বাংলাদেশকে ঘৃণার পাত্র হিসেবে উপস্থাপন করে ভারত কী অর্জন করতে চাইছে: মাহফুজ আনাম
ভারত আর বাংলাদেশ দুই অকৃত্রিম বন্ধুদেশ এ কথা আমরা শুনে আসছি, পড়ে আসছি। কিন্তু সেটা ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত। কারণ, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত বিকৃত বর্ণনা, ভিয়েনা কনভেনশন লঙ্ঘন করে আগরতলায় বাংলাদেশের উপহাইকমিশনে কয়েকটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের হামলা ও দেশটির দায়িত্বশীল নেতাদের যে প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, তাতে প্রশ্ন উঠছে, এভাবে প্রতিবেশী দেশকে ঘৃণার পাত্র হিসেবে উপস্থাপন করে ভারত কী অর্জন করতে চাইছে?
এ বিষয়ে ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনামের একটি লেখা পত্রিকাটি প্রকাশ করেছে।
ডেইলি স্টারে প্রকাশিত মাহফুজ আনামের লেখাটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদগুলো দেখলে একটি ধারণাই পরিস্ফুটিত হয়, তা হলো—বাংলাদেশ একটি হিন্দুবিদ্বেষী দেশ। যেভাবে বিষ ছড়ানো হচ্ছে, যে ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে, যেভাবে আমাদের অবমাননাকর ভাবমূর্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে তা থেকে এটা পরিষ্কার যে, ভারতীয় জনগণের মনে আমাদের প্রতি ঘৃণা তৈরির জন্যই এসব প্রচেষ্টা। এর ফলে ভারতীয়দের মধ্যে যে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ছে এবং একইসঙ্গে, বাংলাদেশেও যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে, তা দূর করা বেশ কঠিন হয়ে পড়বে।
এভাবে প্রতিবেশী দেশকে ঘৃণার পাত্র হিসেবে উপস্থাপন করে ভারত কী অর্জন করতে চাইছে? এটা উভয় দেশেরই ক্ষতি করছে। এখানে আমাদের ক্ষতি—বাংলাদেশের একটি বিরূপ ভাবমূর্তি তৈরি করা হচ্ছে। আর ভারতের ক্ষতি—এ ঘটনায় আবারও প্রমাণ হচ্ছে যে তারা তাদের সব প্রতিবেশীর ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে চায় এবং কাউকেই নিজেদের নীতি গ্রহণের সুযোগ দিতে রাজি নয়। এসব নীতি ভারতের বিপক্ষে নয়, বরং আমাদের নিজের তৈরি পথে এগিয়ে চলার স্বতন্ত্র প্রকাশ।
আমার নেপালি সাংবাদিক বন্ধুরা ভারতের মনোভাব ও ব্যবহার নিয়ে যেসব গল্প শোনান, সেগুলো ভারতের জন্য সম্মানজনক নয়। ভুটানের জনগণের মনেও ভারতের ভাবমূর্তি ভালো নয়। ভারতের সর্বশেষ সামরিক উপস্থিতিটুকুও দূর করার জন্য মালদ্বীপ যেভাবে সচেষ্ট, তা খুবই স্পষ্ট বার্তা দেয়। শ্রীলঙ্কার নতুন নেতৃত্ব কী আমাদের ক্ষমতাধর প্রতিবেশী দেশটিকে বিশেষ বার্তা দেয়নি? সব মিলিয়ে, ভারত সম্পর্কে প্রতিবেশীদের অভিন্ন মনোভাব কী প্রকাশ পায়নি? তারপরও সমালোচনামূলক মতামতকে গুরুত্বহীন, ভিত্তিহীন বা ঈর্ষা দ্বারা প্রভাবিত বলে উড়িয়ে দেওয়া এবং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, কৃতজ্ঞতাহীন বলে বিবেচনা করা কতটুকু বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। তার পরিবর্তে প্রতিবেশীদের আরও ভালোভাবে বোঝার প্রয়োজনীয়তা ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের অনুভব করা উচিত।
২০২৪ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত ভারতীয় গণমাধ্যম ও নেতাদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ ছিল অতি উত্তম প্রতিবেশী। তাদের মতে আমাদের দ্বিপাক্ষিক বন্ধুত্ব নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছিল। তাহলে কী এমন ঘটল যে বাংলাদেশ অতি উত্তম প্রতিবেশীর মর্যাদা থেকে অন্যতম নিন্দিত দেশে পরিণত হলো?
