জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়: ইতিহাস ও বঞ্চনার এক মূর্ত সাক্ষী
একটি সাধারণ পাঠশালা থেকে দেশের প্রথমসারির বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠার এক নাটকীয় গল্পের সাক্ষী দেশের উচ্চশিক্ষার অন্যতম আদর্শ বিদ্যাপীঠ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি)। জবির এই গল্পটা আদতে সিনেমার গল্পের মতোই। গল্পের শুরুটা জগন্নাথ রায় চৌধুরী ১৮৫৮ সালে তৈরি করে গেলেও; গল্পটা আজও লিখে যাচ্ছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অগণিত শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। নানা প্রতিবন্ধকতার পরও বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য ও একাডেমিক শৃঙ্খলা এখন নতুন সৃষ্টি হওয়া যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য রোল মডেল।
ক্ষুদ্র পাঠশালা থেকে স্কুল, স্কুল থেকে কলেজ, কলেজ থেকে আবারও স্কুলে অবনমন, এরপর আবারও কলেজ এবং তা থেকে বিশেষ অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হওয়া ইতিহাস শুধু এদেশেই আছে তা নয় বরং পৃথিবীর জন্যেও এ এক বিরল ঘটনা। সময়ের বিবর্তনে মাত্র সাড়ে ৭ একরের ছোট্ট একটি ক্যাম্পাসে ২০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থীর স্বপ্নের ক্যাম্পাসে রূপ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।
সমসাময়িক অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই এত অল্প সময়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চ আসনে বসতে পারেনি। একঝাঁক তরুণ মেধাবী শিক্ষক ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সঞ্চিত গবেষণা ও অভিজ্ঞতার ঝুড়ি সমৃদ্ধ শতাধিক পিএইচডি ডিগ্রিধারী অধ্যাপকের পদভারে মুখরিত এই বিদ্যাপীঠ, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই উচ্চশিক্ষায় আগ্রহীদের পছন্দের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। তাই প্রতিবছরই বাড়ছে ভর্তি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা। প্রতিযোগিতার শতকরা হারে গত কয়েক বছর ধরে যা হার মানাচ্ছে দেশের অন্যসব নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কেও।
বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার সময়টা তেমন বড় না হলেও এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির বয়স দেড়শ বছরেরও অধিক। মানিকগঞ্জের বালিয়াটির জমিদার জগন্নাথ রায় চৌধুরী ১৮৫৮ সালে পুরান ঢাকায় কলেজিয়েট স্কুল ও পোগোজ স্কুলের পাশেই স্বল্প পরিসরে শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘জগন্নাথ পাঠশালা’, সেই থেকেই পথচলা শুরু।
তবে পাঠশালা থেকে দুই বছরের মাথায় ‘জগন্নাথ স্কুল’ শুরু হয়। মাঝে কিছুদিনের জন্য রাখা হয়েছিল ব্রাহ্ম স্কুল। পুনরায় ১৮৭৮ সালে জগন্নাথ স্কুল, ১৮৮৪ সালে জগন্নাথ কলেজ, ১৯২১ সালে জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ, ১৯৬৮ সালে সরকারি জগন্নাথ কলেজ, সর্বশেষ ২০০৫ সালে নতুন নাম হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
১৮৮৪ সালে কলেজ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পর ১৯১০ সালে ঢাকার কমিশনার স্যার রবার্ট নাথন কলেজটিকে নগদ ৮০ হাজার টাকা অর্থ সহায়তা দেন। আজকের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইকন খ্যাত মূল প্রশাসনিক ভবনটি ঐ টাকায়ই নির্মিত। ১৯৮৩ সালের মধ্যে মোট ১৫টি হল তৈরি করে মোটামুটি আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়। এসময় শুধু পূর্ববঙ্গ নয়, সমগ্র ভারতবর্ষে সবচেয়ে বড় আবাসিক সুবিধাসংবলিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল জগন্নাথ কলেজ।
দেশের অন্যতম শীর্ষে অবস্থান করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) প্রতিষ্ঠার পেছনেও ছিল জগন্নাথ কলেজের অগ্রণী ভূমিকা। ১৯২১ সালে ঢাবি প্রতিষ্ঠার পর জগন্নাথ কলেজের অধিকাংশ শিক্ষক চলে যান নবগঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। জগন্নাথ কলেজ গ্রন্থাগারের প্রায় ৫০ শতাংশ দুর্লভ ও মূল্যবান বই দিয়ে দেওয়া হয় ঢাবি গ্রন্থাগারে। সবচেয়ে মজার বিষয়, নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ছিল জগন্নাথ ও ঢাকা কলেজের। মূলত এ দুই কলেজের অনার্সের শিক্ষার্থীদের দিয়ে প্রাথমিক যাত্রা শুরু হয়েছিল বহুল প্রতীক্ষিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা যে যে বর্ষে পড়ত তারা একই বর্ষে ঢাবির শিক্ষার্থী হয়ে যায়।
জবিকে এখন অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের লজ্জা বহন করতে হয়। ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে কিছুদিন পর পর হলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের রাজপথে নামতে হয়। যে একমাত্র হলটি বর্তমানে তৈরি করা হচ্ছে, সেই শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল তৈরিতেও দফায় দফায় সময় পেছানো হয়েছে। যা আগামী ২০ অক্টোবর উদ্বোধন হওয়ার কথা।
