এই গল্পটা শুনে যান প্লিজ

সোহেল অটল

মঙ্গলবার, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ০৮:০৮ পিএম


এই গল্পটা শুনে যান প্লিজ
লেখক: সোহেল অটল

ফেয়ারি টেল অর্থাৎ রূপকথার গল্প বলতে যা বোঝায়, এ গল্প তা-ই। গল্পের নাম অ্যানিমেল ফার্ম। ১৯৪৫ সালের ১৭ আগস্ট প্রকাশিত এই উপন্যাসটি লিখেছিলেন ইংলিশ সাংবাদিক ও লেখক জর্জ অরয়েল।

বিজ্ঞাপন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই প্রকাশিত বইটি বেস্ট সেলারের তকমা পায়। শুধু তাই নয়, এই বই রিপ্রিন্টের জন্য পরবর্তীতে কাগজ সংকটেও পড়তে হয় প্রকাশককে।

তাহলে শুরু করা যাক।

বিজ্ঞাপন

তার আগে বলে রাখি, কেন গল্পটা শোনার জন্য আপনাকে আহ্বান করছি। কারণ, এই গল্পে আপনিও আছেন।

ইংল্যান্ডের পূর্ব সাসেক্সে অবস্থিত ‘অ্যানিমেল ফার্ম’। ফার্মে একইসঙ্গে বাস করে শূকর, গরু, ঘোড়া, হাঁস-মুরগিসহ নানান জাতের পশুপাখির বাস। ওই ফার্মের মালিক মি. জোন্স। তিনি নিয়মিত মদ্যপ থাকেন।

এক রাতে জোন্স ঘুমিয়ে পড়ার পর ফার্মের সবচেয়ে প্রবীণ শূকর (মেজর যার নাম) অন্যদের ডেকে তুলল।

বিজ্ঞাপন

মেজর নামের শূকরটি বলে উঠল ‘আমি জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে পড়েছি। তোমাদের উদ্দেশে কিছু বলার আছে আমার।’

বিজ্ঞাপন

মেজর বলল, দু’পেয়ো মানুষেরা যুগের পর যুগ আমাদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে। অথচ দেখো, মানুষ তার জীবন ধারণের জন্য আমাদের ওপর নির্ভরশীল। তারা নিজেরা কিছু করতে পারে না। আমাদের দুধ, আমাদের ডিম না হলে তাদের চলে না। কৃষিকাজের জন্য আমাদের ওপর তারা কী অত্যাচারটাই না করে!

একটু থেমে পশু-পাখিদের দিকে তাকালো মেজর। সবাই আগ্রহ নিয়ে তার কথা শুনছে।

‘অথচ দেখো’, আবার শুরু করলো মেজর, মানুষের ওপর নির্ভর না করলেও আমাদের চলে। পৃথিবীতে যত ঘাস আছে, যত খাবার আছে, সারাজীবন খেয়েও আমরা কোনোদিন শেষ করতে পারব না।

পশু-পাখিদের মধ্যে মৃদু রব উঠল, ‘ঠিক কথা!’

মেজর ফের শুরু করল, কিন্তু দেখো এই মানুষেরা আমাদের দাস বানিয়ে রেখেছে। অথচ, তাদেরই দাস হয়ে থাকার কথা ছিল।

সবাই সমস্বরে বলে উঠল, ‘ঠিক, ঠিক!’

সভাশেষে মেজর বলল, আমি আর বেশিদিন বাঁচব না। কিন্তু এখন সময় এসেছে অভ্যুত্থানের। মানুষের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ করতে হবে। দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে হবে। আমাদের স্বাধীন হতে হবে।

আরেকবার সমস্বরে সবাই ‘ঠিক ঠিক’ বলে সেদিনের মতো সভা শেষ করল।

এর তিনদিন পর মেজর মারা যায়। কিন্তু শূকরটি যে সংগ্রামের বীজ বুনে দিয়ে গেল, তা বাকিদের রক্তে ঢুকে গেছে। সবাই অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করতে থাকে। এরমধ্যে মি. জোন্স একদিন মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফিরে ফার্মের প্রাণীদের খেতে দিতে ভুলে যান। প্রাণীদের অভুক্ত রেখেই ঘুমিয়ে পড়েন তিনি।

জোন্সের এই কাণ্ডজ্ঞানহীন কর্মে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে স্নোবল ও নেপোলিয়ন (দুই তরুণ শূকর) । সবাইকে ডেকে বলে, দেখেছো কী নির্মম পাষণ্ড! আমাদেরকে অভুক্ত রেখে ঘুমিয়ে গেল!

