চলচ্চিত্রে চির অম্লান নায়ক সালমান শাহ
নব্বই দশকের শুরুর দিক থেকে ১৯৯৬ সাল, মাত্র চার বছরের ক্যারিয়ারে বাংলাদেশি চলচ্চিত্র জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম সালমান শাহ। সে সময় মাত্র ২৫ বছর বয়সী উচ্ছল এই তরুণের একক আধিপত্য ছিলো চলচ্চিত্র মহলে। প্রায় একচ্ছত্র রাজত্বে উপহার দিয়ে গেছেন ২৭টি ব্যবসাসফল ছবি। তার জনপ্রিয়তার পারদ এতোটাই ঊর্ধ্বগামী ছিলো যে, আজ অবধি কোনো নায়ক সে উচ্চতা ডিঙাতে পারেননি। ধূমকেতুর মতো আগমন করেই পেয়েছিলেন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। যা এতোটা অল্প সময়ে তার আগে এই বাংলায় আর কেউ পায়নি। তাকে নিয়ে আলোচনা কোনোদিন শেষ হবার নয়! প্রতিভাদীপ্ত এই ব্যক্তিত্বের জন্মদিনে তাকে নিয়ে কিছু আলোচনা-
এক নজরে সালমান শাহ!
সালমান শাহ’র পারিবারিক নাম চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার। ডাক নাম ইমন। সিলেটের দাড়িয়াপাড়ায় নানাবাড়িতে জন্ম তার। বাবা কমর উদ্দিন চৌধুরী, পেশায় সরকারি কর্মকর্তা এবং মা নীলা চৌধুরী রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন; একাধিকবার সংসদ নির্বাচনও করেছেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে সালমান শাহ বড়ো। ছোটো ভাই চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরান ইভান।
সালমান শাহ পড়াশোনা করেন খুলনার বয়রা মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে। এই স্কুলে সহপাঠী ছিলেন নায়িকা মৌসুমী। যিনি পরবর্তীতে তার প্রথম চলচ্চিত্র কেয়ামত থেকে কেয়ামতের নায়িকা হন। ঢাকার ধানমণ্ডি আরব মিশন স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন ১৯৮৭ সালে। এরপরে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ধানমণ্ডির ড. মালেকা সায়েন্স কলেজ থেকে বি.কম পাস করেন।
চলচ্চিত্রে আসার আগেই তিনি ছিলেন বিবাহিত। ১৯৯২ সালের ১২ আগস্ট খালার বান্ধবীর মেয়ে (কেউ-বা বলেন মায়ের বান্ধবীর মেয়ে) সামিরার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। স্ত্রী সামিরা হক, জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক শফিকুল হক হীরার মেয়ে; বিউটি পার্লার ব্যবসায়ী। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে সালমান শাহ তার স্ত্রী সম্পর্কে জানিয়েছেন- সালমানের ২টি চলচ্চিত্রে পোশাক পরিকল্পনাকারী হিসেবে কাজ করেছেন সামিরা হক। একই সঙ্গে স্টাইল ও ফ্যাশন আইকন সালমান শাহ’র বিভিন্ন স্টাইল ও ফ্যাশন নিয়েও পরামর্শ দিতেন সামিরা হক। বুঝতে অসুবিধে হয় না; স্বামী-স্ত্রী দুইজনেই সময়ের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে ছিলেন।
সালমান শাহ’র মাথায় রুমাল বাঁধা, চোখে সানগ্লাস আর কাউবয় ধরনের হ্যাট এখনও অনুকরণ করেন অনেকেই। আর সামিরা হক যেভাবে চোখে কাজল দিতেন, সেটাও বর্তমানে অনেক মেয়েই অনুসরণ করেন!
