বিভিন্ন গণমাধ্যম জানিয়েছে, তুরস্কের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করতে সৌদি কোম্পানিগুলোর ওপর চাপ দিয়ে যাচ্ছে সৌদি আরব। এর মধ্যে একটি তুরস্কের পণ্য বর্জনসহ বিনিয়োগ এবং পর্যটন খাতে সম্পর্ক ছিন্ন করা।
বেশকিছু ইস্যুতে সম্প্রতি দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। আরব বসন্তের প্রতি সমর্থন এবং কাতার বয়কট ইস্যুতে সৌদিসহ সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মিশর সিদ্ধান্তের বিরোধিতার কারণে সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে।
তবে গত বছরের ২ অক্টোবর ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ডের পর রিয়াদ-আঙ্কারা উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পায়। অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে তুরস্কের শক্ত অবস্থান পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তোলে।
সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কের পণ্য বর্জনের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক একটা অবস্থান নিয়েছে আরব। দেশটির কাউন্সিল অব সৌদি চেম্বারস অব কমার্সের চেয়ারম্যান আজলান আল-আজলান তুর্কি পণ্য বর্জনের ব্যাপারে সৌদি ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
সৌদি আরবে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন গত মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় করা এই শান্তিচুক্তি ওয়াশিংটনে স্বাক্ষরিত হয়।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এই চুক্তির সঙ্গে তুরস্কের পণ্য বর্জনের ব্যাপারে সৌদির ‘আধা-আনুষ্ঠানিক’ প্রচারণার একটি সম্পর্ক রয়েছে। তারা বলছেন, এটা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার এবং বাহরাইন ও আমিরাত হয়ে সৌদির বাজারে ইসরায়েলি পণ্য প্রবেশের পথ খুলে দেয়ার ‘অনানুষ্ঠানিক’ ও পরোক্ষ পদক্ষেপ।
ওয়াশিংটনে সৌদি আরবের সাবেক রাষ্ট্রদূত প্রিন্স বন্দর বিন সুলতান সম্প্রতি ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের সমালোচনা করেছেন। তার ভাষায় ইসরায়েলের সঙ্গে সমঝোতায় যাওয়ার সুযোগ নষ্ট করেছে তারা। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েলের ব্যাপারে ব্যাপক পরিসরে জনমত গঠনের জন্যই এমন মন্তব্য করেছেন প্রিন্স বন্দর।
আর আজলান তুর্কি পণ্য বয়কটের ব্যাপারে যে মন্তব্য করেছেন তা সৌদির শীর্ষ নেতৃত্বের সবুজ সংকেত ছাড়া যে হয়নি সে ব্যাপারে নিশ্চিত বিশ্লেষকরা। কেননা, সৌদি আরবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই, তাই এ ধরনের মন্তব্য করার ক্ষেত্রে অবশ্যই শীর্ষ নেতৃত্বের ‘আশীর্বাদ’ রয়েছে।
আরও পড়ুনঃ
একক সরকার গঠনের পথে জেসিন্ডা আর্ডেন
যুক্তরাষ্ট্রে রেকর্ড সংখ্যক আগাম ভোট
আর্মেনিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় আজারবাইজানে নিহত ১২
তবে তুর্কি পণ্য বর্জনের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছে সৌদি আরব। সৌদি আরবের মিডিয়া অফিসের বরাত দিয়ে রয়টার্স এমন খবর জানিয়েছে। অফিস জানিয়েছে, মুক্ত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি এবং চুক্তির ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সৌদি আরব।
