মরা বাড়িতে কান্না যাদের পেশা
গ্রামজুড়ে মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ায় প্রকাণ্ড অট্টালিকার উঠানে ঠাকুরের মৃতদেহ ঘিরে সবাই জড়ো হয়েছেন। ঐতিহ্য মেনে ঘরের ভেতরই বসে রয়েছেন বাড়ির নারীরা। উঠানে জড়ো হওয়া গ্রামের মানুষজন ঠাকুরের ভালো কাজের প্রশংসা করছেন আর এক পাশে কালো কাপড় পরিহিত একদল নারী কেঁদেই চলেছে।
তারা ফোঁপাচ্ছে, বুক এবং মাটি চাপরাচ্ছে। তাদের মোটামোটা চোখের পানিতে গালে দাগ পড়ে গেছে, কিন্তু সেটি মুছে ফেলা নিয়ে তারা মোটেও চিন্তিত না। সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে তাদের কান্নাকাটি দেখছে।
এমন নয় যে এবারই প্রথম তারা কোনও বাড়িতে কান্না করছে, আবার এটা শেষবারও নয়। ভারতের এই পেশাদার সম্প্রদায় যারা রুদালি নামে পরিচিত, অর্থের বিনিময়ে বিলাপ করে থাকে।
রুদালিরা কেবল মৃত্যুর দেবতা ইয়ামার পছন্দের রঙ কালো পোশাক পরে থাকে। তারা সমাজের নিচু বর্ণের লোক এবং তাদের বিয়ে করবারও অনুমতি নেই, কেননা যদি তারা পরিবারের মধ্যে সুখ খুঁজে পায় তাহলে শেষকৃত্যানুষ্ঠানে কে কাঁদবে?
আর সবার কাছে এটি অদ্ভুত একটি পেশা মনে হলেও রাজস্থানে বহু বছর ধরে ঐতিহ্য টিকে রয়েছে। আসলে অন্য সম্প্রদায়ের সামনে উঁচু বর্ণের নারীদের আবেগ প্রদর্শন করার অনুমতি নেই। তারা সাধারণ পর্দার মধ্যে অট্টালিকার ভেতরই থাকেন।
কলকাতার সাংবাদিক এবং লেখক নিধি দুগার কুন্দালিয়া তার ‘দ্য লস্ট জেনারেশন’ বইটিতে প্রায় বিলুপ্ত কিছু প্রথা বা পেশার কথা উল্লেখ করেছেন। সেখানে তিনি এই রুদালিদের কথাও বলেছেন। তিনি বলেন, আমাদের রাজপরিবারের কেউ মারা গেলে কাউকে না কাউকে কাঁদতে হবে, তাই না? নারীদের মস্তিষ্কে হারানো মানুষদের জন্য শোক করার বিষয় গাঁথা আছে। তাদের হৃদয় খুব দুর্বল। আমাদের পরিবারের নারীদের ঘরের বাইরে কোনও ধরনের অনুভূতি প্রকাশের অনুমতি নেই। উঁচু বর্ণের নারী সাধারণ মানুষজনের সামনে কান্নাকাটি করেন না। এমনকি যদি তাদের স্বামীও মারা যায়, তাহলেও নিজেদের আত্মমর্যাদা বজায় রাখতে হবে। এই নিচু বর্ণের রুদালিরা তাদের হয়ে কান্না করে। পুরো গ্রাম এই শূন্যতা বোধ করে...তারা শোকের প্রতিনিধিত্ব করে।
কিন্তু এমন না যে, রুদালিরা ইচ্ছাকৃতভাবে এ ধরনের পেশা বেছে নেয়। তাদের এমনটা করতে বাধ্য করা হয়। আর তাদের চোখের জলের বিনিময়ে ধনীরা পয়সা দেয়, আর শান্তির নিঃশ্বাস নেয়। আমরা কী তাদের দোষ দিতে পারি?