বর্ণিল কর্মজীবন
বিজ্ঞাপনচিত্রে মডেল হয়ে বিনোদনজগতে পা রাখেন সালমান শাহ। কাজ করেন অনেক ধরনের বিজ্ঞাপনে। একাধিক নাটকে অভিনয় করেন। ১৯৮৫ সালে বিটিভিতে আকাশ ছোঁয়া নাটক দিয়ে অভিনয় শুরু। এরপর ধীরে ধীরে চলচ্চিত্রের পাশাপাশি নাটকেও সমানতালে অভিনয় করে যান। সালমান শাহ অভিনীত নয়ন নাটকটি শ্রেষ্ঠ একক নাটক হিসেবে বাচসাস পুরস্কার পায়। বৈচিত্র্যময়তা ছিলো সালমান শাহ’র সহজাত গুণ। এমনকি তিনি প্লেব্যাকও করেন দুটো চলচ্চিত্রে।
তবে এ প্রজন্মের অনেকেই হয়তো জানেন না সালমান শাহ’র চলচ্চিত্রে পদচারণার শুরুর গল্পটা কেমন। ওই সময় বাংলা চলচ্চিত্র চরম এক দুঃসময় পার করছিল। ঘুরেফিরে একই অভিনয়, একই কাহিনী, সবমিলিয়ে বাংলা সিনেমা দর্শকদের কাছে অনেকটাই একঘেয়েমিতে রূপ নেয়। নব্বই দশকের শুরু দিকে ঠিক ওই সময়টাতেই সালমান শাহ’র আগমন ঘটে নক্ষত্রের মতো।
এর পেছনেও একটা গল্প আছে-
১৯৯৩ সালের মার্চ মাসে জনপ্রিয় হিন্দি ছবি ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ ছবির কপিরাইট কিনে এনে নতুন মুখের সন্ধান করা হয়। হুবহু এই ছবির মতোই ছবি বানাতে, নির্মাতা সোহানুর রহমান সোহান এমন দুজন নতুন মুখ চান যাদের দেখে দর্শক আগ্রহ পাবে। এমন একটা সময়ে নির্মাতা সোহানুর সন্ধান পান মৌসুমী এবং সালমান শাহ’র। ছবিটিতে অভিনয় দিয়েই নিজের জাত চিনিয়েছিলেন সালমান শাহ। অতঃপর প্রথম ছবিই ধামাকা। ঢাকাই ছবির নির্ভরযোগ্য তারকা বনে যান সালমান শাহ। এই ছবিতে গান দিয়ে নিজের ক্যারিয়ার শুরু করেন কণ্ঠশিল্পী আগুন।
কেয়ামত থেকে কেয়ামত ছবিটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে নতুন প্রাণের সঞ্চার করে। এরপর সালমান শাহকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। একের পর এক সফলতা যেন যেচে এসে ধরা দিয়ে যেতো তাকে। এক্ষেত্রে একটা দুর্দান্ত ক্রেজ ধরে রেখেছিলেন সালমান শাহ। ক্যারিয়ারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। প্রথম ছবির জুটি চিত্রনায়িকা মৌসুমীর সাথে হলেও পরবর্তী সফল জুটি গড়ে ওঠে শাবনূরের সাথে। এককভাবে সালমান শাহ’র সঙ্গে ১৪টি ছবিতে জুটিবদ্ধ হন চিত্রনায়িকা শাবনূর। ইতিহাসের সোনালি অতীত সালমান শাহ-শাবনূর জুটি। তবে শাবনাজ, শাহনাজ, লিমা, শ্যামা, সোনিয়া, বৃষ্টি, সাবরিনা, কাঞ্চির সাথেও জুটি বেঁধেছেন তিনি।
নিজেই যেন ছিলেন নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী। প্রয়োজনে নিজেকে ভেঙচেুরে নতুনভাবে গড়তেন প্রতিটা চরিত্রের জন্য। পর্দায় তাকে দেখে একঘেয়েমি হতো না কারোরই। অসাধারণ অভিনয় দক্ষতা দিয়ে মোহাবিষ্ট করে রাখতেন তিনি। জড়তাহীন প্রতিটা সংলাপ আর সাবলীল প্রতিটা দৃশ্য যেন আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতো- সালমান শাহ একজনই!
তিনি কি শুধুই অভিনেতা? মোটেও না। বরং তিনি চলচ্চিত্রে নতুন এক ধারার প্রবর্তক। সামাজিক, অ্যাকশনধর্মী, নিখাদ মন-বিনিমনের ছবিতে নতুন একটি ধারার সঙ্গে সবাইকে পরিচিত করিয়েছেন সালমান শাহ। তার রাজসিক অভিষেকেই দেশীয় চলচ্চিত্র ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা অর্জন করে নতুন করে। দর্শককে হলমুখী করতে, প্রযোজকের লগ্নিতে প্রাণ ঢেলে দিয়েই নব্বইর দশকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেন তিনি।
তবুও আফসোস!
