নাইজেরিয়ার স্থপতির সৃষ্টি বিশ্বের নজর কাড়ছে
বুর্জ খালিফা বা ধনীদের বিলাসবহুল ভবনের মতো স্থাপত্যের নিদর্শনের সন্ধানে সাধারণত আফ্রিকার প্রসঙ্গ উঠে আসে না৷ নাইজেরিয়ার এক স্থপতি আফ্রিকা মহাদেশকেও স্থাপত্যের মঞ্চে স্থান দেওয়ার চেষ্টা করছেন৷ এই স্থপতির ডিজাইন শুধু কাজ চালানোর বদলে সমস্যা সমাধানের লক্ষ্য পূরণ করে৷ কিন্তু স্থাপত্যের ক্ষেত্রে ভবনগুলি কেন মানুষের চাহিদা পূরণের বদলে প্রযুক্তিগত মানদণ্ডের শর্ত পূরণ করার লক্ষ্যে ডিজাইন করা হয়? আকোসে এনেবেলি কীভাবে ঠিক সে ক্ষেত্রেই পরিবর্তন আনছেন?
নিজের ভাবনা ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, আমরা আমাদের ডিজাইনের ক্ষেত্রে মানুষকেই কেন প্রাধান্য দেই। কারণ মানুষই বেশিরভাগ ভবনের চূড়ান্ত ব্যবহারকারী৷ এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা বাসা থেকে দূরে গেলে সত্যি আবার ফিরে আসার তাগিদ অনুভব করেন৷ কারণ সেটাই তাদের আশ্রয়ের জায়গা৷ ফলে মানুষ বা চূড়ান্ত ব্যবহারকারীরাই আমাদের বেশিরভাগ ডিজাইনের মূল লক্ষ্য৷
কিন্তু প্রশ্ন হলো, লাগোসের মতো জনবহুল শহরে আকোসে কীভাবে এমন স্পেস সৃষ্টি করতে পারেন? এই প্রশ্নের উত্তরের আগে জানা যাক, তিনি আদৌ কেন স্থপতি হয়ে উঠলেন৷
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আকোসে বলেন, সত্য ঘটনা হলো, স্থাপত্যই আমাকে বেছে নিয়েছে৷ আমি সেটা বারবার বলি, কারণ সেই দুই বছর বয়স থেকেই আমি আঁকছি৷ আসলে বাড়িঘর এঁকে চলেছি৷ এ প্রসঙ্গে আমার বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই, কারণ তিনি এখনো বেশিরভাগ ড্রয়িং রেখে দিয়েছেন৷ সেকেন্ডারি স্কুল শেষ করার সময় সবাই ভাবনাচিন্তা শুরু করে, আমি ডাক্তার হতে চাই, ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই৷ আমি ঠিক করেছিলাম, হয় স্থপতি হবো, না হলে কিছুই করবো না৷ স্কুলে নির্দিষ্ট একটি ঘটনা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, যে আমি স্থাপত্যের জন্য প্রস্তুত৷ আমরা যখন স্কুলে ছিলাম, তখন স্কেচ ও ড্রয়িং করতাম৷ তখনো কম্পিউটার-ভিত্তিক ডিজাইন তেমন ছড়িয়ে পড়েনি৷
আমার আঁকা এতই নিখুঁত ছিল, যে আমার লেকচারার একবার প্রায় ফেল করিয়ে দিয়েছিলেন৷ কারণ তিনি নিশ্চিত ছিলেন, যে আমি কম্পিউটার ব্যবহার করে সেটা এঁকেছি৷ সেই মুহূর্তটি কখনো ভুলবো না৷ কারণ মনে হয়েছিল আমি সত্যি কোনো ভালো কাজ করছি৷
আকোসে এনেবেলি এল আর্ক ডিজাইন্স কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার৷ বেশ কয়েক বছর ধরে সেই সংস্থা ভিন্নধর্মী ও ডিসরাপটিভ ডিজাইন সৃষ্টি করে চলেছে৷ নাইজেরিয়ার অনেক ধনী ব্যক্তির বাসার নক্সাও করে দিয়েছে তারা৷ কিন্তু নিজের ডিজাইনের মাধ্যমে তিনি কীভাবে এই শিল্পখাতে ডিসরাপশন বা বিঘ্ন ঘটান?
সেই মনোভাবের ব্যাখ্যা করে আকোসে এনেবেলি বলেন, আমাদের ডিজাইনের মধ্যে টেকসই প্রণালী সম্পৃক্ত করতে আমরা সব সময়ে উপকরণের দিকে নজর দেই৷ এ ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছেন, আমরা কীভাবে দেওয়ালে পাথর ব্যবহার করেছি৷ পাথর এক প্রাকৃতিক উপাদান, যে কারণে প্রায় কোনো রক্ষণাবেক্ষণেরই প্রয়োজন হয় না বলা চলে৷ তাই আমরা টেকসই উপাদান ও জ্বালানি সাশ্রয়ের দিকে নজর দেওয়ার চেষ্টা করি৷ এই ভবনে সব কাচই ডাবল গ্লেজড যা বাড়ির মধ্যে উত্তাপ কমিয়ে দেয়৷ ফলে বিদ্যুতের ব্যবহারও কমে যায়৷ ভবন শীতল থাকে৷
তাই ভবনের ডিজাইনের সময়ে আমরা টেকসই উপাদান সম্পৃক্ত করি৷ শতবর্ষের বেশি প্রাচীন আন্তর্জাতিক ডিজাইন কর্তৃপক্ষের তালিকায় নাইজেরিয়ার প্রথম স্থপতি হিসেবে তিনি স্থান পেয়েছেন৷ অনেকেই সেই স্বীকৃতির স্বপ্ন দেখেন৷ স্থাপত্যের ক্ষেত্রে আকোসের কীর্তি মানুষের চাহিদা পূরণ করে৷ কিন্তু এই শিল্পখাতে কিছু চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও তিনি কীভাবে নিজের আইডিয়া কার্যকর করেন এবং নিজস্ব উদ্যোগ চালিয়ে যান?
