• ঢাকা বুধবার, ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ২৪ পৌষ ১৪৩১
logo

অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ ‘চরমপন্থা রোধ’

আতিকা নুরী

  ০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১৬:১৪
লেখক: আতিকা নুরী

গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনের পর সর্বজন শ্রদ্ধেয় নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড.মোহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় সাড়ে ৪ মাস অতিবাহিত হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে এই অল্প সময়ে বেশ কিছু ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সাধন তথা সাফল্য অর্জন করেছেন-এটা অস্বীকারের উপায় নেই। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ সরকারের সাফল্য এখনো দৃশ্যমান হয়নি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ধর্মীয় উগ্রবাদ তথা চরমপন্থা দমনে তৎপরতা।

স্বৈরাচার হাসিনার পতনের পর সকল দল ও মতের লোকজন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সভা-সমাবেশের অবাধ সুযোগ গ্রহণ করছেন। এ সুযোগে ধর্মভিত্তিক একাধিক দল, বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী ও উগ্র মানসিকতার কিছু ব্যক্তি যে আস্ফালন দেখাচ্ছেন- তাতে আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারছি না। বাংলাদেশে ছিনতাইসহ অন্যান্য সন্ত্রাসের বিস্তার থাকলেও আমরা স্বভাবতই ধর্মভিত্তিক উগ্রপন্থা বা চরমপন্থা নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন থাকি। তার কারণ, এটি মতাদর্শের ভিত্তিতে সংগঠিত হয়।

খোদ যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের সর্বদলীয় গ্রুপ (এএপিজি) বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের উত্থান নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। বাংলাদেশে বেড়ে চলা রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ইসলামি চরমপন্থার সম্ভাব্য উত্থান নিয়ে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামির কাছে পেশ করা এক প্রতিবেদনে এএপিজি এই সতর্কতা জারি করেছে।

এতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে দ্রুত অস্থিতিশীলতার কারণে যুক্তরাজ্য আরেকটি বৈশ্বিক সংঘাতের মুখোমুখি হতে পারে। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে ইসলামপন্থী চরমপন্থীদের উত্থান ঘটে চলেছে।’

প্রতিবেদনে যুক্তরাজ্যের প্রেক্ষাপট নিয়ে বলা হয়,‘বাংলাদেশে অস্থিরতা বাড়লে এর প্রভাব যুক্তরাজ্যেও পড়তে পারে। ২০২১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৮৮১ জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বাস করেন। এটি মোট জনসংখ্যার ১ দশমিক ১ শতাংশ।’

এএপিজি চেয়ারম্যান ও কনজারভেটিভ পার্টির এমপি অ্যান্ড্রু রোসিন্ডেল বলেছেন, ‘কমনওয়েলথ অংশীদারদের সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির একটি পদক্ষেপ এই প্রতিবেদন।’

তিনি আরো জানান, প্রতিবেদনটি সরকার,দাতব্য সংস্থা এবং বাংলাদেশ ও কমনওয়েলথ সংশ্লিষ্ট অন্য অংশীদারদের সঙ্গে শেয়ার করা হবে। তিনি মনে করেন, ওয়েস্টমিনস্টার ও হোয়াইট হলে এই বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে এবং প্রতিবেদনটি সংসদ সদস্য ও নীতি নির্ধারকদের সহায়তা করবে।

যুক্তরাজ্যের এই উদ্বেগ আমাদের সরকারর নীতিনির্ধারকদের কাছে কিছুটা অতিরঞ্জিত মনে হলেও এর সত্যতা সরকার পুরোপুরি অস্বীকার করতে পারবে না। হিযবুত তাহরীরের মতো নিষিদ্ধ গোষ্ঠীর উত্থান এবং মুফতি জসিমুদ্দিন রাহমানির মতো বিতর্কিত ধর্মীয় নেতাদের মুক্তিকে অবশ্যই ইসলামিক রাষ্ট্রের দিকে ক্রমবর্ধমান ধাক্কার অশুভ লক্ষণ হিসেবে দেখতে হবে। এবং এগুলে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার ভবিষ্যত নিয়ে আশঙ্কা তৈরি করে-এটাও মানতে হবে।