সালমান শাহ’র কর্মজীবন ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। এর মাঝে চলচ্চিত্রে চার বছর। তবে এই সময়ে তার ঝুলিতে থাকা অভিনয়গুলো ছিলো অসাধারণ, অনবদ্য। অনেক নির্মাতারা এখনও আফসোস করেন ২৫ বছরের ওই তরুণের জন্য, তার মতো না হোক অন্তত তার কাছাকাছি কেউ আজ পর্যন্ত আসেনি বাংলা চলচ্চিত্রে! কী ভয়ংকর আক্ষেপ!
সালমান শাহ’র কি অসমাপ্ত কোনো কাজ নেই? অবশ্যই আছে। ওই সময়ে সালমান শাহ মানেই ছবি হিট। অসমাপ্ত কাজ জোড়াতালি দিয়ে মুক্তি দিলেও প্রতিটা ছবিই ব্যবসাসফল হতো! এমন জাদুকর দ্বিতীয় কেউ হতে পারেননি এখনও! মজার ব্যাপার হলো, শুধু সালমান শাহ’র সিনেমার সফলতার কারণে ওই সময়ে বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে অনেক বড়ো বাজেটের মুভি! প্রতিটা হলে টানা চলতে থাকে সালমান শাহ অভিনীত ছবি।
এখনকার সময়টা সে তুলনায় অনেকটাই সহজ! চাইলেই সব নখদর্পণে। ফেইসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটারে প্রিয় তারকাদের প্রোফাইল ঘাঁটলেই আমরা জানতে পারি তাদের দৈনন্দিন আপডেট! তবে সালমান শাহ’র জন্য এই আফসোস কোটি মানুষের। তখন ছিলো না সামাজিক কোনো যোগাযোগ মাধ্যমে। থাকলে বেশ হতো! অন্তত স্বপ্নের নায়ক কেমন ছিলেন, কী খেতে ভালোবাসতেন, প্রিয় শখ বা কাজ, অবসর কীভাবে কাটান তিনি সবটা জানা যেত। প্রতিনিয়ত সেলফি, ছবিতে দেখা যেত। অথবা চেকইন দেখে ভক্তকুল জানতে পারতেন প্রিয় নায়কের অবস্থান এবং কর্মকাণ্ড! গ্রেট মিস কি একেই বলে?
সালমান কথন!
দুর্দান্ত অভিনয় দক্ষতা, সাবলীল সংলাপ, সময় ছাড়িয়ে যাওয়া স্টাইল এবং ফ্যাশন দিয়েই দর্শক আটকে রাখার একটা ক্ষমতা ছিলো সালমানের। বিশেষত নব্বই দশকের পর বাংলা সিনেমাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার একচ্ছত্র কৃতিত্বও কিন্তু তার। নিজেকে সীমাহীন ভাবে গড়ার প্রত্যয় নিয়েই যেন বাংলা চলচ্চিত্রে আসেন তিনি। অ্যাকশন, ফ্যামিলি ড্রামা, রোমান্টিক, মেলোড্রামা, প্রতিবাদ যে চরিত্রই থাকুক, সালমান শাহ নিজেকে সেভাবেই উপস্থাপন করতে পারেন। মনে হতো এই চরিত্রের সৃষ্টিই তার জন্য। সহজাত অভিনয় দক্ষতার কারণেই চরিত্রের ভেতরে ঢুকে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল সালমান শাহ’র। অনেক বড় বড় অভিনেতারাও অনেক ক্ষেত্রে খেই হারিয়ে ফেলেন, নতুন এলেও বোঝা যায় কাজে কিংবা সংলাপে। অথচ প্রথম ছবি কেয়ামত থেকে কেয়ামত-এ সালমান শাহ ছিলেন সপ্রতিভ এবং সহজাত। যে কারণে এটা বোঝা কঠিন ছিল যে ছবিটি সালমান শাহ’র প্রথম। আব্দুল মান্নান রানার গাওয়া ‘চিঠি এলো জেলখানাতে’ গানটিতে সালমান শাহ’র অভিনয় দেখে ডুকরে কেঁদে উঠেছেন সমগ্র দর্শক মহল।
তার কাউবয় হ্যাট, গগলস, লং কোটের ডিটেক্টিভ লুক, হুডি শার্ট, ব্যাক ব্রাশ করা চুল, কানে দুল, ফেড জিন্স, মাথায় বাধা রুমাল তখন দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল। তারুণ্যের স্টাইল আইকন কি কেউ এমনি এমনি হয়?