তাদের চোখে আমাদের পতনের কারণ হচ্ছেন ৫ আগস্ট আমাদের সরকার পরিবর্তন। অথচ, এটি কোনো ষড়যন্ত্রমূলক ক্ষমতার পালাবদল ছিল না। কিন্তু ভারত সরকার ও তাদের গণমাধ্যম সেটাই ভাবছে। তারা বিষয়টি মানতেই পারছে না যে এই সরকার পরিবর্তন বাংলাদেশের মানুষের মতে প্রতিফলন। তারা বিশ্বাস করে যে, এটি পাকিস্তান, চীন বা যুক্তরাষ্ট্রের কাজ—বাংলাদেশের জনগণের নয়। যে সত্যটি তারা মেনে নিতে পারছে না সেটা হলো, আমাদের আন্দোলন ছিল 'জনতার ইচ্ছা'র একটি শক্তিশালী প্রকাশ, যা বহু বছর আগে ফিলিপাইনের ফার্দিনান্দ মার্কোসের পতন ঘটানো ‘পিপলস পাওয়ার’ আন্দোলন কিংবা মিশরের হোসনি মুবারককে উৎখাত করা ‘আরব বসন্ত’র চেয়েও শক্তিশালী ছিল। কিন্তু এই ঘটনা আমাদের প্রতিবেশীর মন ও মননে দাগ কাটতে পারেনি। এ দেশের মানুষ কয়েক সপ্তাহে যা করে দেখিয়েছে তা করতে অন্যদের বছর না হলেও কয়েক মাস লেগেছে। এটাই ছিল জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শক্তি।
ভারত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের শক্তিমত্তা অনুধাবন করতে পারেনি, কারণ আমাদের ছাত্র আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাস সম্পর্কে হয়তো তারা অবগত নয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছরের মধ্যেই দেশটির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বিরুদ্ধে আমাদের শিক্ষার্থীরা রুখে দাঁড়িয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। তারা জেনারেল আইয়ুবের 'ইস্পাত-কঠিন শাসনামল'র অবসান ঘটিয়েছে, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা (১৯৬৬) ও ছাত্রদের ১১ দফাকে (১৯৬৯) পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপ্রতিরোধ্য আন্দোলনে পরিণত করেছিল। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে জয়লাভের পেছনেও ছাত্ররাই সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছিল এবং বলাই বাহুল্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় সশস্ত্র সংগ্রামের ভিত্তি গড়ে তুলতেও ছাত্র ও কৃষকভিত্তিক যুব সমাজ ছিল অগ্রভাগে।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও আমাদের ছাত্রদের গৌরবময় ঐতিহ্য অব্যাহত থাকে। তারা মানবাধিকার ও সামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠার পক্ষে এবং স্বৈরাচার, সামরিক শাসন ও সব ধরনের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
'৩৬ জুলাই'য়ে যা কিছু হয়েছে, তা সেই ঐতিহ্যেরই ধারাবাহিকতা, এমনকি তারচেয়েও বেশি কিছু। এই আন্দোলন অনেক বেশি উদ্দীপনাপূর্ণ, শক্তিশালী ও সর্বব্যাপী ছিল। কেউ ভাবতে পারেনি যে গণআন্দোলনের মাধ্যমে হাসিনা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব। কিন্তু আমাদের ছাত্ররা তা করে দেখিয়েছে, যা এই আন্দোলনকে করে তুলেছে অনন্য।
গণতান্ত্রিকভাবে নিজেদের সরকার পরিবর্তনের অধিকার যে আমাদের আছে, সেটা ভারত মানতে পারছে না। আমাদের দেশে ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়তো প্রচলিত ধারার নির্বাচনের মাধ্যমে হয়নি। বরং এটা ছিল 'জনতার ইচ্ছা'র বলিষ্ঠ প্রকাশ, যা সাধারণত নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নিজেই নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করেছিলেন। যার ফলে আন্দোলনই ছিল একমাত্র পথ। মজার বিষয় হলো, তিনি যদি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করে পরাজিত হতেন, তাহলে অন্তত দেশে থেকে যেতে পারতেন। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার লজ্জার মুখে তাকে পড়তে হতো না। কাজেই সার্বিকভাবে আমাদের ক্ষমতার পটপরিবর্তন ছিল গণতন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ বহিঃপ্রকাশ।
কিন্তু ভারত প্রথম থেকেই এটা মেনে নেয়নি। উল্টো তারা 'ষড়যন্ত্র তত্ত্ব' তৈরি করেছে এবং আজ অবধি তারা সেই তত্ত্বই আঁকড়ে ধরে আছে।
আমরা সবাই জানি, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যান এবং তার সরকারের পতন হয়। ৮ আগস্ট ড. ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আগের তিন দিন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে তৈরি হয় শূন্যতা। এ সময় আওয়ামী লীগের বেশকিছু নেতা ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ আক্রান্ত হন। তাদের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করা হয়। এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য যে, আক্রান্তদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের কর্মী ছিলেন এবং তাদের অনেকে পতিত সরকারের বিশেষ সুবিধাভোগী ছিলেন (তার অর্থ এই নয় যে তাদের ওপর হামলা করা ঠিক হয়েছে)। কাজেই এই হামলার ঘটনাগুলো সাম্প্রদায়িক হামলা বলা সম্পূর্ণভাবে উচিত না, যদিও সেটাই করা হচ্ছে। যদি পুলিশ বাহিনী তাদের স্বাভাবিক দায়িত্বে থাকত, তাহলে এমন ঘটনা ঘটত না।