এর উত্তরে আকোসে বলেন, বাণিজ্যিক স্থাপনার ক্ষেত্রে আমরা যে কোনো ব্র্যান্ডের সঙ্গে কাজ করি৷ বেশিরভাগ ব্র্যান্ডের নিজস্ব পরিচয় রয়েছে৷ তারা নিজস্ব ব্র্যান্ডের প্রতিনিধি হিসেবে কিছু উপাদান একত্র করেন৷ আমরা সেই ভবনের মধ্যেই সেই সব উপাদান সম্পৃক্ত করে সেই স্পেসের সঙ্গে ব্র্যান্ডের মেলবন্ধন ঘটানোর চেষ্টা করি৷ যে কেউ সেই স্থাপনায় প্রবেশ করলে আপনার ব্র্যান্ডের বৈশিষ্ট্য বুঝতে পারবে৷
যেমন ব্র্যান্ডে হলুদ রং থাকলে আমরা সেই রং ব্যবহারের চেষ্টা করি৷ হলুদ রং অবশ্যই মনমেজাজ চাঙ্গা করে তোলে৷ তাই আমরা সেই স্পেসের মধ্যে সেটা কোনোভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করি৷ আবেগপ্রবণ স্থপতি হিসেবে তিনি অ্যাফ্রোবিটস সংগীতশিল্পী বার্না বয়ের মতো নাইজেরিয়ার শীর্ষ স্তরের খ্যাতিমান ব্যক্তিদের জন্য ভবন ডিজাইন করেছেন৷
তিনি উদ্ভাবনের কাজ চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি উচ্চ মানদণ্ডও বজায় রাখার চেষ্টা করছেন৷ উদাহরণ হিসেবে একটি প্রকল্পের বিষয়ে আকোসে বলেন, আমাদের ডিজাইনের মধ্যে আমরা এমন একটা ধারণা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলাম, যে সুইমিং পুল ভবনটিকে যেন ছুঁয়ে রয়েছে৷ পরিকল্পনা থেকে শুরু করে নির্মাণের সময় পর্যন্ত আমাদের মনে সেই ধারণা কাজ করেছে৷ আমরা সেই ডিজাইনকে ইন্টারেস্টিং করে তুলতে বসার ঘরটিকে সুইমিং পুলের উপর ভাসমান অবস্থায় রাখতে চেয়েছিলাম৷ প্রাথমিক ভাবনাচিন্তার সময় আমাদের মনে সেই আইডিয়া এসেছিল, যদিও সেটা পাগলামি মনে হয়েছিল৷
তারপর আমরা আরো এক ধাপ এগিয়ে বসার ঘরকে শুধু পুলের উপর ভাসমান করে তুলেই ক্ষান্ত হইনি৷ ভবনের একটি অংশ এমনভাবে গড়ে তুলেছি যে, সেখানে যেতে হলে পুলের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে হয়৷ সেই ইন্টারেস্টিং চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে শেষ পর্যন্ত আমরা সেই পরিকল্পনা কার্যকর করতে সমর্থ হয়েছি৷
কাঠামোর ঊর্ধ্বে ভাবনাচিন্তা করা কেন আকোসের জন্য জরুরি? সেই মনোভাব কীভাবে সমাজে স্থাপত্যের ভূমিকায় পরিবর্তন আনতে পারে?
আকোসে এনেবেলি বলেন, সম্ভাবনার সীমা ঠেলে দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা বিশ্বের দরবারে নাইজেরিয়ার স্থাপত্য নিয়ে আমাদের গর্ব তুলে ধরারও চেষ্টা করি৷ আমি নিশ্চিত, যে আমাদের সৃষ্টি করা ভবনগুলি দেখলে অনেকে বিশ্বাসই করেন না, যে সেগুলি নাইজেরিয়ায় থাকতে পারে৷
আমার মনে আছে, যখন ইগালো ও বার্না বয়ের ভবন দেখিয়েছিলাম, তখন অনেকে সে রকমটা আশা করেনি৷ এমন প্রকল্প আসলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ আমরা নাইজেরিয়ার সেলিব্রিটি লিভিং তুলে ধরেছিলাম৷ সবাই এখন জানতে চাইছে, আফ্রিকা থেকে নতুন কী উঠে আসছে৷ আমরাও সেটা করার চেষ্টা করছি৷ নাইজেরিয়া তথা আফ্রিকার দিকে আর মুখ ফিরিয়ে রাখলে চলবে না৷ নান্দনিকতার প্রতি নজর দেওয়ার পাশাপাশি স্থপতিদের বড় আকারে সমস্যার সমাধানকারীর ভূমিকাও পালন করতে হয় বলে আকোসে মনে করেন৷
বাস্তব জগতে মানুষের চ্যালেঞ্জগুলির ভিত্তিতে নগরের পরিবেশ ও সামাজিক এলাকাগুলিতেও রদবদল আনতে হয়৷ তার মতে, উদ্দেশ্য সামনে রেখে ডিজাইন করা উচিত৷ প্রচলিত ধ্যানধারণাও চ্যালেঞ্জ করা উচিত৷
মন্তব্য করুন