সুবিধাবঞ্চিতদের ন্যায়বিচার পেতে লিগ্যাল এইডকে সাজাতে হবে
বাংলাদেশে আইনগত সহায়তা প্রদান সেবার (Legal Aid Services) গুরুত্ব ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ, এটি দরিদ্র ও অসহায় মানুষের জন্য ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করে। তবে এ খাতে অনেক চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান, যা সংস্কারের মাধ্যমে উন্নত করা সম্ভব।
প্রথমেই দরকার কাঠামোগত সংস্কার
জেলা লিগ্যাল এইড অফিসকে একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। প্রত্যেক উপজেলায় একটি করে ‘উপজেলা লিগ্যাল এইড অফিস’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার হিসেবে যুগ্ম জেলা জজ পর্যায়ের বিচারকদের এবং উপজেলা লিগ্যাল এইড অফিসার হিসেবে সহকারী জজ বা সিনিয়র জজ পর্যায়ের বিচারকদের পদায়ন করলে গতি ফিরবে।
পৃথক ভবন নির্মাণ ও আবাসন এর ব্যবস্থা
জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে লিগ্যাল এইড অফিসের জন্য পৃথক ভবন নির্মাণ করতে হবে। প্রত্যেক লিগ্যাল এইড অফিস ভবনে একটি করে মেডিয়েশন সেন্টার থাকবে। একটি করে ব্রেস্ট-ফিডিং কর্নারও নির্মাণ করতে হবে। সাথে সাথে লিগ্যাল এইড অফিসারের জন্য সরকারি আবাসনের ব্যবস্থা করা দরকার।
লিগ্যাল এইড অফিসারগণের জন্য পরিবহন সুবিধা
আপোষ-নিষ্পত্তির জন্য সরেজমিনে নালিশী জমি পরিদর্শন এবং লিগ্যাল এইড সংক্রান্ত প্রচারণা, উঠান বৈঠক, গণশুনানি, স্টেকহোল্ডার ও ইউনিয়ন কমিটির সাথে মতবিনিময় সভা, সেমিনার আয়োজনসহ বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য লিগ্যাল এইড অফিসারদের প্রায়ই দুর্গম এলাকায় যেতে হয়। কিন্তু সদিচ্ছা বা প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও গাড়ি না থাকায় লিগ্যাল এইড অফিসারগণ বিচারপ্রার্থী জনগণের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না। প্রান্তিক পর্যায়ে দুস্থ ও বিচারপ্রার্থী জনগণের কাছে পৌঁছাতে এবং লিগ্যাল এইড কার্যক্রমের কার্যকারিতা ও গতি নিশ্চিত করতে লিগ্যাল এইড অফিসারের জন্য একটি উপযুক্ত গাড়ি অত্যন্ত জরুরি।
লিগ্যাল এইড অফিসে বাধ্যতামূলকভাবে মেডিয়েশনের চেষ্টা
বিদ্যমান আইনে বিবাদী পক্ষ জবাব দাখিলের পর মেডিয়েশন এর চেষ্টা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু, লিগ্যাল অফিসে মেডিয়েশনের জন্য পাঠানো বাধ্যতামূলক না। বিদ্যমান ব্যবস্থায় দেওয়ানী আদালতে মেডিয়েশন হওয়ার হার খুবই কম। এমতাবস্থায়, নির্দিষ্ট মূল্যমান পর্যন্ত সিভিল মোকদ্দমা, ওয়ারিশান সম্পত্তি সংশ্লিষ্ট মোকদ্দমা ও পারিবারিক মোকদ্দমা দায়ের হওয়ার সাথে সাথে লিগ্যাল এইড অফিসে মেডিয়েশন (পোস্ট কেস) এর জন্য প্রেরণ করার বিধান করা। লিগ্যাল এইড অফিসার একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মীমাংসা করতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট আদালতে তা ফেরত আসবে।
ফৌজদারি বিরোধ আপসে নিষ্পত্তি
ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪৫ ধারা মোতাবেক কিছু কিছু অপরাধ আদালতের অনুমতি ব্যতিরেকে এবং কিছু কিছু অপরাধ আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে আপোষ যোগ্য। তবে ফৌজদারি আদালত কর্তৃক আপোষের চেষ্টা করার আইনি বিধান নেই। ফৌজদারি বিরোধ আপোষে নিষ্পত্তির জন্য লিগ্যাল এইড অফিসে প্রেরণ করারও আইনগত সুযোগ নেই। আপোষযোগ্য অপরাধ সংক্রান্ত মামলা আপোষের জন্য লিগ্যাল এইড অফিসে প্রেরণের বিধান রাখা দরকার।
