ঢাকামঙ্গলবার, ২৭ মে ২০২৫, ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ঢাকা ওয়াসা পানির অপচয় রোধে সক্ষম, ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে প্রস্তুত

ফারুক আলম

বৃহস্পতিবার, ২৭ জানুয়ারি ২০২২ , ০৮:২৯ পিএম


loading/img
ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খান

প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। ঐতিহ্যবাহী নটর ডেম কলেজে পড়া শেষে ১৯৭৫ সালে রাশিয়া ছয় বছর মাস্টার্স করে ১৯৮১ সালে দেশে ফেরেন। ছাত্রজীবনে প্রতিটি পরীক্ষায় ‘স্টার মার্ক’ করেছেন। তিনি সরকারি চাকরি করবেন কখনো ভাবেননি। তাই তো শিক্ষাজীবন শেষে অধিকাংশ সময় আন্তর্জাতিক ও মাল্টিন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে যে কয়টি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি ছিল, এর মধ্যে হোলেন্ডের ফিলিপস একটি। প্রতিষ্ঠানটিতে ১৯৮১ সালে যোগদান করেন প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) যোগ দেন। সেখানে প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে ১১ বছর দায়িত্ব পালন করেন। আন্তর্জাতিক আরও বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে মাত্র ১২ বছরের মধ্যেই রাজধানীর একমাত্র বৃহত্তম সেবা প্রতিষ্ঠান ঢাকা ওয়াসা সফলতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসতে পেরেছেন বলে মনে করেন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খান।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের প্রাণকেন্দ্র ঢাকায় বছরে বছরে জনসংখ্যার ঘনত্ব বাড়ছে। বাড়ছে খাবার পানির চাহিদা। কোটি মানুষের এই চাহিদা মেটাতে যুগোপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। ফলে রাত জেগে হাড়িপাতিল, ড্রাম কিংবা বালতি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানির জন্য নগরবাসীকে আর অপেক্ষা করতে হয় না। পানির সংকট নিরসনে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। ঢাকায় পানি সংকট সমাধানে সুচিন্তিত মতামত জানিয়েছেন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। সাম্প্রতিক সময়ের ঢাকা ওয়াসার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন আরটিভি নিউজের সঙ্গে। পাঁচ পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক আলম

বিজ্ঞাপন

আরটিভি নিউজ : ঢাকা ওয়াসার পানি সিস্টেম লস বা অপচয় কমেছে না বেড়েছে?

প্রকৌশলী তাকসিম এ খান : কোনো গ্রাহক একটি সংস্থার সেবা নিয়ে টাকা বকেয়া রাখলে তা নোটিশ কিংবা জরিমানা করে উত্তোলন করা সম্ভব। কিন্তু যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের সিস্টেমেই গলদ থাকে তাহলে সেই লস বা অপচয় কোনোভাবেই মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তাই তো ঢাকা ওয়াসা পানির সিস্টেম লস বা অপচয় রোধের দিকে নজর দেয়। আর সিস্টেস লস দূর করতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়েছে। কারণ, আগে রাজধানীর বস্তি এলাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন অঞ্চলে ওয়াসার পাইপলাইন সহজেই লিকেজ হয়ে যেত। সেই লিকেজ পাইপলাইন দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানি অপচয় হয়েছে। এই সিস্টেম লস ঠেকাতে পানির বিতরণ কার্যক্রম বা নেটওয়ার্ক পরিবর্তন করা হয়। ফলে বর্তমানে পানির অপচয় রোধ করা সম্ভব হয়েছে, যা এশিয়ার অন্যান্য দেশে গড়ে ৪০ ভাগ পানি সিস্টেম লস হয়। এটা এখন ঢাকা ওয়াসায় মাত্র ৫ ভাগ পানি সিস্টেম লস হচ্ছে। এমন ব্যবস্থাপনা ইউরোপের দেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশে নেই।

আরটিভি নিউজ : ঢাকায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর দিনে দিনে নিচে নেমে যাচ্ছে। সেদিক থেকে ঢাকা ওয়াসা ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে?

