আসাদের আয়নাঘরে ১১০০ নম্বর বন্দিসহ কয়েকজনের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা
আমাকে আমার নাম ধরে ডাকা হতো না, স্রেফ নম্বর দিয়ে ডাকা হতো। তাই আমার নাম ছিল ১১০০, বললেন হালা নামক এক নারী। সিরিয়ার ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ সরকারের কারাগারগুলো থেকে মুক্তি পাওয়া হাজারও মানুষের মধ্যে একজন হালা। বিদ্রোহীদের তড়িৎগতির আক্রমণের মুখে দুই দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতন ঘটে। আসাদ সরকার পতনের পরপরই দেশটির বিভিন্ন কারাগার থেকে হাজারও মানুষকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
মুক্ত হয়ে অনেকে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের কাছে নিজেদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। মুক্তি পাওয়াদের একজন হলেন হালা নামক এক নারী। যিনি এখনো ভয়ে তার আসল নাম প্রকাশ করেননি।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরাকে হালা বলেন, ২০১৯ সালে তাকে হামার একটি চেকপয়েন্ট থেকে আটক করা হয়। তাকে ‘সন্ত্রাসবাদের’ অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। সে সময় হাজার হাজার সরকারবিরোধীদের ওপর এই অভিযোগ আরোপ করা হয়েছে। এরপর তাকে আলেপ্পোতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানেই তিনি বিভিন্ন কারাগারে বন্দি ছিলেন।
হালা তার কারাবন্দি জীবনের নির্মম স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমাকে আমার নাম ধরে ডাকা হতো না, স্রেফ নম্বর দিয়ে ডাকা হতো। আমার নাম ছিল ১১০০।
মুক্তিদাতাদের সম্পর্কে হালা বলেন, এই আনন্দ ছিল অপরিসীম; ইচ্ছা করছিল তাদের জড়িয়ে ধরে চুমু খাই। আমরা চিৎকার করে তাদের ধন্য বলছিলাম।
তিনি আরও বলেন, আমি যখন আমার পরিবারের কাছে পৌঁছাই, তখন আনন্দের মাত্রা আরও বেড়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, যেন আবার আমার জন্ম হয়েছে।
আলেপ্পোর যে কারাগার থেকে হালাকে মুক্তি দেয় এইচটিএস, সেটি বাশার আল আসাদের সরকারের পরিচালিত কয়েকটি কারাগারের একটি মাত্র। মানবাধিকার সংগঠন সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটসের তথ্য অনুযায়ী, হালাসহ আল আসাদের কারাগারে অন্তত ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬১৪ জন বন্দি ছিলেন।
বাশার আল আসাদের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া আরেক বন্দি ৪৯ বছর বয়সী সাফি আল-ইয়াসিন। তিনিও আলেপ্পোর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
সাফি বলেন, এটা যেন আমার জন্মদিনের মতো ছিল, যেন আমার জীবনের প্রথম দিন। তিনি আরও বলেন, এই আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
সাফি আল-ইয়াসিন বন্দি হওয়ার আগে উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার উপকূলীয় শহর বানিয়াসে নৌকা তৈরির কাজ করতেন।
তিনি বলেন, ২০১১ সালে সিরিয়ার বিপ্লবের সময়কার এক বিক্ষোভে অংশগ্রহণের অভিযোগে ৩১ বছর সাজা হয়েছিল তার। এরই মধ্যে তিনি সেই সাজার অর্ধেক পার করে ফেলেছেন। বিগত ১৪ বছর ধরে তিনি সিরিয়ার বিস্তৃত কারাগার নেটওয়ার্কের বিভিন্ন স্থানে ‘তীব্র শারীরিক নির্যাতন এবং বছরের পর বছর মানসিক যন্ত্রণার’ শিকার হয়েছেন।
কারাগার থেকে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত এই ব্যক্তি রক্তমাখা এক বয়স্ক বন্দির স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘আমি যে দৃশ্য দেখেছি, তা মৃত্যুর আগপর্যন্ত স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে পারব না।’ ওই ব্যক্তি পরে মারা যান।
সিরিয়ার আলেপ্পোর একটি কারাগার থেকে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত মেহের বলেন, অত্যাচারের তীব্রতা এবং নৃশংসতার কারণে প্রতি মিনিটে মনে হতো, মৃত্যু হাতছানি দিচ্ছে। একটি পশুর পক্ষেও এমন নির্যাতন সহ্য করা সম্ভব নয়।
সিরিয়ার কারাগারগুলো ছিল বাশার আল-আসাদের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার অন্যতম খুঁটি। ২০১৩ সালে সিরিয়ার বেশ কিছু ছবি প্রকাশ্যে আসে। ছবিগুলোর ব্যাখ্যা দিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলে, সিরিয়ার সরকারি কারাগারগুলোয় ব্যাপক নির্যাতন, অনাহার, মারধর এবং রোগাক্রান্ত হওয়ার অকাট্য প্রমাণ ছিল এসব ছবিতে। এসবই ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধ, বলেছে মানবাধিকার সংস্থাটি।
আরটিভি/একে/
মন্তব্য করুন