• ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১
logo

পুঁজিবাজারের চলমান অস্থিরতা এবং কিছু প্রস্তাবনা

মুশফিকুর রহমান রনি

  ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৪:৫৬
লেখক : মুশফিকুর রহমান রনি

দেশের পুঁজিবাজারে তীব্র অস্থিরতা বিরাজ করছে। নব্বই দশকের পর থেকে কিছু ব্যক্তি ও স্বার্থান্বেষী মহল পুঁজিবাজারকে জুয়ার বাজার বানিয়ে রেখেছে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও আমরা এই অর্থলোভী ব্যক্তিস্বার্থের কাছে কুক্ষিগত হয়ে আছি। বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে শুধু ব্যক্তি বিনিয়োগকারী নন, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এবং মধ্যবর্তী প্রতিষ্ঠানগুলোও উদ্বিগ্ন।

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছর মেয়াদে অর্থনীতির অন্যান্য খাতের মত পুঁজিবাজারেও অবাধ লুটতরাজ হয়েছে। এ সময়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সাথে যোগসাজশ করে অসংখ্য দুর্বল ও প্রায় দেউলিয়া কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। ক্রমেই এসব কোম্পানির আসল চেহারা প্রকাশিত হচ্ছে। অন্যদিকে এই বাজারে লাগামহীন কারসাজির মাধ্যমে দুর্বল, জাঙ্ক কোম্পানির শেয়ারের দাম ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। অনেক উচ্চমূল্যের শেয়ারে আটকে আছে অসংখ্য বিনিয়োগকারীর মূলধন।

২০১০ সালে বড় ধসের পর থেকেই পুঁজিবাজার ধুঁকছিল। সদ্যবিদায়ী শিবলী কমিশনের মেয়াদে এসে তা আরও নাজুক অবস্থায় পড়ে। শিবলী কমিশন ফ্লোরপ্রাইস আরোপসহ নানান কৃত্রিম ব্যবস্থায় বাজারের এ অবস্থা ঢেকে রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এখন ওই কৃত্রিম চেষ্টা না থাকায় ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকা অনিয়ম, দুর্নীতি, কারসাজির অনিবার্য পরিণতি এখন আগের চেয়েও বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। তিনি মার্কেট ভালো করার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও তৎপর রয়েছে চক্রান্তকারীরা। সালমান এফ রহমান ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের সিন্ডিকেট এখনো বাজারে সক্রিয়। এরা তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা এবং নিজেদের হীন গোষ্ঠীস্বার্থ হাসিলের লক্ষ্য হিসেবেই পুঁজিবাজারকে নানাভাবে অস্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, পুঁজিবাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলতে কলকাঠি নাড়ছেন সিআরও খায়রুল বাশার আবু তাহের মোহাম্মদ। এই খায়রুল বাশার হলেন শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির মূলহোতা সালমান এফ রহমানের অন্যতম সহযোগী। খায়রুল বাশারের অনৈতিক কাজে সহযোগিতা করেছেন ডিএসইর আবু তাহের, বজলুর রহমান, জাকির হোসেন, ইকরাম হোসেন, আফজালুর রহমানসহ কয়েকজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। এরই মধ্যে তাদের উৎখাতে আন্দোলন শুরু হয়েছে। আন্দোলনকারীরা বলছেন, এইসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ডিএসইতে থাকার কোনো যোগ্যতা নেই। তারা যতদিন ডিএসইতে থাকবেন, ততদিন বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

পুঁজিবাজারে বর্তমান যেসব কোম্পানি আছে তার মধ্যে কতগুলো পুঁজিবাজার বান্ধব? যদি বিশ্লেষণ করি এর ভিতর শতকার ৯৭ শতাংশ কোম্পানি তাদের অধিক পরিমাণ ব্যাংক লোন শোধ করার জন্য পুঁজিবাজারের দারস্থ হয়ে অতিরঞ্জিত ব্যবসার মুনাফা কাগজে কলমে দেখিয়ে সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান, কমিশনার, এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, অধীনস্ত কমকর্তা, ইস্যু ম্যানেজার কোম্পানি, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বোর্ড, রাজনৈতিক প্রভাব এবং অর্থ বিনিময় কমিশনের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে এসেছে। এইসব কোম্পানি বাজার থেকে শুধু শেয়ার বিক্রিমূল্যে নয় বরং এরা শেয়ারকে কারসাজি করে গেম্বলিং করে অধিক মুনাফা নিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে শেয়ার গছিয়ে দিয়ে পালিয়ে গেছে।

বিগত সরকারের খাইরুল-শিবলী কমিশনের আমলে ১৩০টি কোম্পানি পুঁজিবাজারে এসেছে। এগুলোর সক্ষমতা যাচাই করলে দেখা যাবে পুঁজিবাজারে আসার যোগ্যতাই নেই। শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা, সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনের অসাধু চেয়ারম্যান, কমিশনার, এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, কমকর্তা এবং ইস্যু ম্যানেজারের অনৈতিক প্রভাবেই এই কোম্পানিগুলো বাজারে আসতে পেরেছে। এদেরকে আইনের আওতায় আনা উচিত।