শিক্ষার পাশাপাশি বাংলা ও বাঙালির প্রতিটি আন্দোলন এবং সংগ্রামের বিজয়ে শামিল হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। রয়েছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ’৬২-তে সামরিক সরকারের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, ’৬৬-এর ছয়দফা দাবি, ’৬৮-এর এগারো দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। মোটকথা নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যাচ্ছে জ্যামিতিক হারে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে একাট্টা হয়ে জগন্নাথের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বরাবরের মতোই ছিলো উল্লেখ করার মতো। মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় এই আন্দোলনে সর্বপ্রথম শহীদ হন জগন্নাথের ছাত্র রফিক উদ্দিন আহমদ। তখন তিনি হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন। ১৯৫২ সালে জগন্নাথ ছাত্র সংসদের (জকসু) তৎকালীন জিএস শফিউদ্দিন আহমদকে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার মূল্য হিসেবে কারাবরণ করতে হয়। ভাষাসৈনিক অজিত কুমার গুহ'কে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের একজন বলিষ্ঠ সংগঠক হওয়ায় গ্রেপ্তার করা হয়। জাতীয় অধ্যাপক ড. সালাহউদ্দীন আহমেদসহ অন্যান্য শিক্ষকরা এখান থেকেই ছাত্রদের ভাষা আন্দোলনে উৎসাহিত করতেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও ভাষা আন্দোলনে জগন্নাথের অবদানের প্রমাণ পাওয়ায় যায়।
বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষিত হলে তার সমর্থনে সফল হরতাল পালনে ভূমিকা পালন করে এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। ১৭ জানুয়ারি ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হলে জগন্নাথ ছাত্র সংসদের উদ্যোগেই প্রথম প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জগন্নাথ কলেজে পাকিস্তানি হানাদাররা হামলা চালায়। মুক্তিযুদ্ধে জগন্নাথের বহু ছাত্র ও শিক্ষক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে এই প্রতিষ্ঠানের অগণিত ছাত্র পাক হানাদারদের নৃশংসতায় শহীদ হন।
স্বাধীনতাকামী বাঙালির ওপর সংঘটিত অবর্ননীয় নির্যাতন এবং গণহত্যার চিত্র তুলে ধরে শহীদদের স্মরণে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ২০০৮ সালের ৩১ মার্চ নির্মাণ করা হয় ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ও একাত্তরের গণহত্যা ভাস্কর্য’। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত যা দেশের একমাত্র গুচ্ছ ভাস্কর্য।
ক্রীড়াক্ষেত্রেও একসময় খ্যাতি ছিলো এই বিদ্যাপীঠের। এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয়, আন্তঃকলেজে ধারাবাহিক চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন ছাড়াও শিক্ষার্থীরা জয় করেছিল রোনাল্ডসে শিল্ড, স্যার এএফ রহমান শিল্ড, ফিরোজ নূন কাপ প্রভৃতি। এই বিদ্যাপীঠেরই শিক্ষার্থী ব্রজেন দাস ৬ বার ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে গড়েছেন বিশ্ব রেকর্ড। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই জানে না ক্রীড়ায় তাদের এই গৌরবের কথা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়াজগৎ আজ অনেকটাই মলিন। ক্রীড়াচর্চার পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় বড় পর্যায়ে সাফল্য দেখাতে পারছেনা জবিয়ানরা। ২০১৯ এসএ গেমস এ বাংলাদেশের হয়ে প্রথম স্বর্ণপদক জয়ী মারজান আকতার প্রিয়া এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষার্থী।
আবাসন ও যানবাহন সমস্যায় জর্জরিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মনোবল, সাহস ও পরিশ্রমী মানসিকতা অবাক করে অন্যসব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের। ব্যয়বহুল ঢাকা শহরের মেস-বাসা-বাড়িতে কষ্টে দিন পার করা সত্ত্বেও তারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে সর্বদা মাতিয়ে রাখে।
শুধু আন্দোলন আর সংগ্রামেই থেমে নেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। নানা সংকটময় এই পথচলায় জবি দেখিয়ে যাচ্ছে তার সামর্থ্য। এছাড়া অন্যান্য প্রতিযোগিতামূলক ক্যারিয়ারেও ঈর্ষনীয় ফলাফল করছেন জবির শিক্ষার্থীরা। অনেক আগেই ইউজিসির প্রতিবেদনে এ-গ্রেড ভুক্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করেছে এই প্রতিষ্ঠানটি।
ভর্তি পরীক্ষায় গোপন বার-কোড পদ্ধতি চালু করার মাধ্যমে জালিয়াতি রোধে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও নতুন রাস্তা দেখিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বাংলাদেশের জন্ম ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই ইতিহাস কখনোই ভুলবে না লাল-সবুজের বাংলাদেশ। তবেই সার্থকতা লাভ করবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
পি
মন্তব্য করুন