ভোটের মাঠে সক্রিয় ৯ জোট, আসছে আরও
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সরগরম জোটভিত্তিক রাজনীতি। আদর্শগত বিরোধ থাকলেও নির্বাচনী ইস্যুতে গাঁটছড়া বাঁধছে দলগুলো। ইতোমধ্যে রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছে ৯টি রাজনৈতিক জোট। জোটগুলো হলো বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল, জাতীয় পার্টির নেতৃত্বাধীন ৫৯ দলীয় জোট, ড. কামাল হোসেন ও বি চৌধুরীর নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া, সিপিবির নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় বাম গণতান্ত্রিক জোট, ৪ দলীয় প্রগতিশীল জোট, ইসলামি গণতান্ত্রিক জোটে ৭ দল, এনপিপির নেতৃত্বে ১০ দল, নাজমুল হুদার নেতৃত্বে ৩১ দল। এছাড়া আরও কিছু ছোট দল জোট গড়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূলত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখেই এ ধরনের জোট গড়ার রাজনীতি শুরু হয়েছে। বড় দলগুলোর পাশাপাশি ছোট দলগুলোও ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করতে জোটের রাজনীতিতে শামিল হওয়ার কথা ভাবছে। তবে জোটের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি। দলটি এর আগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সরকারে ছিল। পরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোট করে বিগত মেয়াদে কমবেশি লাভবান হয়েছে। বর্তমানে দলটি সরকার ও বিরোধী দলে রয়েছে। আবার এরশাদ আছেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের পদে। নানাভাবে সুবিধা নেয়া ছাড়াও কয়েকজন মন্ত্রিত্বও পেয়েছেন।
জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বাধীন জোট আসলে কী করবে, তা এখনও ঠিক হয়নি। তবে একাধিক রাজনৈতিক জোট নিয়ে দর কষাকষির শক্তি বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে তৃতীয় শক্তি হিসেবে নতুন জোটগুলো যে জোটকে সমর্থন দেবে তারাই ক্ষমতায় যেতে পারে এই হিসেবেই মাঠে নেমেছে ছোটদলগুলো। যদিও ইতোমধ্যে ১৪ দল, ২০ দলীয় জোটে ও এরশাদের জোটও আসন বণ্টনসহ নির্বাচনকালীন ইস্যুতে ইতোমধ্যে দর কষাকষি শুরু করেছে।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার আরটিভি অনলাইনকে বলেন, জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। যে কোনো জোটেই যেতে পারে জাতীয় পার্টি। তবে এখনও শেষ কথা বলার সময় আসেনি। তফসিল ঘোষণার পরে সিদ্ধান্ত হবে একক নির্বাচন করবো নাকি জোটে থাকব। সময় বলে দেবে আমরা কোন জোটে গিয়ে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেব।
তিনি বলেন, আমাদের জোটে আরও একাধিক রাজনীতিক দলের যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে। তাদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। জাতীয় পার্টির নেতৃত্বাধীন জোট আরও বিস্তৃত হতে পারে বলেও দাবি করেন তিনি।
জোটের মাঠে এখন সবচেয়ে সক্রিয় গণফোরামের সভাপতি ড কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া। এই ঐক্য প্রক্রিয়ায় আছেন বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ তার নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট। এতে যুক্ত বিএনপিসহ আরও কয়েকটি ডানপন্থী দল যুক্ত হয়ে রাজনীতির মাঠে নিজেদের গুরুত্ব বাড়িয়ে তুলেছেন। শেষ পর্যন্ত এই জোটের কী হবে তা এখনও নিশ্চিত হয়নি। তবে ড. কামাল ও বি চৌধুরী দুজনেই এই ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন।
এসব বিষয়ে গণফোরামের সহ-সভাপতি এ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী আরটিভি অনলাইনকে বলেন, দেশের দুই বৃহৎ রাজনৈতিক জোটের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী একাধিক রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে পৃথক আরেকটি জোট গঠনের চেষ্টা চলছে। এজন্য আমরা বিএনপিকে লিখিতভাবে জামায়াতকে ছাড়ার আহ্বান জানিয়েছি। তিনি বলেন, এটি হচ্ছে নির্বাচনকালীন আদর্শিক জোট।