পুঁজিবাজারে অস্থিরতা রোধে কিছু প্রস্তাবনা

সবার প্রথমে বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। একজন সাধারণ বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজারে কেন বিনিয়োগ করবে, যেখানে ব্যাংকগুলো বছরে ১২ শতাংশ সুদ দেয়। সেখানে পুঁজি হারাবার জন্য বাজারে মাফিয়াদের প্রলোভনে গুজবে অতি লাভের আশায় কেনো বিনিয়োগ করবে?

১. কোম্পানিগুলোকে বছরে নগদ লভ্যাংশ ২০ শতাংশ দিতে হবে।

২. বিগত সরকারের আমলে খাইরুল-শিবলি রুবাইয়েতের আমলে ১৩০টি কোম্পানি পুঁজিবাজারে আইন বহির্ভূত আসছে তাদের সব খতিয়ে দেখতে হবে। এই কোম্পানিগুলো আনার জন্য যে সকল সংস্থা এবং ইস্যু ম্যানেজার কাজ করেছে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। এই বাজে কোম্পানির শেয়ারগুলো কোম্পানির মালিক এবং ইস্যু ম্যানেজার কোম্পানিগুলোকে বর্তমান দামে কিনে নিতে হবে।

৩. সকল ব্রোকারেজ লোন বন্ধ করতে হবে, শুধু মার্চেন্ট ব্যাংক লোন দিতে পারবে নিজ দায়িত্বে। কোনো ব্যক্তিকে নয়, শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক লোন দেওয়া হবে নিজ দায়িত্বে। সাধারণ বিনিয়গকারীদের মাঝে গুজব ছড়িয়ে শেয়ার কেনা বন্ধ করতে হবে।

৪. কোম্পানি তালিকা নীতিমালা এবং মানদণ্ড কঠোরভাবে মনিটর করা উচিত। প্রয়োজন হলে, পুঁজিবাজারের মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে পরামর্শ করে নতুন নিয়ম ও বিধিমালা বাস্তবায়ন করা উচিত। ভবিষ্যত প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকা একটি কোম্পানি পুঁজিবাজার থেকে তহবিল সংগ্রহের সুযোগ পেতে পারে। কাগজে-কলমে লাভ দেখিয়ে বাজে কোম্পানি পুঁজিবাজারে আনা যাবে না।

৫. শেয়ার গ্রুপের শ্রেণিবিভাগ পুনঃসংশোধন করা উচিত। A, B, G, N এবং Z গ্রুপের পরিবর্তে একটি ঐক্যবদ্ধ ফরম্যাট থাকা উচিত। যখন একটি কোম্পানি লভ্যাংশ প্রদান করতে ব্যর্থ হয়, তখন শেয়ারটিকে Z গ্রুপে রাখা আসলে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি করে; বরং আমাদের উচিত কোম্পানিটি কেন লভ্যাংশ বিতরণে ব্যর্থ হলো, তা নিয়ে তদন্ত করতে হবে। কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদকে যেকোনো ধরনের আর্থিক অপব্যবহারের জন্য নিয়ন্ত্রকদের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হবে। পুঁজিবাজারের টাকা দিয়ে কোম্পানির বোর্ডের পরিচালকরা কোনো অপচয় করতে পারবে না। যেমন, কোম্পানির পক্ষ থেকে গাড়ি কেনা, পরিচালকের জন্য ব্যক্তিগত বিদেশ ভ্রমনের টাকা।

৬. যখন একটি কোম্পানি পাবলিক হতে চায়, তখন কমপক্ষে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের কাছে ৫১ শতাংশ শেয়ার থাকতে হবে এবং বাকি ৪৯ শতাংশ শেয়ার প্রাথমিক পাবলিক অফারের (IPO) জন্য অনুমোদিত হওয়া উচিত। এইভাবে কোম্পানির প্রতি জবাবদিহি এবং দায়িত্ব আরও ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। যদি পাবলিক শেয়ার দিয়ে কোম্পানির বোর্ডের ডিরেক্টরের থেকে বেশি শেয়ার হয়ে থাকে তাহলে পাবলিক শেয়ার দিয়ে ওই বিনিয়োগকারী বোর্ড পরিচালনা করার জন্য যোগ্য হবে, এতে করে কোম্পানির মালিকদের শেয়ার বিক্রির ঝুকি কম থাকবে। ২ শতাংশ থেকে কমপক্ষে ১০ শতাংশ শেয়ার হলে বোডে থাকতে হবে এই আইন প্রয়োগ করতে হবে, যোগ্য ব্যক্তি দ্বারা কোম্পানি পরিচালনা করা প্রয়োজন, কোম্পানি গুলোকে পারিবারিক সম্পদ থেকে বিরত রাখাই উত্তম। বিনিয়োগকারীদের মধ্য থেকে যে কেউ অধিক শেয়ার কিনে কোম্পানি পরিচালনার দায়িত্ব নিতে পারবে এই আইন করতে হবে। মোদ্দাকথা কোম্পানি পরিচালনা করার জন্য যোগ্য প্রতিনিধির প্রতিযোগিতা থাকা উচিত।