সরকার যদি পরিস্থিতি কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে না পারেন,তাহলে সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানের অর্জনগুলো গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি বা উগ্রপন্থীদের দ্বারা ছাপিয়ে যেতে পারে।

আমাদেরকে ভুললে চলবে না যে,একসময়ের বাম চরমপন্থার জায়গা এখন দখল করেছে কট্টরপন্থী ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীগুলো। এদের লক্ষ্যও এককালের অতি চরম বামপন্থীদের লক্ষ্যের প্রায় কাছাকাছি। অতি চরম বামপন্থীরা সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব বা প্যান কমিউনিজমের দীক্ষায় দীক্ষিত ছিল,আর অতি দক্ষিণপন্থী চরমপন্থী সংগঠনগুলো বিশ্বজুড়ে একটি ইসলামি খেলাফত বা প্যান ইসলামিজমের মন্ত্রে দীক্ষিত।

ড.মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে এটা স্মরণ রাখতে হবে যে,বর্তমান বিশ্বে চরম বামপন্থীদের তেমন অবস্থান নেই। তবে বর্তমানে অতি দক্ষিণপন্থীদের উত্থানে বিশ্বের বহু অঞ্চল সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত হয়েছে, বিশেষ করে মুসলিম ও মুসলিমপ্রধান দেশগুলোয়। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়।

নিশ্চয়ই সবাই স্বীকার করবেন বেশ কয়েক বছর পূর্বে বাংলাদেশে আল-কায়েদা প্রভাবিত উপমহাদেশীয় কয়েকটি উগ্রপন্থী সংগঠনের শাখা গড়ে ওঠেছিল। যার মধ্যে প্রধানত হিজবুত তাওহিদ,জামাআতুল মুজাহিদীন, হরকাতুল জিহাদ, আল ইসলামি বাংলাদেশ সংক্ষেপে হুজি (বি) ছিল উল্লেখযোগ্য। দুটিই আল-কায়েদা সমর্থিত ইসলামপন্থী উগ্র সংগঠন ছিল।

হুজি (বি) বাংলাদেশে যথেষ্ট তৎপর থাকলেও এই সংগঠনের বাইরে জন্ম হয় সম্পূর্ণ স্থানীয় উগ্র ধর্মীয় সংগঠন জেএমবি'র। এর উত্থান হয়েছিল একবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে তৎকালীন সরকারের উদাসীনতায়। জেএমবির উত্থান হয় অনেকটা ফ্রাংকেনস্টাইনের দৈত্যের মতো,পরে যা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। ফলে ক্রমেই জেএমবি ওই সময়কার সরকারের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। জেএমবিকে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল ওই সময়কার প্রশাসন। পরে
তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নিতে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে।

এ কারণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বর্তমান সময়টিকে বিপদজনক মনে করে উগ্রবাদীদের ব্যাপারে সতর্ক পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে হবে। কারণ বাংলাদেশ ধর্মীয় মৌলবাদ বা চরমপন্থার প্রবল ঝুঁকিতে আছে। এই ঝুঁকি দিন দিন বাড়তে পারে বহুবিধ কারণে।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে 'আদর্শ'। 'ইসলামী চরমপন্থার' ক্ষেত্রে 'আদর্শিক' বিষয় অনেক বড় ভূমিকা রাখে। এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের বিভিন্ন ইস্যু বাংলাদেশের মুসলমানদের হতাশ বা ক্ষুব্দ্ধ করে। যেমন পাশ্চাত্যে 'ইসলামোফোবিয়া' বা 'ইসলাম ভীতি'-যার ফলে মুসলমানদের 'আইডেন্টিটি ক্রাইসিস' বা 'পরিচয় সংকট তৈরী হয়।কাশ্মীর,ফিলিস্তিন-মিয়ানমারে মুসলিমদের প্রতি আচরণ,সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়গুলোর কারণে বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষিত মুসলিম তরুণ-যুবকরা নিজেদের নিপীড়িত বা নির্যাতিত ভাবতে শুরু করেছে।

