শৈল্পিক হুমায়ুনের গল্প ‘বিষ গোলাপ’
একটি মেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটি রজনীগন্ধা, তার সাথে টেপ দিয়ে প্যাঁচানো একটি লাল গোলাপ। মেয়েটির পেছন থেকে একটি ছেলে এসে ফুলের তোড়াটি নিয়ে দৌড় দেয়। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটিও ছেলেটির পেছনে দেয় দৌড়। এই দৃশ্যটি দূরে দাঁড়িয়ে থাকা টং দোকানের পাশে বাইক দাঁড় করিয়ে চা হাতে একটি ছেলে দেখছিল। সেও বাইক নিয়ে তাদের ফলো করল।
মেয়েটির নাম তাজনিয়া। ‘ও লেভেল’-এ পড়ে। ধনী লোকের মেয়ে। বাবা-মা’র গাইডলাইনস নেই। ফুল কেড়ে নেওয়া ছেলেটির নাম মতি। শীর্ণদেহী, দেখতে কালো।
আর বাইকওয়ালা ছেলেটি একজন পুলিশ। ইন্সপেক্টর সোহেল।
মতি ফুলটি ছিনিয়ে নিয়ে দৌড় দেয়। তাজনিয়া ফুলটি ফিরে পাওয়ার জন্য মতির পিছু নেয়। এদিকে ইন্সপেক্টর সোহেল কৌতূহলী হয়ে তাদের নীরবে অনুসরণ করে। তার মনে প্রশ্ন, কেন একটা সামান্য ফুলেন জন্য ছেলেটি মেয়েটির ফুল নিয়ে দৌড় দিলো? আবার মেয়েটিই বা কেন ওই ফুলের জন্য ছলেটির পিছু নেবে? এটিই জানার জন্য তাদের অনুসরণ করছে।
তাজনিয়া মতিকে দৌড়ে ধরার চেষ্টা করছে। মতিও প্রাণপণ দৌড়াচ্ছে। মতি এলিফ্যান্ট রোডের দিকে দৌড়াচ্ছে। তাজনিয়াও নাছড়বান্দা, সেও মতির পিছু ছাড়ছে না। মতি দৌড়াতে দৌড়াতে কাটাবনের রাস্তায় ঢুকে পড়ে। ব্যস্ত একটি রাস্তা। তাজনিয়া দৌড়াচ্ছে। রাস্তার সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। একটি মেয়ে হয়ে সে একটি ছেলের পিছু এইভাবে দৌড়াচ্ছে! আমাদের সমাজে এটা যায় না। সুন্দরী একটি মেয়ে এভাবে রাস্তায় দৌড়াবে! কেউ কল্পনাই করতে পারছে না। রাস্তায় রিকশার জ্যাম। মানুষজনের ভিড়। প্রচুর শব্দ। তাজনিয়া মতিকে হারিয়ে ফেলেছে। তাজনিয়া দু-এক জনকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কাউকে এদিকে দৌড়ে আসতে দেখেছেন?’ কিন্তু কেউ বলতে পারল না। তাজনিয়া আর মতিকে খুঁজে পায় না। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করার পর হতাশ হয়ে সে একটা রিকশা নিয়ে চলে যায়।
৫-১০ মিনিট পর মতি বের হয়ে আসে। তাকে খুশি খুশি লাগছে। আজ দিনটা খুব ভালোই কাটবে। মতি রাস্তা পার হয়ে আসে। সামনের দিকে হাটতে থাকে। পিছন থেকে কে যেন তার কোমরের প্যান্ট শক্ত করে ধরে।
মতি: ‘কে রে?’ বলেই পেছনে ঘুরে দেখে পুলিশ। ইন্সপেক্টর সোহেল।
মতিকে থানায় নিয়ে আসে। জিজ্ঞাসাবাদ করে।
ইন্সপেক্টর: তোর নাম কী?
মতি: স্যার, মতি।
ইন্সপেক্টর: মতি হিরোইনচি। তা তুই মেয়েটার ফুল নিয়ে দৌড় দিলি ক্যান?
মতি: স্যার, এমনি।
ইন্সপেক্টর: যদি মাইর খেতে না চাস তাহলে সত্যি করে বল? তুই মেয়েটাকে চিনিস?
মতি: না, স্যার। চিনি না।
ইন্সপেক্টর: চিনিস না তাহলে ফুল নিয়ে দৌড় দিলি ক্যান?
মতি চুপ করে আছে। কোনো কথা বলছে না। ইন্সপেক্টর সজোরে একটি চড় দিয়ে জিগ্যেস করছে, কী কথা বলছিস না ক্যান?