৭. একটি উদীয়মান বাজার এবং আমাদের পুঁজিবাজার সম্পর্কে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে, তাই মূলধন লাভ কর প্রয়োগ করা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য বোঝা হতে পারে। বাজার একটি নির্দিষ্ট উচ্চপর্যায়ে পৌঁছানোর পর আমরা সেই মূলধন লাভ কর প্রয়োগ করতে পারি। কর কোম্পানির মাধ্যমেই প্রদান করা হবে, সাধারণ বিনিয়োগকারী কেনো কোম্পানির লভ্যাংশের কর প্রদান করবে। কর কোম্পানি লভ্যাংশের উপর এককভাবে প্রদান করার যদি সেই কর সাধারন বিনিয়োগ কারিদের উপর ও অব্যাহত থাকে তাহলে কর ২-৩ বার আদায় করা হয়, এই বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার।

৮. প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের জন্য সুদের হার কম খরচের তহবিল ব্যবস্থা করা উচিত (ডিলার কোড)। এটি পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়াবে।

৯. সাধারণ জনগণকে পুঁজিবাজার সম্পর্কে সচেতন করতে বিপণন উপকরণ ব্যবহার করা যেতে পারে। আমাদের দেশের বেশির ভাগ সাধারণ মানুষের পুঁজিবাজারের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। কিন্তু একজন সাধারণ বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজার থেকে প্রচলিত বিনিয়োগ কৌশলের তুলনায় বেশি লাভ করতে পারে। আমাদের মোট জনসংখ্যার সাথে তুলনা করলে বিও অ্যাকাউন্টের (BO) সংখ্যা খুবই কম, তাই শেয়ারবাজারের সঠিক ব্র্যান্ডিং প্রয়োজন।

১০. সম্প্রতি আমাদের পুঁজিবাজারে পতন দেখা গেছে। তাই পরিস্থিতি আরও খারাপ না করার জন্য, নেগেটিভ ইকুইটি অ্যাডজাস্টমেন্ট আরও বাড়ানো যেতে পারে। ব্রোকারেজ হাউজ কোনো লোন দিতে পারবে না পাবলিক বিও একাউন্ট হোল্ডারদের। লোন শুধু মাত্র প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান পাবে মাচেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে এবং মাচেন্ট ব্যাংক এই লোনে সকল দায়িত্ব নিবে নিজ দায়িত্বে কোনো ওজর আপত্তি করতে পারবে না রেগুলেটরি কমিশনের কাছে, মোদ্দাকথা মাচেন্ট ব্যাংক নিজ দায়িত্বে লোন দিবে প্রতিষ্ঠানকে যদি ক্ষতি হয় উভয় মিলে সমস্যার সমাধান করবে, মারকেটে শেয়ার জোরপূর্বক বিক্রি করে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। প্রতিষ্ঠান এবং মাচেন্ট ব্যাংক উভয় মিলে লোনের সমস্যা সমাধান করবে এর জন্য সাধারণ বিনিয়োগ কারির উপর গুজব ছড়িয়ে শেয়ার বিক্রি করে পালিয়ে যেতে পারবে না।

১১. বাই ব্যাক আইন পরিবর্তন হতে হবে। কোনো কোম্পানির শেয়ার দাম যদি পড়ে যায় ,বাংলাদেশের সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনের আইন অনুসারে কোম্পানি এমপ্লোই প্রভিডেন্ড ফান্ড দিয়ে শেয়ার ক্রয় করে এমপ্লোইদের মাধ্যমে বিতরণ করতে পারে। যা খুবই দুর্বল আইন ,আইন হওয়া উচিত কোম্পানিকে সকল পাবলিক শেয়ার মালিক পক্ষের কিনে নিতে হবে বাজার মুল্যে।


লেখক: পুজিবাজার বিশ্লেষক এবং বিনিয়োগকারী

আরটিভি/ ডিসিএনই

মন্তব্য করুন

Bangal
rtv Drama
Radhuni
  • মুক্তমত এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
পুঁজিবাজারে অস্থিরতার পেছনে প্লেয়ার ও রেগুলেটরদের দায় আছে: অর্থ উপদেষ্টা
১৫ বছরে রিজার্ভ থেকে উধাও ২৪ বিলিয়ন ডলার: গভর্নর
পুঁজিবাজারে টানা দরপতন, বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ
পুঁজিবাজারের অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে কমিটি