পাপিয়া সারোয়ার: বাংলা গানে অনন্য এক স্বাক্ষর
ছেলেবেলায় যাঁদের গান শুনে শুনে রবীন্দ্রসংগীতের শ্রোতা হয়ে উঠতে পেরেছিলাম, পাপিয়া সারোয়ার তাঁদেরই অন্যতম। কণ্ঠের স্বাতন্ত্র্যে ও মাধুর্যে বাংলা গানে অনন্য এক স্বাক্ষর রচনা করেছেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথের একেকটি গান একেক শিল্পীর কণ্ঠে আলাদা আলাদা আবেদন নিয়ে ধরা দিলেও কোনো কোনো শিল্পীর কণ্ঠে নির্দিষ্ট গান তাঁরই নিজস্ব ‘স্বাক্ষর’ হয়ে ওঠে। পঞ্চকবির যে কারও গানের ক্ষেত্রেই এ কথা সত্য। পাপিয়া সারোয়ারের কণ্ঠে আমাদের শোনা এমন কিছু গান আছে যা আর কারও কণ্ঠে অমন আবেদন নিয়ে ধরা দেবে না; অথবা দিলেও তা নবতর স্বাক্ষর হিসেবে যোজিত হবে। ‘যা হারিয়ে যায়’, ‘না সজনী না’, ‘যদি বারণ করো’, ‘হৃদয়ের এ কূল ও কূল’—গানগুলো শুনলে মনে হয় এগুলো যেন তাঁরই জন্য সৃজিত হয়েছিল, তাঁরই কণ্ঠে রণিত হবার অপেক্ষায় ছিল এতদিন।
পাপিয়া সারোয়ারকে আপামর বাঙালি চেনেন যে গানটির জন্য তা রবীন্দ্রসংগীত নয়। ‘নাই টেলিফোন নাই রে পিয়ন’ গানটিতে ত্রিবেণীসঙ্গম ঘটেছে লোকগানের আদলে রচিত কথার সঙ্গে আধুনিক গানের সুরের, আর রবীন্দ্রসংগীতের গায়কী-চিহ্নিত এক স্নিগ্ধ কণ্ঠমাধুর্যের। সেসময় কতটা জনপ্রিয় হয়েছিল এ গান তার সরস এক নমুনা আমি দেখেছি রাজধানীর শুক্রাবাদে, একটি দোকানের নামকরণে। টেলিফোন-ফ্যাক্সের সে দোকানটির নাম ‘নাই টেলিফোন’। কীরকম রসিক শ্রোতা হলে টেলিফোন থাকা সত্ত্বেও এবং তা নিজের ব্যবসার মূল অবলম্বন হওয়া সত্ত্বেও মালিক তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম নিয়ে এরকম ‘ঝুঁকি’ নিতে পারেন !
গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে সহসা এক সন্ধ্যায় সৌভাগ্য হয়েছিল সাদি মহম্মদ এবং পাপিয়া সারোয়ারের গান সরাসরি শোনার। সে সময় দেশবরেণ্য কোনো শিল্পীকে চাক্ষুষ করাও আমাদের কাছে সৌভাগ্যের বলে মনে হতো। বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে শোনা সেদিনের গানের স্মৃতি অমলিন হয়ে রবে দীর্ঘ দীর্ঘদিন।
সাদি মহম্মদ অভিমানে বিদায় নিয়েছেন কিছুদিন আগে। পাপিয়া সারোয়ারও চলে গেলেন রোগযন্ত্রণা সয়ে। বাঙালির জন্য রেখে গেলেন তাঁর অনন্য নিবেদন— অবিনাশী গান।
লেখক: বরেণ্য আবৃত্তিশিল্পী
মন্তব্য করুন