যাইহোক, প্রথম কয়েক দিনের সেই ঘটনাগুলো বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতি সম্পর্কে ভারতীয় সরকার ও গণমাধ্যমের দৃষ্টিভঙ্গিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। নতুন নেতাদের পর্যবেক্ষণ ও সঠিক মূল্যায়ন করার পরিবর্তে ভারতীয় গণমাধ্যমে ভুল ব্যাখ্যা ও ভুল প্রতিবেদন প্রকাশের হিড়িক পড়ে যায়।
ভারতের প্রভাবশালী কয়েকটি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় আমি অনুরোধ করেছিলাম, তারা যেন বাংলাদেশকে 'হাসিনার চোখে না দেখে গণতন্ত্রের চোখে দেখে'। দুঃখজনকভাবে তারা সে কথায় কর্ণপাত না করে একই ধারা চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতের গণমাধ্যমগুলো একে অপরকে ইন্ধন জুগিয়েছে এবং শেখ হাসিনার পতনকে পাকিস্তানের আইএসআইয়ের সহযোগিতায় জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্রসংগঠন শিবিরের কাজ বলে আষাঢ়ে গল্প তৈরি করেছে। তাদের যুক্তি হচ্ছে, আন্দোলন হয়তো শিক্ষার্থীরাই শুরু করেছিল, কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এটাকে নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে গেছে। এটা ছিল ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর ভাষ্য, যার টোপে আটকে গেছে ভারতীয় গণমাধ্যম।
যখন ভারতীয় গণমাধ্যমে 'হিন্দু হত্যা'র ন্যারেটিভ সবকিছুকে ছাড়িয়ে যাচ্ছিল এবং আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক হুমকির মুখে, তখন বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে সংগঠিত সংগঠন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ৪ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট সময়কালের ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ১৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার দুই হাজার ১০টি ঘটনা ঘটেছে বলে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, এসব ঘটনায় নয় জন নিহত, চারজন নারীকে ধর্ষণ, ৬৯টি উপাসনালয়ে হামলা, ৯১৫টি বাড়ি ও ৯৫৩টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, ৩৮টি শারীরিক হামলা ও ২১টি সম্পত্তি দখলের ঘটনাও ঘটেছে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বাংলা পত্রিকা প্রথম আলো ৬৪ জেলায় ও ৬৯ উপজেলায় তাদের নিজস্ব প্রতিবেদকের মাধ্যমে সরেজমিন তদন্ত চালিয়ে ৫ থেকে ২০ আগস্টের মধ্যে এক হাজার ৬৮টি বাড়ি ও ব্যবসায়িক স্থাপনায় হামলার প্রমাণ পায়। এ ছাড়া, ২২টি উপাসনালয়ে হামলার তথ্যও পায়। তাদের প্রতিবেদকরা এসব স্থানের মধ্যে ৫৪৬টিতে (৫১ শতাংশ) সরেজমিনে পরিদর্শন করে এবং বাকিগুলোর পরিস্থিতিও নির্ভরযোগ্য সূত্রের মাধ্যমে যাচাই করে। এসব ঘটনায় দুইজন নিহত হয়েছেন—একজন বাগেরহাটের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মৃণাল কান্তি চট্টোপাধ্যায় এবং অপরজন খুলনার পাইকগাছার স্বপন কুমার বিশ্বাস।
সংখ্যালঘুদের ওপর যেকোনো ধরনের হামলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশকে অবশ্যই সবার নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করতে হবে। কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যমে যেভাবে বাংলাদেশকে তুলে ধরা হচ্ছে, সেটা কি ন্যায়সঙ্গত? সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা কি ভারতেরও বাস্তবতা নয়? গুজরাটের গোধরায় একটি ট্রেন জ্বালিয়ে দেওয়া এবং সেখান থেকে শুরু হওয়া দাঙ্গায় ৭৯০ জন মুসলিম ও ২৫৪ জন হিন্দু নিহত হয়েছিলেন, হাজারো মানুষ গৃহহীন হয়েছিলেন। এই তথ্য খোদ ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ২০০২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ভারতে ৩১টি দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ২০টি ছিল হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে। ভারতীয় গণমাধ্যম এখন যা করছে, তখন কি বাংলাদেশি গণমাধ্যম তেমন কিছু করেছিল?