সমাজে এসব নারীদের নিচু অবস্থান দেয়া হয়, যার ফলে তারা প্রায়ই শোষণের শিকার হন। এসব নারীদের অনেকেই উঁচু বর্ণের ব্যক্তিদের অবৈধ সন্তানের জন্ম দেন। তবে যদি তারা মেয়ে সন্তানের জন্ম দেয়, তাহলে সে তাৎক্ষণিকভাবে কাঁদিয়েদের একজন হয়ে যায়। সমাজে তাদের এ ধরনের অবস্থান দিয়ে রুদালির মধ্যে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে। তা হচ্ছে- খালি পায়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতে বললেও কষ্ট পাব না কিন্তু একটি মেয়েসন্তানও যেন ঘরে না আসে। ছেলের জন্ম দিলেও সেই সন্তান কখনও বাবার নাম ব্যবহার করতে পারে না। কাজেই সমাজের কাছে তারা অচ্ছুত বলেই পরিচিতি লাভ করে।
তাই জোরপূর্বক প্রান্তিক করে রাখা এই সম্প্রদায় তাদের যাবতীয় ফরিয়াদ জানায় ‘ভেরুজি’ ভগবানের কাছে। অবশ্য কামপ্রবণ কুমার হয়ে অসংখ্য নারীর ক্ষতি করেছেন ভেরুজি, এই কাহিনী রাজস্থানের প্রায় সবার মুখে মুখেই প্রচলিত আছে। তার শিকারও ছিল সমাজের নিচু জাতের নারীরা। উঁচু জাতের প্রতিনিধিত্বকারী এই দেবতাকে তাই রুদালিরা নিজেদের ভাগ্য বলেই মেনে নিয়েছে।
এদিকে অপরিচিত এসব ব্যক্তির জন্য কান্না করে দিলেও খুব বেশি অর্থ পান না রুদালিরা। ফুঁপিয়ে কাঁদা ও মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া, হাউমাউ করে কাঁদা, বুক চাপরানো এবং মৃতদেহের সৎকার পর্যন্ত সঙ্গ দেয়ার জন্য ৫ থেকে ৬ রুপি পান। অনেক সময় তাদের ভাত এবং পুরনো কাপড়ও দেয়া হয়। তবে খাবারের মধ্যে কাঁচা পেঁয়াজ আর বাসী রুটিই বেশি দেয়া হতো তাদের।
রুদালিদের এই শোকের মাতম কমপক্ষে ১২ দিন পর্যন্ত চালিয়ে যেতে হয়। কেননা এই শোকের মাতম দীর্ঘায়িত হলে একটি পরিবারের আর্থিক অবস্থা কতটা ভালো সেটা ফুটিয়ে ওঠানো যায়।
পারফরম্যান্স ভালো করতে রুদালিরা নিজেদের জীবনের দুঃখ-কষ্টের কথা মনে করার চেষ্টা করে। তবে সবসময় কিন্তু চাইলেই চোখের পানি পড়ে না, তখন শুধু মুখের বিলাপই ভরসা। তবে যারা পুরোপুরি পেশাদার, তাদের নিজস্ব কিছু কৌশল আছে চোখে পানি আনার। কেউ কেউ থুতু লাগিয়ে মুখে পানির রেখা তৈরি করেন কেউবা এক ধরনের গাছের শেকড় ব্যবহার করেন যা অনেকটা গ্লিসারিনের মতো কাজ করে। কাজলের মতো এক ধরনের কালিও পাওয়া যায়, যা চোখে লাগানোর সাথে সাথে তীব্র জ্বলুনি শুরু হয় আর চোখের পানি পড়তে থাকে।
নিষ্পেষিত এই সম্প্রদায়ের জীবনের কঠিন সত্য অবলম্বনে ‘রুদালি’ নামে বলিউডে সিনেমাও নির্মিত হয়েছে। ১৯৯৩ সালে নির্মিত ওই ছবিটির পরিচালনা করেছেন-কল্পনা লাজমী। আর তাতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন ডিম্পল কাপাডিয়া।
‘রুদালি’ সিনেমায় ডিম্পল কাপাডিয়া
সেখানে ডিম্পল কাপাডিয়ার খুব বিখ্যাত একটি সংলাপ আছে- এই কান্নাই তোর জীবন… গম কেটে যেমন আবার নতুন করে জমি চাষ করতে হয়, তেমনি একবার চোখের পানি মুছে আবার নতুন কারও জন্য চোখের পানি ঝরাতে হয়।
কিন্তু সময় বদলাচ্ছে, মানুষজন এখন আর রুদালিদের চাইছে না। তাই শুধু কান্না ছাড়া আর কিছু না জানা এই সম্প্রদায়ের মানুষজন খুব একটা কাজ পাচ্ছে না। এখন কেবল সময়ই জানে, আর কতদিন তারা তাদের চোখের পানি বিক্রি করতে পারবে।
আরও পড়ুন :
এ/পি
মন্তব্য করুন