সময়টা এক যুগ পেরিয়েছে। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ। ২৬ ডিসেম্বর। ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে কিছুটা হালকা গড়নের টগবগে তরুণ মাশরাফি বিন মর্তুজার সত্যিকারের বাঘ হয়ে হুংকার ছোড়ার যেসব দৃশ্য চিত্রায়িত হয়েছিল, মনের গহীনে তা আজো লেপ্টে আছে অমলিন চিত্রকলা হয়েই। উফ্ সেকি আনন্দ, সেকি উচ্ছ্বাস! গোটা স্টেডিয়াম বাঘের গর্জনে যেনো হালুম হালুম করছিল। শীতের রাত, কিন্তু শীত কই? ২৬ হাজার দর্শকের গরমে উত্তপ্ত গোটা গ্যালারি। শীতের রাতের সেই স্বপ্ন পূরণের মুহূর্তগুলো যেনো কেবল মাঠের ১১ জনের নয়, গ্যালারির ২৬ হাজার আর সারাদেশের ১৩ কোটি (তখনকার) বাঙালি সবার।
ক্রিকেটপাগল মানুষগুলো তখন সবে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে মোহাম্মদ আশরাফুল আর মাশরাফি বিন মর্তুজাদের একক কিছু যুদ্ধ জয়ের গল্পে অনুপ্রাণিত হয়ে। তখন পর্যন্ত বাংলার বাঘরা কেবল বধ করেছিল পরাশক্তি পাকিস্তানকে। ক্রিকেটের বনেদি পরিবারের আর কাউকে তখনো মাথানত করানো যায়নি।
২০০১ সালে ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান হয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে ‘আশার ফুল’ হয়ে ফোটা ‘ অ্যাশ’ তখনো ঠিক নিজেকে পুরোপুরি মেলে ধরতে পারেননি। তবে মাঝেমধ্যেই ঝোড়ো ইনিংস উপহার দিয়ে স্ট্রোক খেলার সামর্থ্যের বিচারে দলের সবচেয়ে বড় আশা হয়েই মাঠে নামতেন তিনি। আর মাশরাফি তখন যেনো একেবারে তরুণ বাঘ, ছিঁড়ে খেতে পারে এরকম অবস্থা। ইনসুইং, আউট সুইং আর ৮০ মাইল গতির বলে স্টাম্প উপড়ে ফেলা তখন তার নতুন নেশা। এ নেশায় মাতাল তখন পুরো জাতি। বাঙালি যদি কিছু করে তো এ দু’জনের রসায়নেই কিছু করবে, এমন বিশ্বাস নিয়েই খেলা দেখতে বসতো মানুষ।
আমার মনে আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে সবে ভর্তি হয়েছি তখন। নতুন যাদের পেলাম ডিপার্টমেন্টে আর হলে; সব দেখি খেলার পাগল। আগে আমি ভাবতাম, কেবল আমিই পাগল। ওমা, এখানে দেখি পাগলের মেলা। দেশের খেলা বলতে সবাই একেবারে বেহুঁশ। টিভি রুম ছাড়া কোথাও কাকপক্ষীও থাকে না। এমনকি অডিটোরিয়ামের জানালার পাশে মনে হয় পক্ষীকূলও খেলা দেখায় মেতে থাকে। টাইগাররা কেউ আউট হয়ে গেলে হলরুমে যখন পিনপতন নীরবতা নেমে আসতো তখন তাদের কা কা আর কিচিরমিচির শোনা যেতো!
এরকম এক সময়ে বাংলাদেশে এলো সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বে ভারতীয় দল। ২৬ ডিসেম্বর ২০০৪, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে দিবারাত্রির ওয়ানডে ম্যাচ। প্রথমে খেয়াল ছিল না, পরে পত্রিকা পড়ে দেখি এটি বাংলাদেশের শততম ওয়ানডে। আর কে ঠেকায়, স্টেডিয়ামে গিয়েই এ খেলা দেখতে হবে পণ করলাম। কষ্টেসৃষ্টে টিকেটও যোগাড় হলো। স্টেডিয়ামে ঢোকার পর থেকে কেনো জানি মনের ভেতর প্রজাপতির নাচন শুরু হলো। কোনোকিছু নিয়ে খুব আশাবাদী হলে যেমন অনুভূতি, ঠিক তেমন কিছুই কি ঘটবে আজ?
