শিক্ষার্থীশূন্য বিদ্যালয়, গল্প করে সময় কাটে শিক্ষকদের
কাজির গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই! বহুল প্রচলিত এই প্রবাদ ফিরে এসেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার চম্পকনগর ইউনিয়নের খোদেহাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কাগজে-কলমে শতাধিক শিক্ষার্থী। তবে বাস্তবে নেই কোনো শিক্ষার্থী। পাঠদান নেই, বাজাতে হয় না ছুটির ঘণ্টা। মনগড়া সময়ে আসা-যাওয়া আর গল্প করেই সময় কাটান শিক্ষকরা। মাস গেলেই সরকারি কোষাগার থেকে বেতন-ভাতা তোলেন তারা।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল উপস্থিত শিক্ষার্থীরা জানেন না তারা কোন শ্রেণিতে পড়েন। এমনকি তাদের স্কুলের নাম ও নিজের ক্লাস রোল নাম্বার। শিক্ষকদের অনিয়মের কারণেই বিদ্যালয়টি প্রায় শিক্ষার্থী শূন্য বলে মনে করছেন স্থানীয় লোকজন। তাদের দাবি অনিয়মের সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের স্থায়ীভাবে এখান থেকে অপসারণ করে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা।
জানা গেছে, ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার চম্পকনগর ইউনিয়নের খোদেহাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টিতে শিশু শ্রেণিতে ১৭ জন, প্রথম শ্রেণিতে ১৪ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ১৪ জন, তৃতীয় শ্রেণিতে ১৭ জন, চতুর্থ শ্রেণিতে ১৪ জন এবং পঞ্চম শ্রেণিতে ১৩ জন ছাত্র-ছাত্রী রয়েছেন। কাগজে-কলমে প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী থাকলেও বাস্তবে প্রতিদিন উপস্থিত হন ৫ থেকে ৭ জন। অথচ ছাত্র-ছাত্রীদের হাজিরা খাতায় ১-২ জনকে অনুপস্থিত দেখিয়ে প্রতিদিন সবাইকে উপস্থিত দেখান শিক্ষকরা।
বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে পাঁচজন শিক্ষক কর্মরত থাকলেও দুইজন শিক্ষক রয়েছেন ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটিতে। তার মধ্যে শিক্ষিকা ঋতু চৌধুরী রয়েছেন গত বছরের ২৮ নভেম্বর থেকে আরেক শিক্ষিকা নাহিদ ফাতিমা ইরা রয়েছেন গত বছরের ২৯ আগস্ট থেকে।
অভিযোগ রয়েছে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা আসমা খাতুন জেলা শহরে থাকার ফলে সপ্তাহে এক দুই দিন আসেন। বাকি দিনগুলোতে না আসলেও শিক্ষক হাজিরা খাতায় উনার উপস্থিতির স্বাক্ষর থাকে ঠিকই।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মাত্র ৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে একটি শ্রেণিকক্ষে চলছে পাঠদান, বিদ্যালয়ের বাকি কক্ষগুলো তালাবদ্ধ। সকাল সাড়ে ৯টায় সরকারি নিয়মানুসারে প্রাথমিকের পাঠদান চলার কথা থাকলেও এসব নিয়ম-নীতির কোনো তোয়াক্কা না করে শিক্ষকদের নিজস্ব নিয়মে চলছে বিদ্যালয়। সাড়ে ৯টার দিকে বিদ্যালয়ের শিশু শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীশূন্য বিদ্যালয়। তখন সাংবাদিক দেখে তড়িঘড়ি করে মোবাইল নিয়ে শিক্ষার্থীদের কল দিতে থাকেন বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আসমা খাতুন। শুধু তাই নয়, সংবাদ প্রচার না করার জন্য বিভিন্নজন দিয়ে এই প্রতিবেদককে ফোন দেওয়ার কার্যক্রম ও করেন প্রধান শিক্ষক। অপরিষ্কার আর ক্লাসের বেঞ্চে থাকা ময়লার স্তূপেই এসময় একটি ক্লাসেই কয়েকজনকে নিয়ে ক্লাস নেয়া শুরু করেন। বিদ্যালয়ে ৫ জন শিক্ষকের বিপরীতে শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মোট উপস্থিত ছিল ৫ জন।
বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী লামিশা আক্তার রওজা কে এ প্রতিবেদক তার স্কুলের নাম, ক্লাসের নাম এবং রোল নাম্বার জিজ্ঞেস করলে সে কোন উত্তর দিতে পারে নাই।
অন্য দিকে বিদ্যালয় ঝুঁকিপূর্ণ দেখিয়ে পাশেই আড়াই লাখ টাকা খরচ করে টিন শেডের একটি কক্ষ তৈরি করেন প্রধান শিক্ষক। সেই কক্ষ তৈরিতেও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে ওই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে। টিন শেডে ক্লাস নেওয়া কথা থাকলেও একদিনও ক্লাস না করে তালাবদ্ধ রেখে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই ক্লাস নেন শিক্ষকরা। এই টিনশেডটিও নির্মাণ করতে গিয়ে অনিয়ম করেন প্রধান শিক্ষিকা।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাসের জন্য আড়াই লাখ টাকা খরচ করে টিনশেডের একটি ঘর নির্মাণ করা হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পাক প্রাথমিকের জন্য নয় হাজার এবং শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য ৪৩ হাজার ৫০০ টাকা বরাদ্দ আসে। পরে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরেও ২৮ হাজার টাকা শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য বরাদ্দ আসে। বিদ্যালয়ের এসব বরাদ্দের টাকা নামমাত্র খরচ করে বাকি টাকা পকেটে ঢুকান প্রধান শিক্ষিকা আসমা খাতুন।
প্রধান শিক্ষক আসমা খাতুন শিক্ষার্থী শূন্য থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, ঠান্ডা ও শীতের কারণে স্কুলে শিক্ষার্থীরা আসছে না। পাশাপাশি সরকারি ভাবে বই এখনো না পৌঁছায় ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলে আসতে অনিহা প্রকাশ করছে।
তিনি আরও বলেন, বিদ্যালয়টি জরাজীর্ণ হওয়াই এলাকার অভিভাবকরা আশে পাশের বেসরকারি কিন্ডারগার্ডেনে তাদের ছেলে মেয়েদের ভর্তি করে নিচ্ছেন।
এই বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বিজয়নগর উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বর্ণজিৎ দেব বলেন, এই বিদ্যালয়ে বিষয়ে আগেও আমার কাছে অভিযোগ এসেছে। প্রধান শিক্ষক সহ স্কুলের সকল অনিয়মের বিষয়ে খতিয়ে দেখবো এবং খুব দ্রুত ব্যবস্থা নেবো।
আরটিভি/এএএ
মন্তব্য করুন