সৌদি জোর দিয়ে বলেছে যে, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য উল্লেখযোগ্য কোনও ঘাটতি দেখা যায়নি। তবে সাম্প্রতিক মন্দা করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাবে হয়েছে বলে জানিয়েছে রিয়াদ।
এদিকে তুরস্কের ব্যবসায়ীদের আটটি বড় গ্রুপের প্রধান গত ১০ অক্টোবর এক যৌথ বিবৃতিতে অভিযোগ করেছেন যে, সৌদি কোম্পানিগুলো তাদের জানিয়েছে- তুরস্ক থেকে পণ্য আমদানি না করতে তাদের কাগজে সই করতে বাধ্য করছে সৌদি সরকার।
এমনকি সৌদি গুরুত্বপূর্ণ টেন্ডারে এখন আর তুর্কি ঠিকাদাররা অংশ নিতে পারছেন না বলেও অভিযোগ করেন তারা।
যেসব গ্রুপ এই যৌথ বিবৃতিতে সই করেছে, সেগুলো হলো- টেক্সটাইল রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান, ঠিকাদার, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, ট্রেড ইউনিয়নের কর্মকর্তাবৃন্দ, বিদেশি অর্থনৈতিক সম্পর্ক অফিস, রপ্তানিকারক সমিতি এবং ফেডারেশন অব চেম্বারস অ্যান্ড কমোডিটি এক্সচেঞ্জস।
তুরস্কের বৈদেশিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক কমিটির প্রধান নেইল ওলপাক গত ২ অক্টোবর এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছেন, এই মাসের শুরু থেকেই তুর্কি পণ্য বর্জনের ব্যাপারে কমিটি অব সৌদি আরবের সদস্যদের কাছ থেকে তথ্য পেয়েছেন।
তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০১৫ সালে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫.৫৯ বিলিয়ন ডলার। পরের বছর তা কমে দাঁড়ায় ৫ বিলিয়ন ডলার এবং ২০১৭ সালে এটা হয় ৪.৮৪ বিলিয়ন ডলার। তবে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে বাণিজ্যের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৪.৯৫ বিলিয়ন ডলার ও ৫.১ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে বাণিজ্যিক সমতা তুরস্কের দিকেই ঝুঁকছে। ২০১৫ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত সৌদি আরব থেকে আমদানি থেকে রপ্তানিই বেশি করেছে। ওই সময় উভয় দেশের রপ্তানি পার্থক্য ছিল প্রায় ১.৩ বিলিয়ন ডলার। তবে ২০১৮ সালে উভয় দেশের মধ্যে পার্থক্য অনেকটাই কমে আসে। তখন দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক উত্তেজনা চলছিল। তবে ২০১৯ সালে বাণিজ্য ভারসাম্য আবারও প্রতিষ্ঠিত হয়।
এর ফলে তুর্কি পণ্য বর্জন করলেও দেশটির অর্থনীতির ওপর খুব একটা প্রভাব পড়বে না। তবে যেসব তুর্কি কোম্পানি, বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ী মূল অগ্রাধিকার সৌদি মার্কেট তাদের ওপর এর প্রভাব পড়বে।
এদিকে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দুই দেশের মধ্যে যে বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে, এর সঙ্গে রাজনৈতিক উত্তেজনা নয় বরং করোনাভাইরাসের প্রভাব রয়েছে। কিন্তু খুব সহজেই তুর্কি পণ্যের বিকল্পে অভ্যস্ত হতে পারবে না সৌদিরা।
কারণ তাদের চাহিদার একটা বড় অংশজুড়ে রয়েছে তুর্কি পণ্য। এসব পণ্যের দামও কম আবার মানও উন্নত। সেক্ষেত্রে তুর্কি পণ্য বর্জন করলে এর একটা বাড়তি চাপ পড়বে সৌদি ভোক্তাদের ওপর।
এমনকি সৌদির নেটিজেনরা তুর্কি পণ্য বর্জনের বিরোধিতাও করেছে। তাই সৌদি সরকার হয়তো তুর্কি পণ্য নিষিদ্ধের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নাও নিতে পারে। সেক্ষেত্রে হয়তো উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য লেনদেন সহসাই বন্ধ হবে না।
(আনাদোলু এজেন্সি থেকে অনূদিত)
এ