• ঢাকা মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১
logo

ইলিশ কেলেঙ্কারি

সোহেল অটল

  ২১ আগস্ট ২০২৪, ১৬:০৬
লেখক : সোহেল অটল

‘স্যার, এইডা পদ্মার ইলিশ। খাইবেন আর আমার নাম নিবেন।’

এটা হলো খুচরা মাছ বিক্রেতার খুচরা ইতরামি। এই ধরণের ইতরামির সঙ্গে প্রায় সব ইলিশ-ক্রেতাই পরিচিত। অভ্যস্ত।

বাঙালি বলতেই পদ্মার ইলিশের জন্য পাগল। ইলিশ সামুদ্রিক মাছ হলেও বঙ্গোপসাগরে পতিত প্রায় সব নদীতেই ইলিশ পাওয়া যায়। মূলত ডিম ছাড়ার জন্যই ইলিশ উজানের মিঠা পানিতে পাড়ি দেয়।

সেই মিঠা পানির ইলিশই স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় হয়ে ওঠে। কিন্তু পদ্মার ইলিশ অতো সহজ কথা নয়। দেশের প্রাপ্ত মোট ইলিশের এক হাজার ভাগের এক ভাগও হয়তো পদ্মার ইলিশ হবে না।

যাহোক, কথা হচ্ছিল ইলিশ নিয়ে ইতরামি প্রসঙ্গে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুথানের পর হঠাৎই চাউর হয়ে গেল, এবার বাজারে সস্তায় ইলিশ পাওয়া যাবে। সস্তায় ইলিশ প্রাপ্যতার যুক্তি দুইটা।

এক. ইলিশ আর রপ্তানি হবে না। সব আমরাই খাবো। তাহলে বজারে যোগান বাড়বে। যোগান বাড়লে দাম কমবে।

দুই. ঘাটে-পথে আর চাঁদাবাজি হবে না। ঘাটে থেকে বাজার পর্যন্ত পৌঁছাতে নানান ‘লীগ’ এবং পুলিশকে চাঁদা দিতে হতো। ইলিশের দাম বাড়ার সেটাও একটা কারণ ছিল। এখন চাঁদা দিতে হচ্ছে না। সুতরাং দামও কম।

আসলে কি তা-ই হলো?

সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। তার আগে ইলিশ নিয়ে নতুন এক ইতরামির খবর জানাই।

ইলিশের দাম কমেছে শুনে বাজার থেকে সরষে কিনে আনলাম। ‘সরষে-ইলিশ’ এখন শুধু পুস্তকে পাওয়া যায়। পুস্তকের রেসিপিকে বাস্তবে রূপ দেয়ার এক কড়া অঙ্গীকার করলাম।

বাজারে সস্তায় ইলিশ কিনতে যাবো- এমন প্রস্তুতির মুহূর্তে ফেসবুকে দেখি- ৬০% ছাড়ে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে। চাঁদপুরের পদ্মার ইলিশ। একেবারে আড়ৎ থেকে ভিডিও করে ইলিশের সাইজ দেখানো হচ্ছে। একেকটা ইলিশের ওজন দুই কেজির ওপরে।

দাম? সস্তার চেয়েও সস্তা!

মাথা ঘুরে গেল। এই তো চেয়েছিলাম। আন্দোলনের ফল হাতেনাতে পাচ্ছি!

ধমাধম অর্ডার করে ফেললাম। বিক্রেতা অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে জানালো- “স্যার, ইলিশ হাতে পেয়েই দাম পরিশোধ করবেন। শুধু বরফ এবং প্যাকিং বাবদ ৫৭০ টাকা এখন পাঠিয়ে দিন।”

ভাবলাম, বলে কী ব্যাটা! এতো সস্তায় ইলিশ খাওয়াচ্ছিস, চাইলে তোর নামে বাড়ি-ঘর পর্যন্ত লিখে দিতে পারি!

৫৭০ টাকা পাঠিয়ে তাকিয়ে থাকলাম মোবাইলের দিকে। কখন ডেলিভারি ম্যান ফোন দিয়ে বলে- স্যার আপনার ইলিশগুলো রিসিভ করেন!

দুইদিন গেল খবর নাই। বাধ্য হয়ে বিক্রেতাকে ফোন লাগালাম।

বিক্রেতা আগের চেয়েও বিনীত ভঙ্গিতে বলল- স্যার, কিছুক্ষণের মধ্যেই ডেলিভারি ম্যান আপনাকে ফোন দিবে!