সাধে কি তাকে প্রতিভাধর বলে লোকে? বন্ধুমহলে সালমান শাহ’র নামডাক ছিল কণ্ঠশিল্পী হিসেবে। এমনিতেও তিনি শিল্প-সংস্কৃতিতে আগ্রহী ছিলেন ছোট বেলা থেকেই। ১৯৮৬ সালে ছায়ানট থেকে পল্লিগীতিতে উত্তীর্ণ হয়ে পরিচিতি পান গায়ক হিসেবে।
সর্বমহলে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করার একচ্ছত্র ক্ষমতা ছিল সালমান শাহ’র। শুধু নায়ক নন বরং একজন তরুণ ফ্যাশন আইকন ছিলেন তিনি। অনবদ্য স্টাইল আইকন হয়ে যুগের চাইতে এগিয়ে ছিলেন। তার সময়ে যা কেউ ভাবতে পারতো না, তা তিনি করেছেন অবলীলায়। শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের মধ্যে হলে গিয়ে ছবি দেখার একটা ভীতি ছিল। অনভ্যাস কিংবা নিচু চোখে দেখার মানসিকতা বলা চলে। কিন্তু সালমান শাহকে বরণ করে নিয়েছিলেন সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। তার ছবি লোকে দেখতো, এখন যেমন দেখে। তিনি এখনও ঠিক অতোটাই জনপ্রিয় যতোটা অর্জন করে গেছেন। এমনকী যারা তাকে দেখেনি, তারাও চেনে তাকে ঠিক সেভাবে, যেভাবে তিনি চিনিয়ে গেছেন।
নানান আলাপনে স্বপ্নের নায়ক!
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক আজ সালমান শাহময়! যাদের সাথে তার মুহূর্ত জমা, তারা স্মৃতির ঝাঁপি খুলে লিখছেন আজ। বিনয়ের এক সমার্থক ছিলেন সালমান শাহ। ট্রাকে করে ঘুরে বেড়াতেন অবলীলায়। কোনো ছোটো-বড়ো নেই, অটোগ্রাফ দিতেন সবাইকে। তাকে দেখলেই সৃষ্টি হতো উত্তেজনার। চারপাশে তাকে ঘিরে ধরতো। নায়ক বটে তিনি! হাত নেড়ে, উড়ো চুম্বনে ফিরতি জবাব দিতেন ভক্তদের। কোন শুভেচ্ছাই ফেলনা ছিল না তার কাছে।
ভীষণ সাদামাটা ছিলেন তিনি যার বর্ণনা উঠে এসেছে তার খুব কাছের বন্ধু আশরাফুল হকের কথায়। যিনি নিজেও চলচ্চিত্রাঙ্গনের একজন। বাংলা সিনেমায় তিনি পরিচিত ডন হিসেবে। খলনায়ক হিসেবেই মূলত অভিনয় করেন তিনি। তবে নায়ক সালমান শাহ আর খলনায়ক ডন যে বন্ধু ছিলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে এখন সে কথা প্রায় সবার জানা। জাতীয় এক দৈনিকের সাক্ষাতে ডন জানান, ড্রাইভিং ছিলো সালমান শাহ’র সবচেয়ে পছন্দের। প্রায় রাতেই কাজ শেষে দুই বন্ধু গন্তব্যহীন লং ড্রাইভে যেতেন। অধিক স্পিডে গাড়ি চালানোর রেকর্ড ছিলো তার। গুলশানের এক সাধারণ রেস্তোরাঁয় বেশিরভাগ রাতেই যেতেন। সেখানের মিল্কশেক ছিলো সালমান শাহ’র খুব পছন্দের। এমনও দিন গেছে যেদিন শুধু সালমান শাহ’র জন্যই দোকান খোলা রাখতে হয়েছে। কিন্তু এতেও যেন বিরক্ত হতেন না দোকানি। দোকান খুলে অপেক্ষা করতেন সালমান শাহ’র জন্য। সম্মোহন করার কী দারুণ গুণ ছিলো তার! মিল্কশেক খেতেন, আড্ডা দিতেন এরপর গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়তেন অজানা গন্তব্যে।
উত্তরার ফুটপাতে একটা পিঠার দোকানের চিতই পিঠা ছিলো সালমান শাহ’র খুব পছন্দের। বয়স্কা একজন নারী ছিলেন সে পিঠার কারিগর। সালমান শাহ, ডন দু’জনে প্রায়ই সেখানে যেতেন। সালমান শাহ সে পিঠার কারিগরকে নানি ডাকতেন। মানুষকে যথাযথ সম্মান দেওয়ার সহজাত গুণ ছিলো তার। তবে দাম পরিশোধে তিনি একটু এগিয়েই থাকতেন। এক বসাতে ৯/১০টি পিঠা খেয়ে দাম দিতেন ইচ্ছেমত। যা ছিল ন্যায্য দামের চেয়েও বেশি। হয়তো খেয়েছেন ৭/৮টি পিঠা কিন্তু দাম দিয়েছেন ৫০০ টাকা। ওই সময়ের ৫শ’ টাকা মানে এখনকার অনেকগুণ!