বাকি পশু-পাখিও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। তাদের রক্তে আগুন জ্বলে উঠল। তারা সিদ্ধান্ত নিলো তাৎক্ষণিক অভ্যুত্থানের। স্নোবল ও নেপোলিয়নের নেতৃত্বে তারা মি. জোন্সকে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলো।

এই প্রাণীগুলোকে এতদিন মি. জোন্স কখনোই না খাইয়ে ঘুমিয়ে পড়েননি। কিন্তু সবাই সে কথা ভুলে গেল। তাদের এতদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, স্বাধীন হওয়ার আকাঙ্ক্ষা এতটাই বিস্ফোরিত হলো যে, সবাই মিলে জোন্সের বাসগৃহে আক্রমণ করলো।

ফার্মের প্রাণীদের সম্মিলিত আক্রমণের মুখে জোন্স তার পরিবারসহ ফার্ম ছেড়ে পালিয়ে গেলেন।

কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা পেয়ে ফার্মের প্রাণীরা খুশি। 

অল্প কিছুদিনের মধ্যেই স্বাধীন ফার্মের প্রাণীরা কিছু সমস্যার সম্মুখীন হলো। যেমন দুধ দোয়াতে না পারার কারণে গাভিরা সমস্যায় পড়লো। চাষ করার যন্ত্রগুলো ব্যবহার করতে না পারায় ফসল উৎপাদন ব্যাহত হতে লাগলো।

স্নোবল এবং নেপোলিয়ন এই সমস্যার সমাধানে নেতৃত্ব দিলো। স্নোবল দায়িত্ব নিলো তরুণ প্রাণীদের লেখাপড়া শেখানোর। নেপোলিয়ন ফার্মে ‘অ্যানিমালিজম’ এর দীক্ষা দিতে আরম্ভ করলো।

দুজনে মিলে একটা সংবিধানও দাঁড় করিয়ে ফেলল। সাত ধারা সে সংবিধানের মূল কথা- সব প্রাণীই সমান। অর্থাৎ এখানে কোনো বড়-ছোট থাকবে না। সবার সমান অধিকার।

বিভিন্ন প্রতিকূলতা সত্বেও অ্যানিমেল ফার্ম এগিয়ে যেতে লাগলো। পাশের ফার্মগুলোতেও তাদের স্বাধীনতার খবর পৌঁছে গেল। কিন্তু সেখানকার ফার্ম মালিকেরা নানান কূটকৌশলে সেখানে অভ্যুত্থান ঘটাতে দিলো না।

এর মধ্যে মি. জোন্স একদিন ফিরে এলেন। আরও কিছু লোকজন নিয়ে ফার্ম আক্রমণ করলেন। প্রতিবিপ্লব। কিন্তু লাভ হলো না। স্নোবল এবং নেপোলিয়নের নেতৃত্বে প্রাণীকূল তাদের প্রতিরোধ করলো। মি. জোন্স আবারও পালিয়ে গেলেন।

এই যুদ্ধে বেশ কিছু প্রাণী আহত হলো। তাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলো। দেওয়া হলো সার্টিফিকেটও।

এরপর বেশ আরামেই কাটছিল ফার্মের প্রাণীদের দিন। যদিও অল্প-বিস্তর বৈষম্য দেখা দিচ্ছিল। যেমন ভালো খাবারগুলো স্নোবল এবং নেপোলিয়নের জন্য বরাদ্দ থাকতো।

অন্যরা মৃদু আপত্তি জানালে তারা বলল, এটা তোমাদের জন্যই করছি। আমরা তো সবাই সমান। কেউ বড়-ছোট নই। কিন্তু বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে আমাদের শারিরীক ও মানসিকভাবে সবল থাকতে হবে। এজন্যই এ খাবারগুলো আমরা খাচ্ছি। তোমাদের কথাই চিন্তা করে। না হলে এসব খাবার খেতে আমাদের ভালো লাগে না। সবাই যুক্তি মেনে নিলো।

মি. জোন্সের প্রতিবিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার পর ফার্মের আধুনিকায়নের জন্য একটি উইন্ডমিল স্থাপনের উদ্যোগ নিলো স্নোবল। তার এই উদ্যোগে বাধা দিলো নেপোলিয়ন। শুরু হলো স্বাধীন ফার্মে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব।

কিছুদিনের মধ্যেই এই দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠল।

এই দ্বন্দ্বের জেরে স্নোবলকে একদিন ফার্ম ছেড়ে পালাতে হয়। মি. জোন্সের চারটি কুকুর ছিল। সেগুলো এখন নেপোলিয়নের সঙ্গেই ঘোরে। তারাই স্নোবলকে তাড়িয়ে দিলো। স্নোবল পালিয়ে পাশের ফার্মে আশ্রয় নিলো।

