সঞ্জীব চৌধুরীর চলে যাওয়ার ১৭ বছর
‘গাড়ি চলে না চলে না/চলে না রে, গাড়ি চলে না’। বাউল শাহ আব্দুল করিমের লেখা বাংলাদেশের গানের ইতিহাসে এক অনন্য সৃষ্টি। এই গানের মধ্য দিয়ে দেহতত্ত্বের বিষয়টি এতো চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে যা অনবদ্য। আর এই গানটি বাংলাদেশের সব শ্রেণির মানুষের কাছে জনপ্রিয় করতে বিশেষ ভূমিকা রাখা মানুষটির নাম সঞ্জীব চৌধুরী।
যে মানুষটি গানে গানে বলে গেছেন মানব জীবনের গাঁথা। প্রেম, বিরহ, সমাজ, রাজনীতি, প্রতিবাদ, দ্রোহ সমানভাবে তার গানে লেপ্টে আছে। ২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর দেহ ত্যাগ করলেও তার সেই ‘দেহ’ নামক গাড়িটির সৃষ্টিশীলতা এখনও চলছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
কবি, সাংবাদিক, গীতিকার, সুরকার, গায়ক এবং সংগঠক হিসেবে খ্যাতি ছিল মেধাবী মানুষ সঞ্জীব চৌধুরীর। ব্যান্ড দল ‘দলছুট’-এর প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর হবিগঞ্জের মাকালকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সঞ্জীব। শরীরে জমিদার বংশের রক্ত থাকার পরও সঞ্জীব চৌধুরী পুঁজিবাদ আর সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। প্রতিটি লড়াই সংগ্রামে তার সক্রিয় অবস্থান ছিল।
গানে গানে তিনি যেভাবে প্রতিবাদের ভাষা রপ্ত করেছিলেন তা বাংলা সংগীতে বিরল! শাসকদের চোখ রাঙানিতে যখন কম্পিত গোটা বাংলা, প্রতিটি সাধারণ মানুষের পদক্ষেপ যেখানে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করা হচ্ছে সেখানে তিনি ঠিকই শোষকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ তোলে গেছেন তার গানের মধ্য দিয়ে।
অবরুদ্ধ সময়েও তার গান থামেনি। চারদিকে যখন বেয়নেট আর জলপাই রঙের ওড়াওড়ি তখনও তিনি বুক চিতিয়ে বলেন, ওরা বলে, ওই গাড়িতে করে আমাদের জন্য খাদ্য আর পানীয় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন বন্ধুগণ, আমি জানি ওই গাড়িতে আমাদের জন্য কোন খাদ্য ছিল না, আমাদের জন্য কোনো পানীয় ছিল না। ৩০০ লাশ…। ৩০০ টি লাশ ঠান্ডা, হিম! যাদের খুন করে ফেলা হবে। আমি বলতে চেয়েছিলাম সেই সত্য কথা। আর তখনই আমার দিকে এগিয়ে আসে উদ্ধত রাইফেল। আমার দিকে এগিয়ে আসে উদ্ধত বেয়োনেট। ওরা বলে খামোশ…। তবুও বন্ধুগণ, আমার স্বপ্নেরই কথা বলতে চাই, আমার অন্তরের কথা বলতে চাই।
পুরোদস্তুর রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলেন সঞ্জীব চৌধুরী। বাম ঘরানার রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা ছিল তার। ঢাকা কলেজে পড়ার সময় বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন তিনি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আরও গভীরভাবে ছাত্র ইউনিয়নের জন্য নিবেদিত প্রাণ হয়ে ওঠেন। দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। সাংস্কৃতিক ইউনিয়নের সম্পাদক ছিলেন। মূলত তার লড়াই সংগ্রাম আর প্রতিবাদের যে মূর্তি ছিল তা তার শিক্ষাজীবন থেকেই গড়ে ওঠে।
ঢাবিতে সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনা শেষ করে আশির দশকে সাংবাদিকতা শুরু করেন সঞ্জীব চৌধুরী। আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ ও যায়যায়দিনসহ বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় কাজ করেছেন। সর্বশেষ কাজ করেছিলেন যায়যায়দিনের ফিচার এডিটর হিসেবে। তার হাত ধরেই মূলত দৈনিক পত্রিকায় ফিচার বিভাগের যাত্রা শুরু। এ সময় তার সহকারী ছিলেন নব্বই দশকের শক্তিমান কবি কামরুজ্জামান কামু। সঞ্জীব চৌধুরী ব্যান্ড ‘দলছুট’ গঠন করলে সেসময় তার জন্য একাধিক জনপ্রিয় গান লেখেন কবি ও নির্মাতা কামরুজ্জামান কামু।
সঞ্জীব চৌধুরীর জন্য কামুর লেখা গানগুলোর মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। এরমধ্যে তোমার বাড়ির রঙের মেলায়, হাতের ওপর হাতের পরশ রবে না, তোমার ভাঁজ খোল আনন্দ দেখাও এবং রিকশা কেন আস্তে চলে না উল্লেখযোগ্য।
আরটিভি/এএ
মন্তব্য করুন