এদিকে, সিপিবি-বাসদের সঙ্গে বাম মোর্চার ৬ দল যুক্ত হয়ে গত জুলাইয়ে গঠিত হয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। এই জোটে সিপিবি- বাসদ ছাড়াও আছে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, বাসদ (মার্কসবাদী) ও ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ। এ জোটের ভোট ব্যাংক সমৃদ্ধ না হলেও রাজনীতিতে পুরোনো এই খেলোয়াড়েরা গুরত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেন। বাম গণতান্ত্রিক জোটের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সম্বনয়ক ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, আমরা আওয়ামী লীগ-বিএনপির মেরুকরণের বাইরে বাম বিকল্প গড়তে চাই। সেই লক্ষ্যেই এ জোট কাজ করে যাচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান আরটিভি অনলাইনকে বলেন, আপাতত চেয়ারপারসনের মুক্তি, একইসঙ্গে নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টিকেই গুরুত্ব দিয়ে এগোচ্ছি। এগুলোর সমাধান হলে পুরোদমে নির্বাচনী মাঠে নামব। তিনি আরও বলেন, জোট ভোটের রাজনীতিতে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার বিষয়টি এখনও বিবেচনাধীন। সময় এবং পরিস্থিতির ওপর বিবেচনা করে শেষ সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
এছাড়া ভোটের মাঠে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট এলায়েন্স (বিএনএ) নামে বিএনপির সাবেক নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার নেতৃত্বে থাকা একটি জোট আত্মপ্রকাশ করলেও তেমন সক্রিয় না। এই জোট এরশাদের জাতীয় পার্টির জোটের মধ্যে সক্রিয় আছে বলে জানা গেছে। এছাড়া শেখ শওকত হোসেন নীলুর গড়া ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) নেতৃত্বে একটি রাজনৈতিক জোটকে গড়া হলেও নিলুর মৃত্যুর পর তা এখন বেশ অনিশ্চিত।
আলহাজ মিছবাহুর রহমান চৌধুরীর বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোট ও সংসদ সদস্য এমএ আউয়ালের বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন ইসলামি গণতান্ত্রিক জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এছাড়া নিবন্ধিত চারটি দল নিয়ে মাঠে সক্রিয় প্রগতিশীল জোটও। জোটবদ্ধ দলগুলো হচ্ছে, গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল (পিডিপি) ও মুসলিম লীগ। এই জোট তেমন দৃশ্যমান না। তবে এসব দল ও জোটের সত্যিকার চেহারা কী হবে তা জানতে আরও কিছুদিন অপেক্ষায় থাকতে হবে।
জানতে চাইলে ১৪ দলের অন্যতম শরিক ন্যাপের কার্যকরী সভাপতি ও সাংসদ আমিনা আহমেদ আরটিভি অনলাইনকে বলেন, যেহেতু জোটের রাজনীতির প্রভাব এখন বেশি সে কারণে শক্তিশালী জোটগুলোকে বড় দুই জোট প্রাধান্য দিতে পারে। সবাইকে সংগঠিত করতে হলে আগে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে রূপরেখা ঠিক করে মাঠে নামতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে ১৪ দলীয় জোটের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হবে এ নিয়ে সন্দেহের কথাও জানান তিনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. রওনক জাহান বলছেন, বড় ইস্যুতে খুব ডান বা খুব বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো এক হতে পারে। তবে জোট গঠনের যে প্র্যাক্টিস বাংলাদেশে, ইদানীং তা খুবই অসুস্থতায় পৌঁছে গেছে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক জোট হলেও এর ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়নি। তবুও নির্বাচনকালীন জোটের প্রবণতা চলছে। চলমান রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় জোটের রাজনীতি অব্যাহত থাকার কথাও বললেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এই সাবেক শিক্ষক দাবি করেন, এই ছোট দলগুলোর বড় কোন ভোট ব্যাংক নেই এটা সত্য। কিন্তু দলগুলোর যে মূল নেতারা আছেন, তাদের সম্পর্কে মানুষের একটা ভালো ধারণা আছে। এখন তারা যদি বড় কোন দলের সঙ্গে জোট করতে পারেন, তাহলে নিসন্দেহে তারা বাড়তি কিছু ভোট টানতে পারবেন।
আরও পড়ুন :
এসজে/এমকে
মন্তব্য করুন