সালমান শাহ’র স্মৃতিচারণ করে একজন চলচ্চিত্র সাংবাদিক বলেছিলেন, ভীষণ রকমের পাগলাটে স্বভাব আর একরোখা ছিলেন সালমান শাহ। কিন্তু বেজায় মিশুক আর আদরকাতর। যেমন আবদার করতেন তেমনি আপন করে নিতেন যে কাউকে। স্টান্টম্যান ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ দৃশ্যে অভিনয় করার সাহস ছিলো সালমান শাহ’র। তখনকার সময়ে বাংলাদেশের সিনেমায় রঙিন যুগ প্রবেশ করলেও আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। এখনের মতো গ্রাফিক্স কিংবা ভিএফএক্সের কোনো সুযোগ ছিলো না। এডিটের কাজও এখনকার মতো এতোটা পেশাদারি ছিলো না। ওই সময়ে স্টান্টম্যান ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ দৃশ্যে নায়কের কথা ভাবাই যেতো না; সেখানে সালমান শাহ মোটামুটি জেদ করেই ঝুঁকি নেন। হোক সেটা চলন্ত গাড়িতে জানালার কাঁচ ভেঙে ঢুকে যাওয়া কিংবা উপর থেকে লাফ দেওয়া। এই লাফ দিয়ে স্পাইনাল কর্ডে আঘাত পান সালমান শাহ, অসুস্থও ছিলেন বেশ কয়েকদিন।
কণ্ঠ শিল্পী আগুন আর সালমান শাহ’র সূচনা প্রায়ই একইসঙ্গে। আগুনের বেশিরভাগ গাওয়া গানেই ঠোঁট মিলিয়েছেন সালমান শাহ। এ ব্যাপারে আগুন জানান, দানশীল ছিলেন এই নায়ক, সময়সাময়িক অনেক নায়ক ছিলেন কিন্তু সালমান শাহ সাধারণ হয়েও যেন অসাধারণ এবং সবার চেয়ে আলাদা। সালমান শাহকে নিয়ে স্মৃতিচারণের এক পর্যায়ে জানান- এফডিসির কোনো সিকিউরিটি গার্ড জানিয়েছিল তাদের টেলিভিশন নেই। পরদিনই টেলিভিশনের ব্যবস্থা হয়ে গেলো! হৃদয়ের দিক থেকে বিশাল ছিলেন সালমান শাহ। মনের দিক থেকেও ভালো মানুষ। প্রোডাকশন বয়দের সুখ-দুঃখে পাশেই পাওয়া যেতো সালমান শাহকে। চলচ্চিত্রের কেউ বিপদে পড়ে সালমানকে জানালেই হয়ে যেতো মুশকিল আসান।
অতঃপর নক্ষত্রের পতন!
সিলেটের শাহ জালাল (র.) মাজার প্রাঙ্গণ। একদিকে চিরনিদ্রায় শায়িত কিছু মানুষ। খানিকটা এগিয়ে গেলেই সেখানে দেখা মিলবে মাটি থেকে কিছুটা উঁচুতে থাকা একটা কবরের। কবরের গায়ে লেখা সালমান শাহ!
১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখ। ২৫ এর পূর্ণতা পাওয়ার কিছুদিন আগে ঢাকার ইস্কাটনে ফ্যানের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় একটা দেহ পাওয়া যায়। দেহটা সালমান শাহ’র। ময়নাতদন্তে উঠে আসে আত্মহত্যার কথা। প্রায় কয়েক বছর পরপরই সালমান শাহ’র মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে হইচই হয়। কিছুদিন সংবাদের শিরোনাম হয়ে আবার নিভে যায় আন্দোলনগুলো।
একটা মানুষ কতোটা জনপ্রিয় হলে মৃত্যুর এতো বছর পরেও চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়? সর্বশেষ ২০২০ সালে পুলিশের তদন্ত বিভাগ থেকেই জানানো হয়, সালমান শাহ আত্মহত্যাই করেছিলেন! মৃত্যুর পেছনের ঘটনা আবিষ্কৃত, তবুও একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। আত্মহত্যা করার মতো ছেলে ছিলেন কি সালমান শাহ?
