মাজারের দান বাক্সের টাকা গুণতে দুইদিন
মেঝের ওপর টাকা-পয়সার স্তুপ। দশ টাকার নোটই বেশি। তবে পাঁচ থেকে হাজার টাকার নোটও কম নয়। স্তুপের মধ্য থেকে এসব নোট বাছাই করছে স্কুলপড়ুয়া ১৪ বছরের এক শিক্ষার্থী। টাকার মাঝে দাঁড়ানো এক ব্যক্তি শিক্ষার্থীদের বাছাই করা সেই নোটগুলো গণনার জন্য দিচ্ছেন পাশেই টেবিল পেতে বসা স্থানীয় ব্যাংকের কর্মচারীদের হাতে। তারা সেগুলো গুণে গুণে বান্ডিল তৈরি করছেন। এটি বগুড়ার মহাস্থান মাজার কমিটির অফিসের ভেতরের দৃশ্য।
হযরত শাহ্ সুলতান মাহমুদ বলখী (রহ.) মাজারের চারদিকে সিন্দুকগুলোতে জমা হওয়া টাকা গণনা শুরু হয়েছে রোববার সকাল থেকে।
মাজার কমিটির কর্মকর্তারা জানান, রোববার সকাল ১১টা থেকে শুরু হওয়া এই গণনা সোমবার বিকেল নাগাদ শেষ হতে পারে। মাজারের চারদিকে যে ৯টি সিন্দুক রয়েছে তার মধ্যে রোববার ৬টি খোলা হয়েছে। সন্ধ্যা নাগাদ ওই ৬টি সিন্দুকের টাকা-পয়সা গণনা সম্পন্ন হয়েছে। বাকি তিনটি সিন্দুকের মধ্যে ১টি নষ্ট। অন্য দু’টি সোমবার সকালে খোলা হবে।
ইতিহাসের বর্ণনা অনুযায়ী শাহ্ সুলতান মাহমুদ মধ্য এশিয়ার বল্লখ রাজ্যের সম্রাট ছিলেন। ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য তিনি রাজত্ব ছেড়ে প্রায় ৭০০ বছর আগে পুণ্ড্রবর্ধনের রাজধানী পুণ্ড্রনগর তথা আজকের বগুড়ার মহাস্থানে আসেন। মহাস্থানগড়ে পৌঁছে তিনি ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। প্রথমে পুণ্ড্রবর্ধনের তৎকালীন রাজা পরশুরামের সেনাপ্রধান, মন্ত্রী এবং কিছু সাধারণ মানুষ ইসলামের বার্তা গ্রহণ করে মুসলিম হন।
এভাবে পুণ্ড্রবর্ধনের মানুষ হিন্দু ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকলে রাজা পরশুরামের সাথে শাহ সুলতানের বিরোধ বাধে এবং এক সময় যুদ্ধ শুরু হয়। ১৩৪৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি পুণ্ড্রবর্ধনের শেষ রাজা পরশুরামকে পরাজিত করেন। পরে তিনি মৃত্যুবরণ করলে মহাস্থানে তার মাজার নির্মিত হয়। প্রতি বছর বৈশাখ মাসের শেষ বৃহস্পতিবার শাহ্ সুলতান মাহমুদ বলখীর (রহ.) ওরস মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। তার কবর জিয়ারত করলে সওয়াব পাওয়া যাবে এই আশা নিয়ে প্রতিদিন দেশ-বিদেশের অসংখ্য ধর্মপ্রাণ মুসলমান তার মাজারে আসেন। তারা তার মাজারের চারদিকে রাখা সিন্দুকগুলোতে টাকা-পয়সাও দান করেন।
টাকা বাছাইয়ের কাজে যুক্ত হয়েছে মাজারের পাশে মহাস্থান উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ১৪ শিক্ষার্থী। তাদের একজন কাওসার মাহমুদ জানায়, এর আগেও সে মাজারের সিন্দুকের টাকা বাছাইয়ের কাজ করেছে। টাকা বাছাই ও গুণতে ভালোই লাগে। কিন্তু অনেক টাকা তো, তাই দীর্ঘ সময় ধরে বাছাই করতে গিয়ে শরীরে ক্লান্তি চলে আসে।
তার সহপাঠী শফিকুল ইসলাম বলে, এক সঙ্গে এত টাকা আগে কখনও দেখিনি। মাজারের টাকা বাছাই করতে ভালোই লাগে।
এর আগে টাকা বাছাই করতে গিয়ে সোনার তৈরি মহিলাদের নাকফুলসহ স্বর্ণালংকার পাওয়ার কথা জানিয়ে সে বলে, ‘মহিলাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো তার মানত পূরণের জন্য টাকার বদলে এসব স্বর্ণালংকার দানবাক্সে ফেলে যান।