শেষ পর্যন্ত ঘটেই গেলো। মাশরাফির অলরাউন্ড নৈপুণ্যে গাঙ্গুলি-টেন্ডুলকারদের ভারতবধ! এ যে কী আনন্দের, কী অসাধারণ প্রাপ্তি-তা যারা সেই সময়ে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ছিল কেবল তারাই বুঝেছে। বাইরে যারা ছিল তারাও এর স্বাদ পেয়েছে, কিন্তু গ্যালারির ২৬ হাজার দর্শকের যে লাফিয়ে লাফিয়ে গগন-বিদারি ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ চিৎকার, তাতো আর বাইরে বসে পাওয়া সম্ভব নয়। সেই অবর্ণনীয় আনন্দময় মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, স্টেডিয়ামের ভেতরে বুঝি ভূমিকম্প চলছে! যতোক্ষণ নিজে লাফিয়েছি টের পাইনি, একটু থামতেই তা টের পেয়ে একরকম ভয়ই পেয়েছিলাম, যদি ভেঙে যায় গ্যালারি! মনে হতেই এতোদিন পরেও এক চিলতে হেসে নিই ভেতরে ভেতরে, মানুষের ভারে কি আর গ্যালারি ভাঙে?
শ্রীলংকার কলম্বোতে পি সারা স্টেডিয়ামে বুধবার যখন টাইগাররা সিরিজের ২য় টেস্ট খেলতে নামবে একটা ইতিহাস কিন্তু রচিত হবে। ১০ম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ১শ’ টেস্ট খেলার গৌরব অর্জন করবে। শততম টেস্ট খেলতে পারা কেনো গৌরবের হবে, অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে।বলছি।
টেস্ট স্ট্যাটাস পাবার পর ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক দেশগুলোর অনেকেই কিন্তু বাংলাদেশের এ অর্জনকে সাধুবাদ জানায়নি। অনেকে বলেছে, দরকারই ছিল না, শুধু শুধু একটা দল বাড়িয়ে দিলো আইসিসি। অনেকের আত্মসম্মানে ঘা লাগতো আমাদের বিপক্ষে খেলতে। মুখ বাঁকা করে বলতো, বাংলাদেশের সঙ্গে খেলা? ঠিক আছে, অমুক অমুককে বিশ্রাম দিয়ে দাও, এ দল পাঠিয়ে দাও, বি দল পাঠিয়ে দাও-ইত্যাদি ইত্যাদি।
মানলাম, ১৬ বছর পরে পরিসংখ্যান আমাদের পক্ষে কথা বলছে না। কিন্তু একেবারে খারাপও কী? এ তো কয়েকদিন আগেই বনেদি ইংল্যান্ডকে একরকম নাকানিচুবানি খাইয়ে টেস্ট জিতলাম আমরা। অস্ট্রেলিয়া তো আসবে আসবে বলে আসছেই না, নিন্দুকেরা বলে; ভয়েই আসছে না! নিউজিল্যান্ডেও জয়ের খুব কাছাকাছি ছিলাম আমরা। আর ভারত, সে তো ১৬ বছর পর এবারই প্রথম আতিথ্য দিলো। আর তাদের মাটিতে প্রথম খেলতে নেমেই ম্যাচটাকে ৫ম দিনে নিয়ে গিয়ে ড্র কিংবা জয়ের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল তা কি কম?
