জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব-৩
উপকূলবাসী সুপেয় পানি সংকটের স্থায়ী সমাধান চায়
নানা কারণে উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটে ক্রমেই সুপেয় পানির সংকট তীব্র হচ্ছে। আর সরকারিভাবে বারবার কৌশল বদল করে অগভীর নলকূপ, গভীর নলকূপ, পিএসএফ, সোলার পিএসএফ, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ট্যাংকি ইত্যাদির মাধ্যমে এই সংকট সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু সুপেয় পানির সংকটের তেমন সমাধান হচ্ছে না। উপকূলবাসী সুপেয় পানি সংকটের স্থায়ী সমাধান চায়।
তবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল সঠিক পরিকল্পনা ও জনসচেতনতার মাধ্যমেই সুপেয় পানির সংকট নিরসন করা সম্ভব।
সূত্রে জানা গেছে, আশির দশকে পুকুরের পানি ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ইউনিসেফের সহযোগিতায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো। সেখানে বলা হতো, সকল কাজে টিউবওয়েলের পানি ব্যবহার করুন। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে যখন এসব অগভীর নলকূপে আর্সেনিক দেখা দিলো তখন টিউবওয়েল পানি ব্যবহার বন্ধ করতে বলা হলো। শুরু হলো গভীর নলকূপ স্থাপন। এভাবে সুপেয় পানির সংকট নিরসনে কখনও অগভীর নলকূপ, কখনও গভীর নলকূপ, কখনও পিএসএফ (পন্ড স্যান্ড ফিল্টার) ইত্যাদি স্থাপন করা হয়। আর সারাদেশের চেয়ে উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের চিত্র ব্যতিক্রম। এই জেলায় ক্রমেই প্রকট হচ্ছে সুপেয় পানির সংকট।
বর্তমানে বাগেরহাট জেলার খাবার পানির উৎস সমূহ হলো- গভীর নলকূপ, অগভীর নলকূপ, রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং প্লান্ট, পিএসএফ, কমিউনিটি নলকূপ ও রিভার্স অসমোসিস। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে এসব স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে কিছু সফল, আর কোনটি একেবারেই ব্যর্থ হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিস সূত্রে জানা গেছে, বাগেরহাটে অগভীর নলকূপের পানি এখন আর তেমন ব্যবহার করা যায় না। তাই সরকারিভাবে এটি স্থাপন বন্ধ রয়েছে। গভীর নলকূপ একবার স্থাপন করলে দীর্ঘদিন এটি ব্যবহার করা যায়। তবে জেলার বেশির ভাগ এলাকায় এটি সফল ভাবে স্থাপন করা যায় না। আবার কোথাও কোথাও এটির পানিও ব্যবহার উপযোগী হয় না। তাছাড়া কিছু গভীর নলকূপ লবনাক্ততাসহ নানা কারণে ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
পুকুর পাড়ে তৈরি করা হয় পিএসএফ বেশির ভাগ তদারকির অভাবে অকেজো হয়ে যায়। সরকারিভাবে তদারকি করার ব্যবস্থা না থাকা এবং জনসচেতনতার অভাবেই এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়। প্রয়োজনে পানি নিলেও এটি রক্ষণাবেক্ষণ কেউ করতে চায় না। সোলার চালিত পিএসএফগুলিও বেশির ভাগ অকেজো। এজন্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মানহীন যন্ত্রপাতি সরবরাহকেও দায়ী করেন অনেকে।
সুপেয় পানির সংকট নিরসনে সরকারিভাবে পুনঃখনন করা ১৫৫টি পুকুরে স্থানীয়রা কথিত লিজের নামে চাষ করে পানি ব্যবহারের অনুপযোগী করে ফেলেছে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীরা।
২০২০ সালে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে বাগেরহাটের উপকূলীয় উপজেলা রামপাল ও মোংলায় ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে বানানো হয়েছিল ‘স্বয়ংক্রিয় সৌরচালিত পানি বিশুদ্ধিকরণ ইউনিট’।
স্থানীয়দের আশা ছিল, এবার প্রাণভরে মিষ্টি পানি পান করতে পারবেন। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির কারণে এক লিটার পানিও পাননি উপকূলবাসী। এভাবে একের পর এক ভেস্তে গেছে সুপেয় পানি সরবরাহে সরকারি উদ্যোগ। উপকূলবাসী চান স্থায়ী সমাধান।
এ বিষয়ে ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের খুলনা অঞ্চলের সমন্বয়কারী নুর আলম শেখ বলেন, উপকূলে সুপেয় পানির সংকট ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। এজন্য স্থায়ী সমাধান এখন সময়ের দাবি। সরকারী পুকুরগুলি পুনঃখনন এবং সরকারী খাসজমিতে পুকুর খনন করে, পানি সংরক্ষণ ও বিশুদ্ধ করে পাইপলাইনের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি সরবরাহ করা যেতে পারে।
বাগেরহাট জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী জয়ন্ত মল্লিক বলেন, নানা কারণে সুপেয় পানির জন্য সরকারের নেওয়া সব পদক্ষেপ সফল হয়নি। সবার আগে প্রয়োজন জনসচেতনতা। বাগেরহাটে সুপেয় পানির সংকট নিরসনে সীমিত পরিসরে গভীর নলকূপ স্থাপন, পুকুরগুলি পুনঃখনন করে সেখানে সারফেজ ওয়াটার তৈরি ও পিএসএফ এর মাধ্যমে পানি বিশুদ্ধ করা যেতে পারে।
কমিউনিটি, গ্রোথসেন্টার, বাজার এলাকা রিভার্স অসমোসিস প্লান্ট তৈরি করে লবণ পানি পরিশোধন করে চাহিদা মেটানো যেতে পারে। তবে এটি ব্যয়বহুল। পানি শোধন করে পাইপ লাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা যেতে পারে। সর্বশেষ রেইন ওয়াটার হারভেস্টার ভালো একটি ব্যবস্থা। ৩ হাজার লিটারের একটি ট্যাংকি দিয়ে ৪-৫ জনের একটি পরিবার সারা বছর চলতে পারে। তবে সব পদক্ষেপ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে জনসম্পৃক্ততা প্রয়োজন বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।
আরটিভি/এএএ/এস
মন্তব্য করুন