এছাড়া দুর্নীতি,বিচার বহির্ভুত হত্যা, সর্বোপরি নাগরিকদের প্রত্যাশা পূরণে সরকারের ব্যর্থতার কারণেও উগ্রপন্থার উত্থান ঘটতে পারে।

এর বাইরে 'মাইক্রো ফ্যাক্টর' বা ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনা যেমন 'প্রেমে ব্যর্থতা', আত্মীয় স্বজনদের দ্বারা সম্পত্তি দখল,এসব বিষয়গুলোর কারণেও অনেক যুবক চরমপন্থার দিকে পা বাড়ায়। তারা হতাশ হয়ে পড়ে এবং সেই শূন্যতা পূরণ করতে গিয়ে অনেকে ধর্মীয় চরমপন্থায় উদ্বুদ্ধ হয়।

চরমপন্থা বা মৌলবাদের খপ্পর থেকে দেশ ও জাতিকে বাঁচানোর জন্য ড.মুহাম্মদ ইউনুস সরকারের বেশ কিছু করণীয় রয়েছে। এই সরকার বুদ্ধিমত্তার সাথে মৌলবাদ দমন করতে না পারলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার ঝুঁকির রয়েছে। তবে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রয়োগে মতাদর্শভিত্তিক চরম উগ্রপন্থীকে নির্মূল অথবা নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব নয়।

বাহিনী দিয়ে মতাদর্শভিত্তিক উগ্রবাদ নির্মূল করে বাংলাদেশকে নিরাপদ রাখতে হলে বহুমুখী তৎপরতার প্রয়োজন রয়েছে। প্রয়োজন রয়েছে একটি জাতীয় ঐকমত্য গঠনের এবং জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই কালো থাবাকে প্রতিহত করার।

এর পাশাপাশি সরকার বা রাষ্ট্রকে আরো কিছু আবশ্যকীয় কাজ করা প্রয়োজন-যা উগ্র মৌলবাদ থেকে জাতিকে সুরক্ষা দিতে সহায়তা করতে পারে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে; (১) মধ্যমপন্থী ধর্মীয় দলগুলোর সাথে সরকারের দূরত্ব গুছানো। (২) দেশে সুশাসনের যে অভাব আছে তা দূর করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা, (৩) দুর্নীতি রোধ করা, (৪) সিংহভাগ তরুণকে সুন্দর ভবিষ্যৎের স্বপ্ন দেখানো এবং তা বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, (৫) রাজনৈতিক দল,বিশেষ করে যুব ও ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘাত, টেন্ডারবাজি, দুর্নীতি ইত্যাদি বন্ধ করা।

এককথায় যা যা সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি করেছে বা করবে-তা সরকারকে শক্তহাতে রুখতে হবে। তা না হলে এইসব অস্থিরতার সুযোগ উগ্রাবাদী সংগঠনগুলো নিতে চাইবে।

আমরা মনে প্রাণে চাই,অন্তবর্তীকালীন সরকারের সময়ে জিএমবি বা সম-মতাদর্শের কোনো গোষ্টি মাথাচাড়া দিয়ে যেন না ওঠে। নতুন নতুন উগ্র যেসব সংগঠন ও ব্যক্তির তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে-তাদেরকে যেন কঠোরভাবে দমন করা হয়। বর্তমান উন্মোক্ত-স্বাধীন বাংলাদেশে নতুনভাবে মৌলবাদীদের উত্থানের চেষ্টা দৃশ্যমান হচ্ছে।অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মৌলবাদীদের এই উত্থান চেষ্টা রোধকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করুক - এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখকঃ নারী অধিকার কর্মী ও ফ্রান্স প্রবাসী কলাম লেখক

আরটিভি/ ডিসিএনই

মন্তব্য করুন

Bangal
rtv Drama
Radhuni
  • অন্যান্য এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
সরকার গঠনের পর অভিযুক্তদের দেশত্যাগ করতে দেওয়া হয়নি: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে: অর্থ উপদেষ্টা
সংস্কারের লক্ষ্যে এক-দেড় বছরের জন্য এসেছে অন্তর্বর্তী সরকার: অর্থ উপদেষ্টা
নির্বাচনের দুটি সম্ভাব্য সময় জানালেন প্রধান উপদেষ্টা