আন্দোলন আর বিভীষিকার মাঝেও কিছু দৃষ্টান্ত
আন্দোলনকারী ছাত্রদের সঙ্গে প্রতিহিংসা মুক্ত সম্পর্ক বজায় রাখার কারণেই ডিএমপির দক্ষিণখান থানায় একটা ঢিলও পড়েনি। কোনো পুলিশ সদস্য সেখানে আক্রমণের শিকারও হননি। এখন পর্যন্ত সেখানে সাভাবিক কার্যক্রম চলমান রয়েছে, ছাত্র-জনতাসহ সকল শ্রেণির বাসিন্দাদের সঙ্গে বিদ্যমান আছে চমৎকার সম্পর্ক।
ব্যতিক্রম এ দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়েছে দক্ষিণখান থানার সদ্য বিদায়ী ওসি শেখ আমিনুল বাসারের কারণে। সেখানে ১ আগস্ট থেকে যোগদানকারী ওসি আশিকুর রহমানসহ থানার পুলিশ সদস্যরা সবাই সে সুবিধা ভোগ করতে পেরে বেজায় খুশি।
অথচ আন্দোলনকারীদের ওপর দমনপীড়ন না চালানোর অভিযোগ তুলেই দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী ওসি শেখ বাশারকে প্রত্যাহার করার ঘটনা ঘটে। ডিএমপি কমিশনার গত ৩১ আগস্ট এক নির্দেশে শেখ বাশারকে প্রত্যাহার করে তার স্থলে মো. আশিকুর রহমানকে ওসি হিসেবে দায়িত্ব দেন।
থানায় কর্মরত পুলিশ সদস্যরা জানান, জুলাই মাস জুড়ে চলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে কোনো রকম হিংসাত্মক আচরণের পরিবর্তে সমঝোতার সম্পর্ক বজায় রাখেন ওসি শেখ বাশার। তিনি আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের হামলা, ভাঙচুর, বিশৃংখলা থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হন। একইসঙ্গে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের আক্রমণাত্মক ভূমিকা গ্রহণের ব্যাপারে কৌশলে বিরত রাখেন। সেখানে অযথা ধর পাকড়, হয়রানিও চালানোর নজির নেই।
আন্দোলনকারীদের ওপর কঠোর না হওয়ার কারণেই ওসি শেখ বাশারকে ৩১ জুলাই প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু পরবর্তী চারদিনের আন্দোলনেও দক্ষিণখান থানার পুলিশ সদস্যরা একই ভূমিকা অব্যাহত রাখায় সেখানে কোনো ধরনের প্রতিহিংসার ছোঁয়া পড়েনি। ৫ আগস্ট ডিএমপির সকল থানা, ফাঁড়িসহ পুলিশের সকল স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটলেও একটা ঢিল পড়েনি দক্ষিণখান থানায়।
সিলেটের পাবক পাল শান্ত নামে একজন কনস্টেবল গুলিতে রক্তাক্ত এক ছাত্রকে যেভাবে বুকে জড়িয়ে হাসপাতালে নিয়ে যান সে দৃশ্য সবার চোখ ভিজিয়েছে। ভালোবাসার সে এক অনন্য নজির।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চূড়ান্ত দিন ৫ আগস্ট এবং পরদিন ৬ আগস্ট পর্যন্ত সময়টা ডিএমপি পুলিশের জন্য ছিল সবচেয়ে ভয়ংকর। এ সময়টুকুতে কয়েক’শ পুলিশ সদস্যের নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে বলে দাবি করা হয়। যখন সবাই ছিল আক্রোশের মুখে পলায়নপর অবস্থায় তখনও একজন সিআইডি কর্মকর্তা তার টিম সদস্যদের নিয়ে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছেন।
তার নিজের বক্তব্যেই জেনে নেওয়া যাক দুঃসাহসিক দুটি ঘটনা। আসসালামু আলাইকুম, আমি পুলিশ পরিদর্শক মো. জাহিদুল ইসলাম গত ৬ আগস্ট রাত সাড়ে ১২টায় আমার পরিচিত একজন সাব ইন্সপেক্টর ফোন করে জানান, মোহাম্মদপুর থানার ছাদে বেশ কিছু পুলিশ আটকা পড়ে আর্তচিৎকার করছে। থানার নিচে দুষ্কৃতকারীরা আগুন দিয়েছে। সংবাদ পেয়ে মোহাম্মদপুর পৌঁছে স্থানীয় লোকদের সহযোগিতা নিয়ে দুষ্কৃতকারীদের হটিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করি। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আসবাবগুলো চরম ঝুঁকি নিয়ে ছুড়ে ফেলি বাইরে। এরপর আটকে থাকা বিপদগ্রস্ত পুলিশ সদস্যদের নামিয়ে আনি ছাদ থেকে। এরপর তাদের নিরাপদে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করি। যার কারণে অন্য থানার মতো লাশের স্তূপ হয়নি মোহাম্মদপুরে।