বিজ্ঞাপন
Advertisement

প্রকৌশলী তাকসিম এ খান : জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বজুড়ে উষ্ণতা বাড়ছে। রাজধানীতে হু হু করে মানুষ বাড়ার কারণে পানির চাহিদাও বাড়ছে। ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরও তরতর করে কমে যাচ্ছে। ফলে পানির যে তীব্র সংকট হবে, যা অনেকটাই নিশ্চিত করে বলা যায়। ভূগর্ভস্থ পানির চাপ কমাতে ঢাকা ওয়াসা পরিবেশবান্ধব, টেকসই ও গণমুখী পানি ব্যবস্থাপনা তৈরিতে ২০১২ সালে একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করে। সেখানেই স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ওয়াসাকে যত দ্রুত সম্ভব সারফেস ওয়াটারে যেতে হবে। যদিও এই কাজটি বাস্তবায়ন কিছু চ্যালেঞ্জিং। কারণ, রাজধানীর চারপাশের নদীগুলো পানি দূষিত। আগে এসব নদী থেকে পানি নেওয়া হলেও এখন সম্ভব হচ্ছে না। পানি খাতে ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করে গবেষণা বাড়ানোর পাশাপাশি নদ-নদী ও লোনা পানিকে খাবার উপযোগী করতে হবে। এখন ঢাকা ওয়াসা পানি আনার জন্য চলে গেছে পদ্মা ও মেঘনা নদীতে। কাজেই ঢাকা ওয়াসা সারফেস ওয়াটারে যাচ্ছি। ঢাকা ওয়াসা যেসব ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট হাতে নিয়েছে, সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পারব। ইতোমধ্যে সায়েদাবাদ ওয়াটার প্ল্যান্টের তৃতীয় ভাগের কাজ শুরু হয়েছে। এটা শেষ হলেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব। তখন ঢাকায় ৭০ ভাগ সারফেস ওয়াটার ও ৩০ ভাগ ভূগর্ভস্থ পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে। তখনই পানি ব্যবস্থাপনা হবে পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই।

আরটিভি নিউজ : সরকারের বিভিন্ন সেবা সংস্থা পাহাড় সমান লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে নুয়ে পড়ে। ঢাকা ওয়াসা সেই লোকসানের দিক থেকে রেহাই পেয়েছে কিনা?

প্রকৌশলী তাকসিম এ খান : ঢাকা ওয়াসাতে ২০০৯ সালে পরিবর্তন আনার জন্য ‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা’ নামে কর্মসূচি হাতে নেয়। আর এই কর্মসূচির আওতায় মাস্টারপ্ল্যান করে। মাস্টারপ্ল্যানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল রাজধানীতে পানির সংকট নিরসন ও স্যুয়ারেজ লাইন উন্নয়ন করা। এছাড়াও মাস্টারপ্ল্যানের মধ্যে বহু মেগাপ্রজেক্ট নেওয়া আছে। ‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা’র কর্মসূচি নেওয়ার পর গত ১২ বছরে ঢাকা ওয়াসা ঘুরে দাঁড়িয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। রাজধানীবাসী ওয়াসার সুফল পাচ্ছেন। কাউকে এখন আর খাবার পানি সংকটে ভুগতে হয় না। এছাড়া চাহিদার চাইতে বেশি পানি সরবরাহ করার মত সক্ষমতা আল্লাহ আমাদের দিয়ে দিছেন। ঢাকায় প্রতিদিন পানির চাহিদা ২৪৫ কোটি লিটার। আমাদের উৎপাদন ২৬৫ থেকে ২৭৫ কোটি লিটার। যা চাহিদার চাইতে বেশি। আইন অনুযায়ী ৫ শতাংশ পানির বিল বকেয়া থাকতে পারে। কিন্তু ওয়াসার মাত্র দুই শতাংশ বকেয়া আছে ‘আমরা যখন যাত্রা শুধু করেছিলাম। তখন প্রতি একশো টাকায় ৬৪ টাকা আদায় ছিল। ৩৪ টাকা পানিতে যেত। এখন আদায় ৯৮ শতাংশ। আইনে আছে ৫ শতাংশ বকেয়া থাকতে পারবে। আমরা তো বকেয়াও আদায় করে ফেলছি। বকেয়া নিয়ে ঢাকা ওয়াসা এখন চিন্তিত না।

আরটিভি নিউজ : সংস্থার উন্নয়নে বিপুল পরিমাণ অর্থের জন্য বিদেশি সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। বিভিন্ন সংস্থা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে পারে না। ফলে পরবর্তীতে বিদেশি ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। সেখানে ঢাকা ওয়াসাকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলোর অবস্থা কী?

