‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ গানটি শুনলেই যেন অশ্রুসিক্ত হয়ে যান বাঙালিরা। প্রাণের আকুলতার চিরচেনা এ গানটি কানে বাজলেই অনুভব করতে পারি দরজায় কড়া নাড়ছে ২১শে ফেব্রুয়ারি।
এটি আমাদের মাতৃভাষা দিবসের গান, প্রভাতফেরির গান। চিরায়ত এ গানটির রচয়িতা আবদুল গফফার চৌধুরী। যদিও এই গানটি কবিতা হিসেবেই লিখেছিলেন তিনি। তার লেখা গানটিতে ফুটে উঠেছে শহীদদের আত্মত্যাগের চিত্র। পরে শহীদ আলতাফ মাহমুদের সুরের ছোয়ায় হয়ে ওঠে একুশের প্রভাতফেরির গান।
১৯৫২ সালের এই দিনে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে শহীদ হন রফিক, জব্বার, শফিউর, সালাম, বরকত সহ অনেকেই। তাই এ দিনটি শহীদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। পরে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয় দিনটিকে।
ওই সময় ঢাকা কলেজে পড়াশোনা করতেন আবদুল গফফার চৌধুরী। পুলিশের গুলিতে সালাম বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরও অনেকের হতাহতের খবর পেয়ে, তাদের দেখতে ঢাকা মেডিকেলে যান তিনি। এ দিন ঢাকা মেডিকেলের গেটের সামনে রক্তমাখা লাশের মিছিল দেখতে পান খ্যাতিমান এই লেখক।
এ সময় তার চোখে পড়ে একটি রক্তমাখা লাশ। বুলেটের আঘাতে লাশটির মাথার খুলি উড়ে গিয়েছিল। আর এই লাশটি ছিল ভাষাশহীদ রফিকের লাশ। লাশটি দেখে সে সময় তার মনে হয়েছিল, এটা যেন তার নিজেরই ভাইয়ের রক্তমাখা লাশ। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে প্রথম দুইটি লাইন জেগে উঠে। পরে কয়েকদিনের মধ্যে ভাষা শহীদদের স্মরণে কবিতাটি লেখেন তিনি।
প্রথমে লিফলেটে ‘একুশের গান’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় কবিতাটি। পরে ১৯৫৩ সালে একুশে সংকলনেও স্থান পায় এটি।
‘একুশের গান’ নামের কবিতাটিকে গানে রূপান্তরের জন্য প্রথমে সুর করেছিলেন আবদুল লতিফ। কিন্তু এর কয়েকমাস পরে আলতাফ মাহমুদ এতে নতুন সুর দিলে, সেটিই বেশি জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৫৪ সালের প্রভাতফেরিতে প্রথম আলতাফ মাহমুদের সুরে গাওয়া হয় গানটি।
বর্তমানে সারা বিশ্বের মানুষও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করেন। আর এই গানটি শুধু বাংলায় নয় হিন্দি, মালয়, ইংরেজি, ফরাসি, সুইডিশ, জাপানিসহ ১২টি ভাষায় গাওয়া হয় রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি।
একুশের গান-
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু ঝরা এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।
জাগো নাগিনীরা জাগো নাগিনীরা জাগো কালবোশেখীরা
শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা,
দেশের সোনার ছেলে খুন করে রোখে মানুষের দাবী
দিন বদলের ক্রান্তিলগ্নে তবু তোরা পার পাবি?
না, না, না, না খুন রাঙা ইতিহাসে শেষ রায় দেওয়া তারই
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।
সেদিনও এমনি নীল গগনের বসনে শীতের শেষে
রাত জাগা চাঁদ চুমো খেয়েছিল হেসে;
পথে পথে ফোটে রজনীগন্ধা অলকনন্দা যেন,
এমন সময় ঝড় এলো এক ঝড় এলো খ্যাপা বুনো।
সেই আঁধারের পশুদের মুখ চেনা,
তাহাদের তরে মায়ের, বোনের, ভায়ের চরম ঘৃণা
ওরা গুলি ছোঁড়ে এদেশের প্রাণে দেশের দাবীকে রোখে
ওদের ঘৃণ্য পদাঘাত এই সারা বাংলার বুকে
ওরা এদেশের নয়,
দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়
ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।
তুমি আজ জাগো তুমি আজ জাগো একুশে ফেব্রুয়ারি
আজো জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী
আমার শহীদ ভায়ের আত্মা ডাকে
জাগো মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাটে
দারুণ ক্রোধের আগুনে আবার জ্বালবো ফেব্রুয়ারি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।