এসব কাজ সম্পন্ন করে রাত চারটা বেজে যায়, এরপর এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে ঘুমাই। ৭ জুলাই সকালে উঠেই জানতে পারি, যাত্রাবাড়ী থানার সামনে ১২-১৩ জন পুলিশের লাশ পড়ে আছে, দুই দিনেও লাশগুলো কেউ সরিয়ে নিচ্ছে না। তখন আমি প্রথমে সিআইডি অফিসে যাই, কাউকে না পেয়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের গেটে যাই। সেখানে অনেক অনুনয় বিনয়ের পরে অনুমতি মিলে যে, আমি লাশগুলো আনতে পারলে তারা গ্রহণ করবে। কিন্তু লাশ আনার জন্য কেউ আমার সঙ্গে যেতে পারবে না। তখন দোয়া-কালাম যা জানতাম তা পড়তে পড়তে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে গেলাম। গিয়ে দেখি ৩০ থেকে ৪০ হাজার মানুষের অবস্থান সেখানে। সেখানে পড়ে থাকা লাশের পাশে গিয়ে সাধারণ দর্শক হিসেবে লোকজনের সঙ্গে কথা বললাম। তখন পর্যন্ত মানুষের ক্ষোভের চরম বহিঃপ্রকাশ দেখলাম। তখন বুঝলাম, যদি তারা জানতে পারে আমি পুলিশ, তাহলে আমিও মুহূর্তেই মারা পড়বো, এই লাশগুলোর পাশে আরেকটা লাশে পরিণত হব। প্রতিটা মুহূর্ত ছিল আমার জন্য জীবনের শেষ মুহূর্ত, যেটা বলে বোঝানো যাবে না।
সাধারণ মানুষ হিসেবেই প্রথমে কয়েকজনের মাঝে কৌশলে জনমত সৃষ্টি করি এবং দুই ঘণ্টারও বেশি সময় অপেক্ষার পর ৮ জন পুলিশ সদস্যের লাশ সারিবদ্ধ করে রাখার সুযোগ পাই। প্রতিটি লাশ ছিল নির্মমভাবে থেতলে ফেলা, রক্তাক্ত এবং ফুলেফেঁপে বিভৎস আকার ধারণ করা। একপর্যায়ে ট্রাক ভাড়া করে তড়িৎ গতিতে সহকর্মী ভাইদের লাশগুলো ট্রাকে তুলে রাজারবাগ গেটের দিকে রওনা হই।
ট্রাক স্টার্ট দিয়ে রওনা হওয়া পর্যন্ত আমি কে, লাশ কোথায় নেবো, কিংবা লাশের গাড়িতে কে যাবে, কেন যাবে, এসবের কোনো কিছু কাউকে বুঝে ওঠার সুযোগ পর্যন্ত দেইনি। অথচ সেখানে উপস্থিত মানুষজনকে সঙ্গে নিয়েই লাশগুলো একত্রিত করেছি, গাড়িতে উঠিয়েছি। শুধু লাশবাহী ট্রাকটি ছুটতে শুরু করতেই আমি চোখের পলকে ট্রাকের বাম পাশের সিটে উঠে দরজাটা লাগিয়েছি, মুখে চালককে বলেছি ফুল স্পিডে চালাও গাড়ি। তখন খেয়াল করি যে, আমার পুরো দেহটা কাপছে।
আমি যখন লাশগুলো নিয়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইন গেটে আসি, তখন দেখতে পাই আরেক আতঙ্কের ঘটনা। দেখতে পাই পুলিশের বেশ কিছু সদস্য সশস্ত্র প্রস্তুতি নিয়ে ক্ষুব্ধ অবস্থায় যাত্রাবাড়ী যাওয়ার জন্য রাজারবাগ এক নম্বর গেটে অবস্থান করছে। আমি যদি যথা সময়ে লাশ নিয়ে না আসতে পারতাম, তাহলে এরা গুলি করতে করতে যাত্রাবাড়ী যেত। ফলে আবার রক্তক্ষয়ী সংঘাত বাধতো, আবার বহু লোকের প্রাণহানি ঘটতে পারতো। এক সময় গুলি শেষ হয়ে গেলে ওই পুলিশ সদস্যরাও হয়তো কেউ আর প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পারতো না। আল্লাহ আমাকে উছিলা করে হয়তো আমাদের সব ভাইকে রক্ষা করেছেন।
আমি জীবনে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেছি, তবে আজকের ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে আগের কোনো ঝুঁকির তুলনা করতে পারছি না।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক
মন্তব্য করুন