২০১৪ থেকে ২০২৪ : দলীয় সরকারের অধীনে ভোটের হালচাল
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অংশ হচ্ছে নির্বাচন। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ক্ষমতাকে বৈধতা দেয়। গ্রহণযোগ্য না হলে সেই ক্ষমতার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তাই নির্বাচন শুধু আইনি বা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার বিষয় নয়, এর সঙ্গে ক্ষমতার বৈধতা, গণতন্ত্র, রাজনৈতিক বন্দোবস্ত- এ সবকিছুই জড়িত।
স্বাধীনতার পর এই পর্যন্ত ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে আটবার সামরিক শাসনসহ দলীয় সরকার ও চারবার নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে।
২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে। এর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায়। এর পর দলীয় সরকারের অধীনে টানা তিনটি নির্বাচন হয়েছে। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচন।
৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৯টি আসনের মধ্যে ২৯৮টির ফলাফল পাওয়া গেছে। রোববার (৭ জানুয়ারি) রাতে বেসরকারি ফলাফল অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ২২৫টিতে বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন। কল্যাণ পার্টির একজন। এ ছাড়া ৬১টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। আর জাতীয় পার্টি জয় পেয়েছে ১১টি আসনে।
২০১৪ : দশম সংসদ নির্বাচন
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়া হয়। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বিএনপির পক্ষ থেকে টানা অবরোধের মাধ্যমে নির্বাচন প্রতিরোধের কর্মসূচি দেওয়া হয়। মহাজোটের অংশীদার জাতীয় পার্টিও প্রাথমিকভাবে নির্বাচনে না যাওয়ার কথা জানিয়েছিল। পরে দেশি-বিদেশি নানামুখী চাপে দলটি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়।
বিএনপির বর্জন সত্ত্বেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ‘একতরফা’ এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর জোটভুক্ত দলগুলোসহ মাত্র ১২টি দল অংশ নেয়। এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জোট ও তাদের শরিক দলের প্রার্থীরা ভোটের আগেই ৩০০ আসনের মধ্যে অর্ধেকের বেশি অর্থাৎ ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। অপরদিকে ১৪৭ আসনে নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতায় প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ৩৯০।
এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একাই ২৩৪টি আসন পায়। জাতীয় পার্টি ৩৪টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ৬টি, জাসদ (ইনু) ৫টি, তরীকত ফেডারেশন ২টি, জাতীয় পার্টি (জেপি) ২টি, বিএনএফ ১টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১৬টি আসনে জয়লাভ করেন। এ নির্বাচনে (১৪৭টি আসনে) ভোট প্রদানের হার দেখানো হয় ৪০.০৪ ভাগ।
দশম সংসদ নির্বাচনের ভোটের দিন সহিংসতার ঘটনায় নিহত হন ১৯ জন। নির্বাচনপূর্ব সহিংসতার দিক থেকে এ নির্বাচন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটের আগের দিন পর্যন্ত নিহত হন ১২৩ জন।
নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তৃতীয় দফা সরকার গঠিত হয়। এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে সংসদে ‘বিরোধী দল’ বানানো হয়। একই সঙ্গে দলটি থেকে মন্ত্রীও করা হয় এবং এরশাদকে বানানো হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত।
আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল এর আগে বিএনপি সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মতো ‘একতরফা’। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর বিএনপি সরকার কয়েক দিনের মধ্যে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ভূরাজনৈতিক সমীকরণ নিজেদের পক্ষে থাকায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়।
২০১৮ : একাদশ সংসদ নির্বাচন
২০১৪ সালের মতো ২০১৮ সালেও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে সন্দেহ-সংশয় ছিল। নির্বাচনের আগে বিএনপির সঙ্গে আরও কিছু দল যুক্ত হয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে একটি রাজনৈতিক জোট গঠন করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ আরও কিছু দল ও জোটের সঙ্গে সংলাপ করেন এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেন। এ রকম প্রেক্ষাপটে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৩৯টি দল এতে অংশ নেয়। মোট প্রার্থী ছিলেন ১ হাজার ৮৬৫ জন।
এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একাই ২৫৮টি আসন পায় বলে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করে। জাতীয় পার্টি ২২টি এবং মহাজোটভুক্ত অন্য দলগুলো ৮টি আসনে জয়ী হয়। অপরদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত বিএনপি ৬টি, গণফোরাম ২টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৩টি আসনে জয়ী হন।
এ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি দেখানো হয় ৮০.২০ শতাংশ। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় মোট ভোটের ৭৪.৪৪ শতাংশ। অপরদিকে বিএনপি পেয়েছে মাত্র ১২.০৭ শতাংশ ভোট।
নির্বাচনের কয়েক দিন পর নির্বাচন কমিশন তাদের ওয়েবসাইটে কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ এবং ১,৪১৮টি কেন্দ্রে ৯৬ শতাংশের ওপর ভোট পড়েছে। এ নির্বাচন নিয়ে টিআইবির (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) এক গবেষণায় বলা হয়, ৫০টি আসনের মধ্যে ৪৭টিতে কোনো না কোনো অনিয়ম হয়েছে।
এ নির্বাচনের ফলাফল, বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোট প্রদানের হার এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে ভোটের ব্যবধান নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন তৈরি হয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের পরিস্থিতি ও ফলাফল যে স্বাভাবিক ছিল না, সাবেক নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার নির্বাচননামা বইয়ে তা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে, জনগণের কাছে এ নির্বাচন ‘রাতের নির্বাচন’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
বিএনপিসহ বেশির ভাগ বিরোধী দল অংশ নেওয়ায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘অংশগ্রহণমূলক’ বলা যেতে পারে। কিন্তু এতে বিরোধীদের প্রাপ্ত আসনসংখ্যা ও ভোটের হার ছিল আগের নির্বাচনগুলোর তুলনায় অনেক কম। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনেরা প্রায় ‘একচেটিয়াভাবে’ এ নির্বাচনে জয়লাভ করে। ফলাফল বিবেচনা করলে এটাও একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ও একতরফা নির্বাচন।
২০১৮ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বার সরকার গঠন করে। এ নির্বাচনের পর সংসদের ভেতরে-বাইরে সর্বক্ষেত্রে সরকারি দলের প্রায় একক ‘আধিপত্য’ কায়েম হয়েছে। এর ফলে রাজনীতিতে বিরোধী দল ও মতের স্থান কমে গেছে এবং গণতান্ত্রিক পরিসর আরও সংকুচিত হয়েছে বলে মনে করে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
২০২৪ : দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন
২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো ২০২৪ সালেও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এবারের সংসদ নির্বাচনে ২৮টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও শরিক দলগুলো নির্বাচন বয়কট করে।
আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৩৯টি দল অংশ নেয়। মোট প্রার্থী ছিলেন ১ হাজার ৯৭১ জন।
রোববার (৭ জানুয়ারি) রাত ২টায় পর্যন্ত ২৯৯টি আসনের মধ্যে ২৯৮টির ফলাফল পাওয়া গেছে। এতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ২২৫টি আসনে বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন। জাতীয় পার্টি লাঙ্গলের ১১ জন, কল্যাণ পার্টির একজন ও স্বতন্ত্র ৬১ জন জয়লাভ করেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, প্রত্যাশার চেয়ে অনেক ভালো নির্বাচন হয়েছে। আমি এতটা আশা করিনি। আমরা সেটিসফাইড কী সেটিসফাইড না সেটা বলছি না। শুধু বলছি কোনো সহিংসতা হয়নি এ জন্য আমরা সেটিসফাইড। আল্লাহর রহমতে একজনও মারা যাননি। আর মারামারির যে সহিংসতা সেটা খুব একটা হয়নি। দ্যাট ইজ অ্যা গুড নিউজ।
তিনি বলেন, নির্বাচনে বিরোধিতা ছিল। দ্যাট ওয়াজ অ্যা বিগ চ্যালেঞ্জ। সেটাকে অতিক্রম করে ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে, সহিংসতা তেমন হয়নি, মৃত্যু হয়নি এবং যেখানে কিছু কিছু অনিয়ম হয়েছে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছি। এদিক থেকে নির্বাচনটা মোটামুটি সুনিয়ন্ত্রিত ছিল।
গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে সিইসি বলেন, নির্বাচন কমিশনের কাজ হচ্ছে নির্বাচন আয়োজন করে ফলাফলটা জনগণকে অবহিত করা। নির্বাচনটা গ্রহণযোগ্য হয়েছে কি হয়নি, এই মর্মে কোনো কর্তব্য নির্বাচন কমিশনের ওপর নেই। এটা পাবলিক বুঝবে গ্রহণযোগ্য হয়েছে কি না।
মন্তব্য করুন