তারেক মাসুদকে মনে পড়ে যায়
চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ। প্রথম তার গল্প শুনি বন্ধু নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর মুখে, সেই নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে। ‘মুক্তির গান’ ছবিটি সম্পাদনার সময় সরয়ার কিছুদিন তারেক মাসুদের সঙ্গে কাজ করেছেন। তখনও আমার সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি হয়নি। ওই সময় মগজে ছিল গ্রুপ থিয়েটার করে সমাজ বদলের ভাবনা।
সরয়ারের মুখ থেকেই শুনি, ১৯৭১ সালে মার্কিন চলচ্চিত্রকার লিয়ার লেভিন মুক্তিযুদ্ধের ওপর ডকুমেন্টারি নির্মাণ করতে বাংলাদেশে এসেছিলেন। একদল শিল্পীর সঙ্গে তিনি শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে প্রায় ২০ ঘন্টার ফুটেজ সংগ্রহ করেন। পরে আর্থিক অনটনের কারণে সেটি তৈরি করতে পারেননি। দীর্ঘ ১৯ বছর ওই ফুটেজ তার নিউইয়র্কের বাসার বেসমেন্টে পড়ে ছিল। তারেক মাসুদ যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে গেলে সহপাঠী ক্যাথরিনের মাধ্যমে পরিচয় হয় লিয়ার লেভিনের সঙ্গে। ওই ফুটেজের কথা শুনে তিনি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। রাশ ফিল্ম হিসেবে ফেলে রাখা ফুটেজগুলো তারেক মাসুদকে দিয়ে দেন লেয়ার লেভিন।
প্রেম করে বিয়ে করা ক্যাথরিনকে নিয়ে ওই ফুটেজগুলো ব্যবহার করে ‘মুক্তির গান’ নির্মাণ করেন তারেক মাসুদ। ওইসব ফুটেজ সম্পাদনার কাজে কিছুদিন তাদের সঙ্গী হয়েছিলেন আজকের আলোচিত নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তার কাছ থেকেই শুনি, তারেক মাসুদ শৈশবে পড়াশোনা করেছেন মাদ্রাসাতে। আশ্চর্যের ঘটনা, লোকটার সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠি।
বছর দশেক পরে তারেক মাসুদের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ হয়। মুক্তির গানের পরে এরই মধ্যে তিনি নির্মাণ করে ফেলেছেন ‘মুক্তির কথা’, ‘মাটির ময়না’ ও ‘অন্তর্যাত্রা’। বিকল্পধারার নির্মাতা হিসেবে পেয়েছেন খেতাব। সাংবাদিকতায় আসার আট বছর পর ২০০৭ সালে এই মানুষটার মুখোমুখি হই। আমি তখন আনন্দ আলো পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার। তারেক মাসুদ আর ক্যাথরিন মাসুদের একটা দীর্ঘ ইন্টারভিউ করি।
কতো সেলিব্রিটির কতো ইন্টারভিউ-ই তো করেছি। এগুলো যে ‘থ্যাঙ্কস লেস জব’ ততোদিনে জেনে গেছি। তারেক মাসুদ ব্যতিক্রম। তিনি পত্রিকা অফিস থেকে আমার মোবাইল নম্বর চেয়ে নিলেন এবং ফোন করে থ্যাঙ্কস জানালেন।
ইন্টারভিউ এবং থ্যাঙ্কসের এই ঘটনার আরও পাঁচবছর পর গড়ে ওঠলো তারেক মাসুদের সঙ্গে ঘণিষ্ঠতা। সেটাও একটা মজার ঘটনা। আমি ততোদিন মাধ্যম পরিবর্তন করে নিউ জার্নালিজম অনলাইনে চলে এসেছি। এই মাধ্যমটির সঙ্গে এদেশের মানুষের তখন সদ্য পরিচয়। তারেক মাসুদের শেষ চলচ্চিত্র ‘রানওয়ে’র প্রিমিয়ার শো হলো পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে। ছবির প্রদর্শনীর পর দর্শকদের প্রতিক্রিয়া জানাতে আহ্বান করা হলো। কয়েকজন বলার পর আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম। কী বলেছিলাম মনে নেই, তবে বেশ হাততালি পড়েছিল, এটা মনে আছে। হাততালি রেশ কাটতেই স্টেজে দাঁড়ানো তারেক মাসুদ বললেন, অ্যাই তুমি দেখা করে যেও। অনুষ্ঠান শেষে দেখা করলাম। তিনি বললেন, যোগাযোগ নাই কেন? নামটাও তো তোমার ভুলে গেছি। কই আছো এখন? দেখি কার্ড দাও।
অনলাইনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমি তখন তীব্র গতিশীল। কাজ করি বাংলানিউজে। শো শেষ করে অফিসে গেলাম। ‘রানওয়ে’ নিয়ে লেখাটা পোস্ট করে ইমেইলে তারেক ভাইকে লিংকটা পাঠিয়ে দিলাম। বাসায় ফিরলাম রাত ১ টায়। পরদিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তারেক মাসুদের ফোনে ঘুম ভাঙলো। বললেন, এতো দ্রুত নিউজ করলে কীভাবে। হাই তুলে বললাম, সময়ের সংবাদ সময়ে।
সেই থেকে তারেক ভাইয়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ। কখন কী করতেন, নিজেই ফোন করে জানাতেন। বলতেন নানা পরিকল্পনার কথা। একদিন ফোনে বললেন, দেশের সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। হল ভেঙে মার্কেট হচ্ছে। যদি চলচ্চিত্রকে বাঁচাতে হয়, সিনেমা হলকে বাঁচাতে হবে। এই নিয়ে একটা মুভমেন্ট শুরুর কথা ভাবছি। আমি বললাম, ওইসব সিনেমা হলে তো কমার্শিয়াল ফিল্ম চলে। আপনাদের জীবনঘনিষ্ঠ বিকল্পধারার ছবি তো ওইসব হলে চালানো হয় না। তারেক ভাই বললেন, কমার্শিয়াল আর নন-কমার্শিয়াল ফিল্ম বলে কিছু নেই। এফডিসিতে অনেক ভালো ছবি হয়, অনেক ভালো ভালো নির্মাতাও আছে। আমাদের চেয়ে অনেক সুক্ষ কাজ তারা জানেন এবং করেন। তোমাদের চোখে সেগুলো পড়ছে না। ওদের মন্দটাই খালি লিখতে পারো। সিনেমা হলে টিকিট কেটে শেষ কবে ছবি দেখেছো, বলো তো আমাকে।
থতমত খেয়ে গেলাম। এসব কী শুনি তারেক মাসুদের মুখে! আরও যারা জীবনঘণিষ্ঠ ছবির নির্মাতা হিসেবে নিজেদের দাবি করেন তারা তো এফডিসির নির্মাতাদের কাজকে 'অশ্ব ডিম্ব' বলে মনে করেন। বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে বললে তারা নাক কুঁচকে মূলধারার পরিচালকদের গালিগালাজ করতে থাকেন। অথচ বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র নির্মাতাদের প্রতি তারেক মাসুদের এতো উচ্চধারণা এতো সম্মান!
তারেক মাসুদের ‘প্রেক্ষাগৃহ বাঁচাও’ মুভমেন্ট সম্পর্কে আরও জানতে তার সঙ্গে টিএসসিতে দেখা করলাম। টিএসসির বাউন্ডারির পাশে দাঁড়িয়ে তারেক ভাই তার পরিকল্পনা বললেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তিনি যাবেন, সিনেমা হলের মালিকদের সঙ্গে কথা বলবেন, দর্শকদের সঙ্গে কথা বলবেন। সারাদেশে সিনেমা হল রক্ষায় গণমত গড়ে তুলবেন। এলাকাভিত্তিক দর্শক ফোরাম গঠন করবেন। কথাবার্তা শেষে ফিরতে চাইলাম। তারেক ভাই ছাড়বেন না। কিছু খেয়ে যেতে হবে। চলো ডাসে চলো। আমার আরেকটা অ্যাসাইনমেন্টে যাওয়ার তাড়া, কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা। কিছু খেতেই হবে। শেষমেষ ১০০ গ্রাম বাদাম কিনে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, খেতে খেতে চলে যাও। অ্যাসাইনমেন্টে দেরি করে যাওয়া ঠিক হবে না।
তারেক মাসুদ ‘প্রেক্ষাগৃহ বাঁচাও’ আন্দোলনে নেমে পড়লেন। ফোন দিয়ে বললেন, যশোহরের মনিহার সিনেমা হলে যাচ্ছি। যাবে নাকি? আমি বলি, এতো কাজের চাপ কী করে যাই! তবে সঙ্গে সঙ্গে করে ফেললাম নিউজ! অন্যরা পত্রিকায় নিউজ করার আগেই অনলাইনে নিউজ করি, ফেসবুকে ওইসব নিউজ লিংকে তারেক ভাইয়ের মুভমেন্টকে সমর্থন জানিয়ে লাইকের পর লাইক, শেয়ারের পর শেয়ার চলে। ওই নিউজই আবার কপিপেস্ট হয় পরদিন ছাপা হয় ছোটবড় নানা দৈনিকে।
ঘন ঘন তারেক মাসুদের ফোন পাই, ময়মনসিংহ যাচ্ছি। চলো আমার সঙ্গে। ভালো লাগবে। ... হ্যালো বিপুল, খুলনা যাবো। সম্পাদককে বলে ছুটি নিয়ে নাও দুইদিন। খুলনার সিনেমা হলগুলো নিয়ে এক্সক্লুসিভ রিপোর্টও করতে পারবে। আরে চলো চলো।