রোববার সকালে গণনা শুরু হওয়ার পর পরই মাজার কমিটির অফিস সহায়ক এনামুল হক এক মার্কিন ডলারের একটি নোট দেখিয়ে বললেন, শুধু দেশি নোটই নয় বিদেশি মুদ্রাও পাওয়া যায়।
কোষাধ্যক্ষ ওবায়দুর রহমান জানান, রোববার মাজারের পাশে ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক সংলগ্ন যাত্রী ছাউনির ভেতরে বড় দু’টি সিন্দুক রয়েছে। বাকি ৭টি সিন্দুক রয়েছে মাজারের চারদিকে। তিনি বলেন, ‘যখন যে সিন্দুক খোলা হয় তার ভেতরে থাকা টাকা-পয়সা গণনা শেষ না পর্যন্ত এই গণনা কার্যক্রম চলে। এরপর গণনা করা টাকা-পয়সাগুলো তৎক্ষণাৎ নির্ধারিত ব্যাংকে জমা রাখা হয়।’
মাজার কমিটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাহেদুর রহমান জানান, মাজার কমিটির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন মাস পর পর জেলা প্রশাসনের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে মাজারের সিন্দুকগুলো খোলা এবং টাকা-পয়সা গণনা করা হয়। বিপুল পরিমাণ টাকার মধ্য থেকে বিভিন্ন নোট বাছাইয়ের কাজে স্কুলের শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা নেওয়া হয়। এজন্য তাদের প্রতিদিন ২৫০ টাকা করে সম্মানি দেওয়া হয়। এছাড়া নোটগুলো গণনা করে বান্ডিল তৈরির জন্য স্থানীয় রূপালী ব্যাংকের কর্মচারীদের সহায়তা নেওয়া হয়। তাদেরকে একদিন গণনার জন্য ৫০০ টাকা সম্মানী দেওয়া হয়।
তিনি জানান, মাজারের টাকা গুণতে কমপক্ষে দুই দিন লাগে। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ১৮ ও ১৯ সেপ্টেম্বর সিন্দুক খুলে মোট ৩৬ লাখ ৯৮ হাজার ৫০০ টাকা পাওয়া গেছে। তার হিসাব মতে ২০১৮ সালের ১১ মে থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সিন্দুকগুলো থেকে ৮৭ লাখ ৫৫ হাজার ১০৩ টাকা পাওয়া গেছে। তার আগের বছর পাওয়া গেছে ৭৮ লাখ ৮০ হাজার ৭৪৮ টাকা। বর্তমানে মাজার কমিটির নামে ব্যাংকে প্রায় ৩ কোটি টাকা জমা থাকার তথ্য দিয়ে জাহেদুর রমহমান বলেন, ‘এই টাকাগুলো শুধু মাজারের উন্নয়নেই ব্যয় করা হয়। পাশাপাশি মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জিনসহ যে ৩৬ জন কর্মচারী রয়েছেন তাদের বেতন-ভাতাও সিন্দুকে পাওয়া দানের টাকা থেকে পরিশোধ করা হয়।’
গণনাকালে উপস্থিত রূপালী ব্যাংক মহাস্থান শাখার ব্যবস্থাপক আল-আমিন জানান, মাজার কমিটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে টাকাগুলো গণনার জন্য ৭ জন কর্মচারী নিয়োগ করা হয়েছে। গণনা শেষে টাকাগুলো মাজার কমিটির হিসাবে জমা করা হবে।
গণনা তদারকিতে নিয়োজিত বগুড়া জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাজউদ্দিন জানান, যেটুকু জেনেছি ১৯৮৭ সাল থেকে জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে মাজার কমিটি পরিচালিত হচ্ছে। পদাধিকার বলে জেলা প্রশাসক এই কমিটির সভাপতি। নিয়ম অনুযায়ী তিন মাস পর পর মাজার কমিটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা সিন্দুক খুলে টাকা গণনা করার জন্য কমিটির সভাপতির কাছে আবেদন করে থাকেন। তারপর এ কাজের জন্য জেলা প্রশাসক একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়োগ দেন। আমি এ নিয়ে পর পর চারবার মহাস্থান মাজারের টাকা গণনার দায়িত্ব পালন করছি। মাজারের টাকা-পয়সা গণনার অনুভূতি একটু আলাদা।
আরও পড়ুন
পি
মন্তব্য করুন