প্রকৌশলী তাকসিম এ খান : ঢাকা ওয়াসা ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমিয়ে সারফেস ওয়াসার সিস্টেমে যাবে। কারণ ভূ-গর্ভস্থ’ থেকে পানি উত্তোলনের সিস্টেমটি পরিবেশবান্ধব নয়। কিন্তু সারফেস ওয়াটার সিস্টেম করতে গেলে সারফেস ওয়াটার ট্রিটম্যানপ্ল্যান তৈরি করতে বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থের প্রয়োজন; যা ঢাকা ওয়াসা চিন্তা করা কঠিন ছিল। বিপুল পরিমাণ অর্থের জন্য বিদেশি সহযোগিতার প্রয়োজন। কিন্তু বিদেশি সহযোগিতা চাইলেই দেবে না। কারণ, বিদেশ থেকে ঋণ নিতে হলে তারা আগে সংস্থার সক্ষমতার দিকে নজর রাখে। লাভজন প্রতিষ্ঠান না হলে সহজে বিদেশি সংস্থা ঋণ দিতে চায় না। সেখানে ২০২০ সালে এসে ঢাকা ওয়াসার অর্জন ব্যাপক। ঢাকা ওয়াসা আজকে অর্থ দেওয়ার জন্য ব্যাংকগুলো নিজেরাই এগিয়ে আসতে চায়। ব্যাংক সব সময় টাকা দেওয়ার জন্য ঢাকা ওয়াসায় আসবে। কিন্তু অলাভজন প্রতিষ্ঠান কিংবা অব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান হলে কোনো ব্যাংক ঋণ দিতে চাইতো না। শুধু দেশি ব্যাংক নয়, ওয়াসাকে ঋণ দেওয়ার জন্য এখন আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো এগিয়ে আসতে চায়।

উন্নয়ন সহযোগী বিশ্ব ব্যাংক এবং এশিয়া ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হলে তাদের শতশত শর্ত পুরন করতে হয়। এসব ব্যাংকগুলোর শর্ত পুরন করা খুব কঠিন কাজ। বিশ্ব ব্যাংক ও এশিয়া ডেভেলপমেন্ট থেকে ঋণ নিতে গেলে তারা সবচেয়ে তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্বপূর্ণ দেয়। যে প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেবে সেই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজমেন্টের সক্ষমতা, আর্থিক সক্ষমতা ও টেকনিক্যাল সক্ষমতা রয়েছে কিনা। ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার দায়িত্ব পাওয়ার পর ২ বছর প্রথমে প্রতিষ্ঠানটির সেই সক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করেছি। শত প্রচেষ্টার মাঝে টার্গেট অনুযায়ী ২০১১ সালের মধ্যেই ঢাকা ওয়াসার ম্যানেজমেন্ট, আর্থিক ও টেকনিক্যাল সক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছি। এছাড়া বিশ্বের নামকরা প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে ঢাকা ওয়াসা অডিট করেছে। সেই অডিট রিপোর্টের ওপর আর চ্যালেঞ্জ করেনি বিশ্ব ব্যাংক ও এশিয়া ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। এতেই বোঝা যায়, ঢাকা ওয়াসার অডিট ঠিক রয়েছে।

বিশ্বের অন্যতম জনবহুল শহর ঢাকা। এই শহরের বাসিন্দারা ২০০৯ সালের আগমুহূর্তে খাবার পানির জন্য হাহাকার করেছিলেন। কলসি মিছিল বা বালতি মিছিল ছিল নৈমিত্তিক ঘটনা। কিন্তু বর্তমান ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পানির চাহিদা পূরণে শতভাগ সফল বলে দাবি করছে সংস্থাটি।

এফএ/টিআই

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন
Advertisement
Advertisement


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |