনুপ্রবেশের চেস্টাকালে দুই যুবক আটক
দুই কোটি টাকার স্বর্ণের ১৪টি বারসহ তিন ট্রেনযাত্রী আটক
বাংলাদেশি টাকায় আজকের মুদ্রা বিনিময় হার (২৬ ডিসেম্বর)