সাম্প্রতিক যেসব ঘটনার কারণে ভারতে বিক্ষোভকারীদের হাতে বাংলাদেশি পতাকা এবং আমাদের দেশে কয়েকটি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের হাতে ভারতের পতাকার অবমাননা হয়েছে; চট্টগ্রামে এক মুসলিম আইনজীবী ও ঢাকায় একজন হিন্দু চিকিৎসক হত্যার ঘটনা ঘটেছে, এগুলোর পেছনে ইন্ধন জুগিয়েছে সাবেক ইসকন নেতা গ্রেপ্তারের ঘটনা। আগরতলায় আমাদের সহকারী হাইকমিশনে হামলার ঘটনাটি নিন্দনীয় এবং এটি প্রতিরোধ করা উচিত ছিল, প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল। অপরদিকে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী পাঠানোর জন্য তাদের প্রধানমন্ত্রী মোদিকে যে পরামর্শ দিয়েছেন, তা অত্যন্ত অপমানজনক এবং এর ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় ঐক্যের আহ্বান এবং সব রাজনৈতিক দলকে একত্রিত হয়ে আমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার আহ্বান স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, আমরা এই পরিস্থিতিকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছি।
যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু যুদ্ধংদেহী ভারতীয় গণমাধ্যম সেগুলোকে যেভাবে প্রচার করেছে, তা পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে। কিন্তু আমাকে যে বিষয়টি সবচেয়ে হতবাক করেছে তা হলো, তারা প্রতিবেদন তৈরি ও প্রচারের আগে তথ্যগুলো যাচাই করেনি। অথচ, এগুলো সাংবাদিকতার একেবারে মৌলিক ও প্রাথমিক দায়িত্ব। অনেক সাক্ষাৎকার ও টকশোতে অন্য কোনো অপ্রাসঙ্গিক ঘটনার ফুটেজ দেখিয়ে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। সম্প্রতি আরটি ইন্ডিয়ার ওয়েবসাইটে শিব মূর্তি ভাঙার একটি ফুটেজ দেখানো হয়। সেখানে দাবি করা হয়, ভিডিওটি বাংলাদেশ থেকে ধারণ করা। প্রকৃতপক্ষে, এটি ভারতের বর্ধমানের সুলতানপুরের একটি মন্দিরের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ফুটেজ। আমরা আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরলেও আরটি ইন্ডিয়া দুঃখপ্রকাশ করা তো দূরে থাক, ভুল প্রতিবেদনটি সংশোধনও করেনি।
এ ধরনের ঘটনা কমতে থাকবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। গণমাধ্যমের উত্তপ্ত ভাষাও হয়তো কিছুটা ঠান্ডা হয়ে আসবে এবং নৈতিক মূল্যবোধের জায়গায় ফিরবে। কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যমের সৃষ্টি করা এই বিকৃত বর্ণনার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব আমাদের দেশে দীর্ঘমেয়াদে বেদনাদায়ক অনুভূতি রেখে যাবে। অহংকারী ও যেকোনো মূল্যে বাড়তি ক্লিক পাওয়ার মানসিকতার কারণে ভারতীয় গণমাধ্যম হয়তো এটা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করবে না, কিন্তু পেশাদার কূটনীতিকরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন বলে আশা করি।
মাহফুজ আনাম, সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
মন্তব্য করুন