তারেক মাসুদের সঙ্গে আমার কোথাও যাওয়া হয়নি। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, শেষযাত্রাতেও তিনি আমাকে সঙ্গী হতে বলেছিলেন। ওইসময়ের বাংলানিউজের অনেক কলিগই ঘটনাটা জানেন। হয়তো সেটা সবসময়ের মতো বলা তারেক ভাইয়ের কথার কথাই ছিল।
তারেক মাসুদ তার নতুন প্রজেক্ট ‘কাগজের ফুল’ তৈরির পরিকল্পনার বিষয়ে আমাকে আগেই জানিয়েছিলেন। এটাও জানান যে, শিগগিরই ছবিটি তৈরির কাজে হাত দিবেন। ২০১১ সালের ১২ আগস্ট অর্থাৎ সেই সর্বনাশা দূর্ঘটনার আগের রাতে তিনি ফোন দিয়ে বলেন, লোকেশন দেখতে যাবো কালকে সকালে। মানিকগঞ্জের বালিয়াজুড়ি। যাবে নাকি? একটা পুরনো জমিদার বাড়ি আছে। সেখানেও যাবো। চলো তোমার ভালো লাগবে। খুব ভোরে রওনা দেব, বিকেলের আগেই ফিরবো।
তারেক মাসুদ আর ফিরেননি। তার শেষ যাত্রাতেও আমি সঙ্গী হতে পারিনি।
রাত সাড়ে ১০টার দিকে তিনি ফোন দিয়েছিলেন, আমি তখন বাসায়। ‘কাগজের ফুল ছবির লোকেশন খুঁজতে মানিকগঞ্জে তারেক মাসুদ’, এরকম একটা হেডিংয়ে নিউজটা করে অফিসে মেইল করবো বলে পিসিতে গিয়ে বসলাম। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল খুব। পিসিতে বসে দেখি নেট নাই। বৃষ্টি-বাদলার সময় এই সমস্যটা হয়। নিউজটা করা হলো না। সকালে অফিসে গিয়ে করবো ঠিক করে বিছানায় গেলাম। আজি ঝর ঝর মুখরও বাঁদর দিনে.. শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গেলাম।
একটু দেরিতে বিছানা থেকে ওঠা এবং দেরি করে অফিসে যাওয়া আমার দীর্ঘদিনের বাজে অভ্যাস। সেদিনের সকালটাও শুরু হলো ধীরগতিতে। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে অফিসে ঢুকলাম। পিসি ওপেন করে কাজ শুরু করতে করতে পেরিয়ে গেল আরো ১৫ মিনিট। প্রথম নিউজটা লিখতে শুরু করলাম, নতুন ছবি ‘কাগজের ফুল’ এর লোকেশন খুজঁতে হন্যে হয়ে দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটছেন তারেক মাসুদ। বিকল্পধারার জীবন ঘণিষ্ঠ চলচ্চিত্রে এই নির্মাতা অবশেষে মানিকগঞ্জের ঘাটাইলে...।
এই পর্যন্তই। এক সহকর্মী ছুটে এসে বললেন, তারেক মাসুদ মানিকগঞ্জে এক্সিডেন্ট করেছেন! এটিএন নিউজে স্ক্রল দিচ্ছে। এটিএনের সিইও মিশুক মুনীরও তার সঙ্গে ছিলেন। দুজনই নাকি মারা গেছেন। ড্রাইভারসহ আরো বেশ কয়েকজন মারা গেছেন। খোঁজ নেন খোঁজ নেন।
প্রথমে ভাবলাম, রসিকতা... নাহ, মৃত্যু নিয়ে তো কেউ রসিকতা করে না। বোকার মতো প্রথমেই তারেক মাসুদের নম্বরে কল দিলাম। ফোন বন্ধ। কল দিলাম ক্যাথরিন মাসুদের নম্বরে। কয়েকবার রিং হলেও তিনি রিসিভ করলেন না। তারেক ভাইয়ের এসিস্টেন্ট মনীশ রফিকের নম্বরটাও ছিল আমার কাছে। একবার রিং হতেই তিনি ফোন ধরলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, বিপুল ভাই... সবশেষ সবশেষ।
চোখের পানি মুছতে মুছতে আগের নিউজটা ডিলেট করে নতুন করে লিখলাম, ‘জীবনঘণিষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও এটিএন বাংলার প্রধান নির্বাহী মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোখা এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। তারেক মাসুদের সহকারী মনীশ রফিক দুর্ঘটনাস্থল থেকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান....।’
তের বছর আগের ঘটনা। অনেক লম্বা সময়। তবুও তারেক মাসুদের প্রয়াণ দিনে প্রতিবারের মতো এবারও সেইসব ঘটনা ছায়াছবির মতো চোখে ভাসছে।
লেখক : ডেপুটি চিফ নিউজ এডিটর/ অনলাইন ইনচার্জ, আরটিভি
মন্তব্য করুন