ডিক্রির মর্যাদা
লিগ্যাল এইড অফিসার এর মধ্যস্থতায় সম্পাদিত ‘কম্প্রোমাইজ ডিড’ প্রযোজ্য ক্ষেত্রে দেওয়ানী আদালতের বা পারিবারিক আদালতের ডিক্রীর মর্যাদা দিতে হবে। লিগ্যাল এইড অফিসার কর্তৃক ইস্যুকৃত ‘সমন বা নোটিশ’ দেওয়ানী আদালতের ‘সমন’ হিসেবে গণ্য করতে হবে।
ক্ষতিপূরণের চুক্তি
লিগ্যাল এইড অফিসার কর্তৃক ফৌজদারি বা দেওয়ানী বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের চুক্তি করার আইনগত স্বীকৃত হতে হবে।
লিগ্যাল এইড অফিসের অবকাঠামোগত উন্নয়ন
অফিসে প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, কম্পিউটার, ইন্টারনেট সংযোগ, ও সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবস্থা করা দরকার। অফিসে নারী ও শিশুদের জন্য পৃথক বসার স্থান নিশ্চিত করা। হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের জন্য অ্যাক্সেসিবিলিটি সুবিধা প্রদান করা।
লিগ্যাল এইড অফিসার ও কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি
লিগ্যাল এইড অফিসারগণ ও কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। লিগ্যাল এইড এর প্যানেলভুক্ত আইনজীবীদের জন্যও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
এডিআর (মেডিয়েশন) বিষয়ে বিদেশে উচ্চতর প্রশিক্ষণ
বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সবচেয়ে উত্তম ও কার্যকর উপায় হলো মেডিয়েশন, যেখানে নিরপেক্ষ তৃতীয় পক্ষের সহায়তায় পক্ষগুলো সমঝোতার ভিত্তিতে দ্রুত ও সস্তায় সমাধান পায়। এটি সম্পর্ক বজায় রাখতেও সহায়ক। এই বিষয়ে লিগ্যাল এইড অফিসারগণের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য বিদেশে উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
লিগ্যাল এইড সেবার আধুনিকায়ন
আইনগত সহায়তা প্রাপ্তির জন্য অনলাইন আবেদন এবং প্রক্রিয়াকরণের যে ব্যবস্থা বিদ্যমান আছে তা আরও কার্যকর ও সহজতর করতে হবে। লিগ্যাল এইড অফিসের সহায়তা নিয়ে দায়েরকৃত মামলার আপডেট নিয়মিতভাবে বিচারপ্রার্থীদের সরবরাহ করতে হবে। লিগ্যাল এইড সেবায় তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে দূরবর্তী এলাকায় সেবা পৌঁছে দেওয়া দরকার।
মামলা পরিচালনার ফি যৌক্তিক হারে পুনঃ নির্ধারণ
নির্দিষ্ট আয়-সীমার বা শ্রেণির ব্যক্তির মামলা দায়ের ও পরিচালনার জন্য লিগ্যাল এইড অফিস হতে আইনজীবী নিয়োগ করা হয়। কিন্তু, মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন কার্যক্রমের জন্য আইনজীবীদের যে পরিমাণ ফি দেয়া হয় তা অত্যন্ত অপ্রতুল। ফলে অনেক যোগ্য ও দক্ষ আইনজীবী লিগ্যাল এইড কার্যক্রমে আগ্রহী হন না। আবার অনেক অসাধু আইনজীবী দুঃস্থ ও অসহায় বিচারপ্রার্থীর নিকট থেকেও অর্থ আদায় করে নেয়। তাই যোগ্য ও দক্ষ আইনজীবীদের লিগ্যাল এইড কার্যক্রমে আগ্রহী করে তুলতে এবং বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি বন্ধের জন্য মামলা পরিচালনার ফি যৌক্তিক হারে পুনঃ নির্ধারণ করা আবশ্যক।
অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা
Online Dispute Resolution (সংক্ষেপে ODR) হলো প্রযুক্তি ও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে পক্ষগুলোকে শারীরিকভাবে উপস্থিত না হয়েই তাদের বিবাদ সমাধানের সুযোগ প্রদান করা হয়। এটি বিকল্প বিবাদ নিষ্পত্তি (ADR)-এর একটি সম্প্রসারিত রূপ, যা ভিডিও কনফারেন্সিং, সুরক্ষিত যোগাযোগ এবং ডিজিটাল ডকুমেন্ট বিনিময়ের মতো সরঞ্জাম ব্যবহার করে করা হয়।