এক ক্রীড়া সাংবাদিক দু’দিন আগে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন ফেসবুকে, আমার ভীষণ মনে ধরেছে। তিনি লিখেছেন ‘আমরা কি এ দলের কাছে অন্তত টেস্টে বেশি বেশি প্রত্যাশা করছি না? দলটা বছরে ক’টা টেস্ট খেলেছে এতোদিন?’।
ঠিকই তো, ১৬ বছর পার করেছে, কিন্তু অন্য দল এ সময়ে যতো টেস্ট খেলেছে, বাংলাদেশ কি তার অর্ধেকও খেলতে পেরেছে? পারেনি। আর টেস্টে ভালো করতে হলে দরকার ঘরোয়া ক্রিকেটে লংগার ভার্সনের খেলায় জোর দেয়া, প্রণোদনা দেয়া। সেই কাজটি কি ঠিকঠাক করেছে বিসিবি? করেনি। তারা তো বিপিএলের নেশাতেই বুঁদ, ইহার ভেতরেই তাহারা দেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ দেখেন!
এ বাস্তবতা যখন টাইগার দলের তখন শততম টেস্ট খেলতে নামতে পারাও একটা অর্জনই বটে। বাংলাদেশ দলের উচিত ঐতিহাসিক ক্ষণটিকে উপভোগ করা। মাঠে কী হবে, সেই চিন্তা বেশি বেশি করার কোনো কারণ আমি দেখি না। প্রথম টেস্টে গলে ৩০ মিনিটের যে ঝড় বয়ে গিয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তি না হলেই কেবল হয়। সাম্প্রতিক সবগুলো টেস্ট আরেকবার ফিরে দেখলে এ বিশ্বাস অন্তত ভক্তদের মনে থাকবে যে, খেলায় কম্পিটিশন হবে। কিছু মুহূর্ত যে দলের পক্ষে যাবে সেই দলই জিতবে। একেবারে শুরুতেই ছেড়ে দেয়ার অবস্থা এখন আর বাংলাদেশ দলের সদস্যদের নেই। সেই মানসিকতা সত্যিকার অর্থেই পেছনে ফেলে এসেছে টাইগাররা। দলের সঙ্গে থাকা গণমাধ্যমের কর্মীরা বিষয়টা বেশ জানেন। শক্তি ও সামর্থ্যে অন্তত ৪/৫ বছর আগের বাংলাদেশের চেয়ে বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে এখনকার দল। এখন কাজ কেবল সামর্থ্য অনুযায়ী পারফর্ম করা আর কিছু ক্ষেত্রে ভাগ্যের সহায়তা পাওয়া। এ দু’টো সূত্র মিললে ভালো ফল আসবে।
ভালো করার আবার কিছু বিশেষ উপলক্ষও নাকি থাকে। উপলক্ষরা সাহস হয়ে মাঠে নেমে পড়ে। তখন স্বাভাবিক পারফর্মেন্স আর অন্যরকম সাহস মিলে প্রতিপক্ষকে তাজা গিলে খেতে মন চায়। এক যুগ আগে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের ঐতিহাসিক সেই ম্যাচে এমনই কিছু হয়েছিল নিশ্চয়ই। নচেৎ তখনকার বিশ্বের দু’নম্বর দল (বিশ্বকাপের রানার্স-আপ) ভারতকে হারানোর ক্রিকেটীয় সামর্থ্য কি ছিল বাংলাদেশের? বাস্তবতা মানলে ছিল না। কিন্তু শততম ম্যাচের ঐতিহাসিক ক্ষণকে স্মরণীয় করে রাখতে কী ভয়ংকরভাবেই না ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাংলার বাঘেরা। আরেকবার যখন শতকের উপলক্ষ এলো, হোক সেটা টেস্ট ম্যাচ; স্মরণীয় কিছুই তবে হোক না। কলম্বোর পি সারা স্টেডিয়ামে পড়ুক না বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ছায়া! শতকে শতকে যে মিল, ম্যাচের ফলেও থাক না সে মিল!
লেখক- গণমাধ্যমকর্মী