বাংলাদেশের একজন নায়কের মৃত্যু সংবাদ সে সময় ফলাও করে ছাপা হয়েছিল দেশ বিদেশের নানা পত্রিকায়। প্রকাশিত হয়েছিল বিবিসি, টাইম ম্যাগাজিনের মতো আন্তর্জাতিক মাধ্যমে। ১৯৯৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর টাইম ম্যাগাজিনে সালমান শাহকে বাংলা চলচ্চিত্রের সেরা তারকা বলা হয়। প্রতিবেদনে ২৫ বছর বয়সী সম্ভাবনাময়ী তরুণের মৃত্যুতে সারা দেশে আবৃত থাকা শোকের ছায়ার কথা তুলে ধরা হয়। ওই সময়ে সালমান শাহ’র মৃত্যুর পর অনেক তরুণীই আত্মহত্যা করেন। যেটার কথা উল্লেখ করে টাইম ম্যাগাজিন। কিন্তু কোনো তারকার জন্য এতো ভক্তের এমন আত্মদান, বিরল বটে!
তিনি ছিলেন নক্ষত্র, জ্বলন্ত। পতন হয় না নক্ষত্রের? কিন্তু স্বপ্নের নায়কের এমন পতন না হলেই হয়তো ভালো হতো। ঢালিউডের ইতিহাসে সালমান শাহই কি একজন যিনি অকালপ্রয়াত? অবশ্যই না। বরং সালমান শাহ’র আগে পরে অনেক অকালপ্রয়াত তারকাই হারিয়ে গেছেন অসীমের পথে। কিন্তু মৃত্যুর পরেও সমান জনপ্রিয়তা ধরে রাখা নায়ক তিনি একজনই! সিনেমার সাথে যুক্ত প্রযোজক, পরিচালক থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবাই বুঝতে পারেন, চলচ্চিত্র জগত কী হারিয়েছে! দুর্দশার শুরু তখনই। আর আজ? সে খবর না হয় তোলাই থাক। এরপর কতো শত সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে শুধু ভালো ব্যবসার অভাবে। টিকে থাকা হলগুলোও জরাজীর্ণ, নড়বড়ে। নতুন অনেক কাজ হচ্ছে, হবে। হলে দর্শকও আসছে, আসবে। তবে ক্ষণে ক্ষণে অনেকেই ভাবেন, সালমান শাহ বেঁচে থাকলে মন্দ হতো না!
জীবন তবুও চলছে…
সিলেট, সবুজের আনন্দকানন। সেখানকার দাড়িয়াপাড়ায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সালমান শাহ ভবন। গর্ব করার মত এক নাম, যে নামে মুগ্ধতা জন্মে দেশ ছাড়িয়ে বিভূঁই-এ। ১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর যখন পুরো দেশজুড়ে অস্থিরতা, তখনই পৃথিবী আলো করে আজকের এই দিনেই মানুষটা এসেছিলেন চায়ের দেশে। শুভ জন্মদিন সালমান শাহ! জিইয়ে রাখা আবেগ থেকে অনেকে ঘটা করে পালন করছেন সালমান শাহ’র জন্মদিন। অথচ তিনি অনতিক্রমণীয় দূরত্বে বিচরণ করছেন।
দেশে এতোসব চর্চার বিষয়ের মধ্যে বাংলা চলচ্চিত্র অনুরাগীদের মধ্যে তিনিই যে সর্বাধিক চর্চিত, এ কি তিনি জানেন? বেঁচে থাকলে বয়স ৫১ পূর্ণ হতো আজ কিন্তু তিনি নেই। তিনি একজন সম্মোহক। ঠিক ওই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো। পার্থক্য এই, বাঁশিওয়ালা সম্মোহিত করে রেখেছিল একদল শিশুদের এবং হারিয়ে গেছে পুরো দলসমেত। কিন্তু আমাদের এই সম্মোহক আবিষ্ট করে চলছেন বছরের পর বছর ধরে। কিন্তু চলে গেছেন একলা ওই অসীমের পথে! ক্ষণজন্মা এক নায়ক। ২৬ বছর হলো তিনি নেই অথচ এখনও তরুণ নায়ক হয়েই দাগ কেটে চলেছেন কোটি মানুষের হৃদয়ে। যে দাগ প্রস্থানে মলিন নয় বরং এখনও জ্বলজ্বলে!
মন্তব্য করুন