ফার্মে এখন নেপোলিয়নের একচ্ছত্র নেতৃত্ব। সে নিজেকে সুপ্রিম কমান্ডার ঘোষণা দেয়। সুপ্রিম কমান্ডার হিসেবে বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধাও ভোগ করে। যেমন সে আর এখন অন্য প্রাণীদের সঙ্গে ফার্মে ঘুমোয় না। সে থাকে মি. জোন্স এর বাসগৃহে। বিছানায়। যা অ্যানিমেল কিংডমের সংবিধানবিরোধী।

স্নোবল ফার্ম ছেড়ে যাওয়ার পর সংবিধান ছিড়ে ফেলে নেপোলিয়ন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই সংবিধান অকার্যকর বলে ঘোষণা করে। 

কিছুদিন বাদেই নেপোলিয়নের আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন চলে আসে। তার চারপাশে কিছু সুবিধাবাদী প্রাণী জুটে যায়। যারা সারাক্ষণ নেপোলিয়নের প্রসংশা ও গুণকীর্তন করে বেড়ায়।

একটা গ্রুপকে দায়িত্ব দেওয়া হয় গুজব ছড়ানোর জন্য। যেমন—ফার্ম থেকে বিতাড়িত স্নোবল ষড়যন্ত্র করছে মি. জোন্সের সঙ্গে। তারা মিলে যেকোনো সময় ফার্ম আক্রমণ করতে চায়। আমাদের স্বাধীনতা ধুলিস্যাৎ করার চক্রান্তে লিপ্ত তারা।

বেশ কয়েক বছর কেটে যায়। ফার্মে নানান ঘটনা ঘটে যায় এর মধ্যে। ছোট-খাটো যুদ্ধ হয়। অনেক প্রাণী শহীদ হয়। আর নেপোলিয়নের ক্ষমতা আরও বেড়ে যায়।

ফার্মের প্রাণীদের মধ্যেও কিছু পরিবর্তন আসে। তারা এখন চারপায়ে হাঁটে না। দুই পায়ে হাঁটে। আগে ফার্মের স্লোগান ছিল—সমস্ত চারপেয়ো প্রাণী ভালো, দুপেয়োরা খারাপ।

এখন সেই স্লোগান পরিবর্তন হয়ে গেছে। নতুন স্লোগান হলো—চারপেয়ো প্রাণীরা ভালো, দু’পেয়োরা তার চেয়ে ভালো।

সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হয়েছে যে স্লোগানে তা হলো—সকল প্রাণী সমান কিন্তু কিছু প্রাণী ব্যতিক্রম।

সেই ব্যতিক্রম প্রাণীদের তালিকায় পড়ে নেপোলিয়ন এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা। যাদের খাবারের অভাব হয় না কখনো। যাদের কথা বলার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। যারা অন্যকে হুকুম করতে পারে। দণ্ডও দিতে পারে।

‘অ্যানিমেল ফার্ম’ গল্পের এখোনেই শেষ। গল্পের শেষ দৃশ্যে নিপোলিয়নকে একটা পার্টিতে দেখা যায়। যেখানে সভা-সদস্যদের নিয়ে হুইস্কি পান করে। ঠিক মি. জোন্সের মতো। মি. জোন্সের মেজাজে, ঢঙে।

তার অন্দরমহলের প্রতিটি দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে শক্তিশালী গার্ড। যাদের এড়িয়ে নেপোলিয়ানের কাছে ভিড়তে পারে না কোনো সাধারণ প্রাণী।

ইংলিশ লেখক জর্জ অরয়েল ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবকে পটভূমি করে লিখেছিলেন এই বই। লেনিনবাদ-স্টালিনবাদ প্রতিষ্ঠা ও তার ফলকে কটাক্ষ করে লিখেছিলেন এই রূপকথা।

এ গল্পের মূল বক্তব্য কী?

পৃথিবীতে কোনো অভ্যুত্থান, কোনো বিপ্লব সাধারণের জন্য স্থায়ী স্বাধীনতা এনে দিতে পারে না। সাধারণের স্বপ্ন ভাঙতে ইতিহাসের পরতে পরতে জন্ম নেয় ফ্যাসিস্ট। 
সাম্যের গল্প আওড়াতে আওড়াতেই জন্ম হয় এসব ফ্যাসিস্টের।

সোহেল অটল: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
[email protected]

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন
Advertisement
Advertisement

Loading...


© All Rights Reserved 2016-2025 | RTV Online | It is illegal to use contents, pictures, and videos of this website without authority's permission