আমাকে অবাক করে দিয়ে সত্যি সত্যি ডেলিভারি ম্যান ফোন দিলো। ইলিশ নিয়ে ৩০ মিনিটের মাথায় আমার বাসায় আসছে বলে আমার মোবাইলে প্রেরিত ওটিপি জানতে চাইলো।

আমার মোবাইলে তো কোনো ওটিপি নেই। আবার ফোন দিলাম বিক্রেতাকে। আমার তর সইছে না। এখনই ওটিপি চাই।

বিক্রেতা আগের দুবারের চেয়েও বিনয় দেখালো। বলল- স্যার, এখনই আপনার মোবাইলে ওটিপি চলে যাবে। আপনি কিন্তু স্যার মাছগুলো ভালো করে চেক করবেন। যদি কোনো মাছ পছন্দ না হয়, অবশ্যই ফেরত পাঠাবেন।

ভাবলাম, এই বিক্রেতাকে কাছে পেলে নিশ্চয় একটু চুমু দিয়ে দিতাম।

পরক্ষণেই বিক্রেতা বলল- স্যার ওটিপি পাওয়ার জন্য আপনাকে মাত্র এক হাজার টাকা বিকাশ করতে হবে। বাকি টাকা ডেলিভারি ম্যানের হাতে দিলেই হবে!

এক সেকেন্ডের মধ্যেই আমার হুঁশ ফিরলো। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলল- গোলমাল হ্যায় ভাই গোলমাল হ্যায়!

ফোনটা কেটে খোঁজ নেয়া শুরু করলাম। যে পেজ থেকে ইলিশের অর্ডার নেয়া হচ্ছিল, সেই পেজে গিয়ে দেখলাম- আমার মতো ভুক্তভোগীর সংখ্যা অসংখ্য। সবাই প্রতারিত। এভাবেই এক শ্রেণির ক্রিমিনাল সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে অজস্র টাকা। বাস্তবে কোনো ইলিশ পাঠাচ্ছে না।

এটাই এদের ইলিশ-ইতরামি।

এবার আগের প্রসঙ্গে ফিরি।

ভারতে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ করলে স্থানীয় বাজারে তার কী প্রভাব পড়তে পারে?

বছরে বাংলাদেশে ইলিশ উৎপাদন হয় প্রায় পাঁচ থেকে ছয় লাখ মেট্রিকটন। আর ভারতে সর্বশেষ ইলিশ রপ্তানি হয়েছিল এক সিজনে প্রায় চার হাজার মেট্রিক টন। দূর্গাপূজা মাথায় রেখেই সাধারণত বাংলাদেশ সরকার ভারতে ইলিশ রপ্তানি করতো। এটাকে বাংলাশের ইলিশ-কূটনীতিও বলা যায়। চীন যেমন ‘পান্ডা-কূটনীতি’ চালায়।

তাহলে পাঁচ-ছয় লাখ মেট্রিক টন থেকে চার হাজার মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানি, খুব বেশি মনে হয় না।

তবে মনস্তাত্বিক একটা প্রভাব আছে। সে প্রভাবেই ভারতে ইলিশ রপ্তানির খবর আসার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারে ইলিশের দাম বেড়ে যায়।

অন্যদিকে পুলিশ এবং নানান জাতের লীগ যে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত ছিল, সেই ইতরামি যদি সত্যি সত্যি বন্ধ হয়, তাহলে ইলিশের দাম কিছুটা কমার কথা।

শেষে আরেক ধরণের ইতরামির নমুনা দিয়ে লেখাটা শেষ করি।

আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনে ওই সরকারের সুবিধাভোগী সুশীল সাইনবোর্ডের কিছু মানুষ খুব দাঁত কেলাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বলছেন- কই, ইলিশের দাম নাকি কমেছে? তোমাদের নতুন বিপ্লবী সরকার নাকি সস্তায় ইলিশ খাওয়াবে? কই? পারছে না তো!

এই ইতরামির কারণ স্পষ্ট। তাদের গা জ্বলছে। বোঝাতে চাইছে- নতুন সরকার ইলিশের দাম যখন কমাতে পারলো না, তাহলে আগের সরকারই ভালো ছিল।
ইতরামি কাহাকে বলে!

সোহেল অটল: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
atol.bd@gmail.com

মন্তব্য করুন

Radhuni
  • মুক্তমত এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
প্রতিবেশী দেশে ইলিশ ও সার চোরাচালানের ঝুঁকি রয়েছে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
ভারতে পাচারের সময় ৮৫০ কেজি ইলিশ জব্দ
ক্ষমা চাচ্ছি, ভারতে ইলিশ পাঠাতে পারব না: মৎস্য উপদেষ্টা
ভারতে পাচারকালে কুমিল্লা সীমান্তে ৪৪০ কেজি ইলিশ জব্দ