মতি: স্যার মেয়েটি প্রায় এখানে ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। একদিন ঠিক করলাম ওর ফুল নিয়ে পালিয়ে যাব। কিন্তু মেয়েটি যে আমার পিছু দৌড় দেবে, তা আমি ভাবতেই পারিনি। স্যার কী যে ভয় পাইছিলাম! যদি ধরা পড়তাম তাহলে কী একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যাইত। একটা মেয়ের সাথে দৌড়ে পারলাম না? তাছাড়া ধরা পড়লে একটা মেয়ের হাতে মাইর খাইতাম আর পাবলিক তো আছেই। একটা মেয়ের হাতে মাইর খাওয়ার চেয়ে বড় লজ্জা এ পৃথিবীতে আর কী আছে! তার চেয়ে পুলিশের হাতে ধরা খাইলে এত লজ্জা নেই।
ইন্সপেক্টর: কী বললি তুই? (বেধম মাইর) সত্যি করে বল?
ইন্সপেক্টর সোহেল ফুলটা হাতে নিয়ে গন্ধ শোকে। গোলাপ ফুলটায় সে একটা অসঙ্গতি খেয়াল করে। গোলাপের পাপড়িগুলো এলোমেলোভাবে আছে। মনে হচ্ছে কেউ হাত দিয়ে পাপড়ি গুলো সাজিয়েছে বা জোড়া লাগিয়েছে। জোড়া লাগিয়ে কলির মতো করে বানিয়েছে। এটা কোনোমতেই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি হতে পারে না। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিতে কোনো ভুল থাকে না। মানুষের ভুল থাকে।
ইন্সপেক্টর সোহেল ফুলটার কয়েকটা পাপড়ি খুলে। আর লক্ষ্য করে পাপড়িগুলো আলগা। সামান্য আঁঠা দিয়ে পাপড়িগুলো লাগানো হয়েছে। এক এক করে সব গুলো পাপড়ি খুলে ফেলে সোহেল। শেষে ফুলের ভেতর থেকে ছোট্ট একটি প্যাকেট বের হয়ে আসে। প্যাকেটে সাদা পাউডার। প্যাকেটি খুলে ইন্সপেক্টর সোহেল সামান্য একটু পাউডার মুখে দিতেই সে বুঝে যায় এটা হেরোইনের পেকেট। এখানে ১৫ থেকে ২০ গ্রামের মতো হেরোইন রয়েছে। এবার ইন্সপেক্টর সোহেল মতির দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়। আবার চড়-থাপ্পর দেয়।
ইনিস্পেক্টর: এটা কী? বল এটা কী?
মতি প্যাকেট দেখে অবাক হয়, বুঝতে পারে এটা হেরোইন। কান্না গলায় উত্তর দেয়।
মতি: স্যার, আমি জানি না। সত্যি বলছি, স্যার।
ইন্সপেক্টর মতিকে মারতে থাকে। বল? একজন হেরোইনচিই জানে আর একজন হেরোইনখোরের খবর। বুঝছি এত অল্প মাইরে তুই বলবি না। সেন্ট্রি আঙুল কাটার যন্ত্রটা নিয়ে আসো তো?
মতি এবার ভীষণ ভয় পেয়ে যাবে এবং সব স্বীকার করবে।
মতি: বলছি স্যার, বলছি। স্যার মেয়েটি প্রায় দিনই ফুল হাতে কোথা থেকে যেন আসে। আর রিকশা নিয়ে চলে যায়। একদিন আমি তাকে প্রথম থেকে ফলো করলাম। দেখলাম সে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পেছন থেকে ৮০০ টাকা দিয়ে দুইটা ফুল কিনল। কিন্তু দুইটা ফুলের দাম কখনই ৮০০ টাকা হতে পারে না। তাই আমি প্ল্যান করলাম একদিন ওই ফুলটা নিয়ে পালিয়ে যাব এবং দেখব এর ভিতরে কী আছে।
ইন্সপেক্টর: তুই নিশ্চিত ছিলি এর ভেতরে হেরোইন আছে। তাই না? মতি চুপ করে থাকে।
ইন্সপেক্টর: মেয়েটা কোথায় থাকে, তুই জানিস?
মতি হঠাৎ পুলিশের পা জড়িয়ে ধরে বলে, স্যার আমারে ছাইড়া দ্যান?
ইন্সপেক্টর : না তোকে ছেড়ে দেওয়া যাবে না, তোর চিকিৎসা দরকার। কিছুদিন জেলহাজতে থাক। সেটাই হবে তোর জন্য রিহ্যাব।
মন্তব্য করুন