সীমান্তে ফেলানী হত্যা: ১৪ বছরেও বিচার পাননি মা-বাবা
‘আমার চোখের সামনে মেয়েটাকে পাখির মতো গুলি করে মারছে বিএসএফ। কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখছে। মেয়েটা পানি পানি করতে করতে ছটফটাইয়া মারা গেছে। এক ফোঁটা পানি দেয় নাই বিএসফ। অথচ খুনি বিএসফ অমিয় ঘোষের বিচার করলো না ভারত সরকার। এইটা কোন বিচার হইলো, এইটা কোন ধরনের কোর্ট। একজন মানুষ খুন কইরাও পার পায়। এমন বিচার দেখি নাই।’
সোমবার (৬ জানুয়ারি) এমন ভাবেই আক্ষেপ করে বলছিলেন সীমান্তে বিএসএফের হাতে হত্যার শিকার কিশোরী ফেলানীর বাবা।
আজ ৭ জানুয়ারি। সীমান্তে কিশোরী ফেলানী হত্যার ১৪ বছর। ২০১১ সালের এই দিনে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীর অনন্তপুর সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ-র গুলিতে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হয় নাগেশ্বরী উপজেলার রামখানা ইউনিয়নের কলোনীটারী গ্রামের নূরুল ইসলামের কিশোরী মেয়ে ফেলানী। দীর্ঘ সাড়ে চার ঘণ্টা কাঁটাতারে ঝুলে থাকে ফেলানীর মৃত দেহ। গণমাধ্যমসহ বিশ্বের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে ভারত। পরে বিএসএফ এর বিশেষ কোর্টে দুই দফায় বিচারিক রায়ে খালাস দেয়া হয় অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে। এ রায় প্রত্যাখ্যান করে ভারতীয় মানবাধিকার সংগঠন মাসুম এর সহযোগিতায় ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টে রিট আবেদন করে ফেলানীর পরিবার। কিন্তু ১৪ বছরেও এ হত্যার সুষ্ঠু বিচার পায়নি ফেলানীর পরিবার।
কলোনীটারী গ্রামের দরিদ্র নুরুল ইসলাম পরিবার নিয়ে কাজ করতেন ভারতের বঙ্গাইগাঁও এলাকায়। নূরুল ইসলামে বড় মেয়ে ফেলানীর বিয়ে ঠিক হয় বাংলাদেশে। বিয়ের উদ্দেশে নিজ দেশে আসতে গিয়ে ৭জানুয়ারী শুক্রবার ভোর ৬টা ফুলবাড়ির অনন্তপুর সীমান্তে মই বেয়ে কাঁটাতার টপকানোর চেষ্টা করে ফেলানী। এসময় ভারতীয় বিএসএফ’র গুলিতে বিদ্ধ হয় সে। গুলিবিদ্ধ হয়ে আধাঘণ্টা ধরে ছটফট করে নির্মমভাবে মৃত্যু হয় কিশোরী ফেলানীর। এর পর সকাল পৌনে ৭টা থেকে নিথর দেহ কাঁটাতারে ঝুলে থাকে দীর্ঘ সাড়ে ৪ঘন্টা। এ ঘটনায় বিশ্বব্যাপী তোলপাড় শুরু হলে ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট ভারতের কোচবিহারে জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্টে ফেলানী হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়। বিএসএফ এর এ কোর্টে সাক্ষী দেন ফেলানীর বাবা নূর ইসলাম ও মামা হানিফ। ওই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর আসামী অমিয় ঘোষকে খালাস দেয় বিএসএফ এর বিশেষ কোর্ট। পরে রায় প্রত্যাখ্যান করে পুন:বিচারের দাবী জানায় ফেলানীর বাবা। ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পূর্ন:বিচার শুরু হলে ১৭ নভেম্বর আবারও আদালতে সাক্ষ্য দেন ফেলানীর বাবা। ২০১৫ সালের ০২ জুলাই এ আদালত পুনরায় আত্মস্বীকৃত আসামী অমিয় ঘোষকে খালাস দেয়। রায়ের পরে একই বছর ১৪ জুলাই ভারতের মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম) ফেলানীর বাবার পক্ষে দেশটির সুপ্রিম কোর্টে রিট পিটিশন করে। ওই বছর ৬ অক্টোবর রিট শুনানি শুরু হয়। ২০১৬, ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে কয়েক দফা শুনানি পিছিয়ে যায়। পরে ২০২০ সালের ১৮ মার্চ করোনা শুরুর আগে শুনানির দিন ধার্য হলেও শুনানি হয়নি এখনো।
তবে আজ ৭ জানুয়ারি শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে বলে জানতে পেরেছে ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম। এদিকে মেয়ের হত্যাকারীর বিচার না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ফেলানীর পরিবার।
ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম বলেন, ১৪ বছর অপেক্ষা করেছি ফেলানী হত্যার বিচারের জন্য। আজ পর্যন্ত বিচার পেলাম না। মেয়েটার মুখ চোখে চোখে ভাসে। কি কষ্টটা পাইয়া আমার মেয়েটা মারা গেছে। মরার আগে একটু পানি চাইলেও তারা পানি দেয় নাই। ভারত সরকার খুনিকে খালাস দিছে। সে সময় হাছিনা সরকার এ বিচার চায় নাই। সরকার যদি বিচারটা চাইতো তাহলে বিচারটা হইতো। ফেলানী হত্যার বিচারটা হইলে এখন আর সীমান্তে মানুষ মরতো না। ফেলানী মরার পর সরকারের কত মানুষ বাড়িতে আসতো। এটা দিবে সেটা দিবে। কিন্তু তিন লাখ টাকা ছাড়া কিছুই দেয় নাই। আগে ফেলানীর মৃত্যু বার্ষিকী পালন করা হলেও গত বছর থেকে সেটাও হচ্ছে না। নুতুন সরকারের কাছে দাবী যাতে ফেলানী হত্যার বিচারটা পাই। মরার আগে মেয়ে হত্যার বিচার দেখে যেতে চাই।
ফেলানীর মা জাহানারা বেগম বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ফেলানী হত্যার বিচার পাই নাই। নুতুন সরকার যেন বিচারটা করে দেয়। মেয়ে হত্যার বিচারটা যেন পাই।
ফেলানী হত্যার আইনি কার্যক্রমে নুরুল ইসলামের সহায়তাকারী কুড়িগ্রামের আইনজীবী এস,এম,আব্রাহাম লিংকন জানান, ভারতের সুপ্রিম কোর্টে ফেলানী হত্যার রিট আবেদনটির শুনানি ৭ জানুয়ারি হতে পারে। এ রিট আবেদনটি নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। ফেলানই হত্যার বিচারের মধ্য দিয়ে সীমান্তে দুই দেশের নাগরিকরা সুরক্ষিত হবে।
আরটিভি/এসএপি
মন্তব্য করুন