অনলাইন বিবাদ নিষ্পত্তি (ODR) দ্রুত, খরচ-সাশ্রয়ী এবং সহজলভ্য একটি প্রক্রিয়া যা পক্ষগুলোর জন্য নিরাপদ ও কার্যকর সমাধান নিশ্চিত করে। অনলাইন বিবাদ নিষ্পত্তি (ODR) ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, চীন, ভারত, সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশে চালু অত্যন্ত কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে চালু হয়েছে। তাই এই ব্যবস্থা বাংলাদেশে প্রবর্তন করা হলে লিগ্যাল এইড অফিসারগণ অনলাইনে প্ল্যাটফর্মে বাণিজ্যিক, পারিবারিক ও ছোট দেওয়ানী বিরোধ সহজেই নিষ্পত্তি করতে পারবেন।
জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার কর্তৃক আরবিট্রেশন
আরবিট্রেশন অ্যাক্ট, ২০০১ অনুযায়ী, আরবিট্রেশন হলো এক প্রকার বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (ADR)। এ প্রক্রিয়ায় উভয় পক্ষ একটি নিরপেক্ষ তৃতীয় পক্ষের (আরবিট্রেটর) সিদ্ধান্ত মেনে চলতে সম্মত হয়। একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসেবে লিগ্যাল এইড অফিসার সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য হতে পারে। তাই লিগ্যাল এইড অফিসারকে যাতে আরবিট্রেটর হিসেবে নিয়োগ করা হয় এই বিষয়ে সালিস আইনে সুনির্দিষ্ট বিধান সংযুক্ত করা যেতে পারে।
পদ সৃজন ও পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ
সামনের দিনগুলোতে লিগ্যাল এইড অফিসের কাজের পরিধি এবং কাজের ধরন পরিবর্তন হবে। অচিরেই লিগ্যাল এইড অফিসের কার্যক্রম অনেকাংশে তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর হবে বলে ধারণা করা যায়। তাই লিগ্যাল এইড অফিসের জন্য একজন তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক কর্মচারীর পদ সৃষ্টি ও নিয়োগ করা জরুরি। লিগ্যাল এইড অফিসে অফিস সহায়কের স্থায়ী কোন পদ নেই। সুষ্ঠুভাবে অফিস পরিচালনার জন্য রাজস্ব খাতে কমপক্ষে একজন অফিস সহায়ক নিয়োগ করা আবশ্যক।
এছাড়াও লিগ্যাল এইড অফিসের জন্য একজন অতিরিক্ত জারীকারক ও একজন নিরাপত্তাকর্মীর পদ সৃজন ও নিয়োগ করা অতীব জরুরি। জনবল বৃদ্ধি করা হলে সেবা প্রদান আরও দ্রুত এবং দক্ষতার সাথে করা যাবে, পাশাপাশি আইনি সহায়তা প্রাপ্তির সুযোগও বাড়বে। এতে জনগণের আইনি অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং ন্যায়ের পৌঁছনোর প্রক্রিয়া আরও উন্নত হবে।
লিগ্যাল এইড অফিসের কর্মচারীদের চাকরি রাজস্ব খাতে আনয়ন
লিগ্যাল এইড অফিসের অফিস সহায়কদের চাকরি রাজস্ব খাতভুক্ত না হওয়ায় অনেক কর্মচারী দায়িত্বের প্রতি মনোযোগী থাকেন না। আবার অনেক দক্ষ ও যোগ্য কর্মচারী ভিন্ন চাকরিতে চলে যাচ্ছেন। এই সমস্যা সমাধানে লিগ্যাল এইড অফিসের অফিস সহায়কদের চাকরি রাজস্ব খাতে আনয়ন করা জরুরি।
আইনগত সহায়তা সেবার সংস্কারের মাধ্যমে দেশের দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার আরও সুসংহত করা সম্ভব। একটি সমন্বিত ও প্রযুক্তিনির্ভর পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে এ সেবা আধুনিকায়ন করা হলে তা দেশের বিচারব্যবস্থায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
লেখক: মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, সিলেট এবং যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশন।
মন্তব্য করুন