গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াকে ক্রীড়াঙ্গনের শ্রদ্ধা
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পুরাতন ভবনের তৃতীয় তলায় অর্থ্যাৎ বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনে চলছিল জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়নশিপের ১২তম রাউন্ডের খেলা। গতকাল শুক্রবার এনামুল হোসেন রাজীবের বিপক্ষে ভালো পজিশনেই ছিলেন আরেক গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান। তবে খেলাটি আর শেষ করা হয়নি জিয়ার।
জীবনের দীর্ঘ সময় যেখানে কাটিয়েছিলেন, সেই দাবা ফেডারেশনেই ম্যাচ চলাকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন দেশসেরা এই দাবাড়ু। শনিবার (৬ জুলাই) সকালে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে আবারও জিয়া এসেছিলেন, কিন্তু নিথর দেহ নিয়ে। এ সময় দেশের অন্যতম সেরা ক্রীড়াবিদকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন ক্রীড়াঙ্গনের অনেকেই।
জিয়ার চলে যাওয়া দাবার অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে দেখছেন দাবা ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ শাহাবুদ্দিন শামীম। তিনি বলেন, অনেকেই টুর্নামেন্টের পুরস্কার ও নানান সুযোগ-সুবিধা কম হলে খেলতে চাইতেন না। জিয়া কখনও এরকম ছিলেন না। সব টুর্নামেন্টেই তিনি অংশগ্রহণ করতেন। যেন অন্যরা তার মাধ্যমে শিখতে পারে।
তাই জিয়ার স্মৃতি ধরে রাখার পরিকল্পনা ফেডারেশন সাধারণ সম্পাদকের। তিনি আরও বলেন, আমাদের আলাদা একটি ফ্লোর পাওয়ার কথা ছিল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের মধ্যেই। সেখানে গ্র্যান্ডমাস্টার কর্নারের পরিকল্পনা ছিল। সেটা যতদিন না হয় আমরা বর্তমান ক্রীড়াকক্ষই জিয়ার নামকরণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানে পড়াশোনা করেও উন্নয়ন সেক্টরে চাকরি নেননি। দাবা খেলে এবং কোচিং করিয়েই পরিবার চালিয়েছেন। তার স্ত্রী তাসমিন সুলতানা লাবণ্য বিসিএস ক্যাডারে যোগদান করেননি স্বামীর দাবাপ্রেমের জন্যই। একমাত্র ছেলে তাহসিন তাজওয়ারও ফিদে মাস্টার। বাবা-ছেলে অলিম্পিয়াডও খেলেছেন। জিয়াই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
জিয়ার জানাজায় এসেছিলেন ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম অভিভাবক বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের (বিওএ ) মহাসচিব সৈয়দ শাহেদ রেজা। বিওএ এবং তিনি নিজ থেকেও জিয়ার পরিবারের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছেন।
শাহেদ রেজা বলেন, জিয়া শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব দাবা অঙ্গনে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশন আর্থিক ব্যাপারে তার পরিবারের পাশে থাকবে। ব্যক্তিগতভাবে আমিও জিয়ার পরিবারের জন্য আর্থিক-অনার্থিক যেকোনো প্রয়োজনে এগিয়ে আসব।
জিয়া জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ আনসারের হয়ে খেলেছিলেন। আনসারের হয়ে খেলতে খেলতেই দুনিয়া ছাড়লেন তিনি। আজ জানাজায় আনসারের ক্রীড়া কর্মকর্তা প্রতিষ্ঠানের বিধি অনুযায়ী জিয়ার সাহায্য পাওয়ার কথা জানান।
এদিন ক্রীড়া পরিষদে জিয়ার জানাজায় এসেছিলেন দেশের দুই সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার আবদুল্লাহ আল রাকিব ও এনামুল হোসেন রাজীব। গতকাল রাজীবের সঙ্গে খেলতে খেলতেই জিয়া মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তার মাথায় এখনও ঘুরে সেই স্মৃতি।
রাজীব বলেন, ২৫ চাল পর্যন্ত হয়েছিল খেলার। জিয়া ভাইয়ের পজিশন ভালোই ছিল। একবারের জন্যও মনে হয়নি সে অসুস্থ বা একটু অন্যরকম। তার একটি চাল মনে হয়েছিল খুবই সাধারণ, কিছুক্ষণ পর বুঝলাম খুবই ভালো চাল ছিল।
তিনি বলেন, সে সবচেয়ে বেশিবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। একসময় তার পজিশনিং অবস্থান ছিল বিশ্বের মধ্যে অন্যতম। ডিফেন্সিভ ওপেনিং-অ্যাটাকিং সবই তার সমান দক্ষতা ছিল। জিয়া ভাই অনেকদিন বলতেন কিংস ইন্ডিয়ান ডিফেন্স খেলি না কেন আমি। গতকাল সেটাই খেলছিলাম। খেলাটা আর শেষ হলো না।
পাঁচ গ্র্যান্ডমাস্টারের মধ্যে জিয়া এবং রাজীবই কোচিং করান। কোচ জিয়াও খেলোয়াড় জিয়ার চেয়ে কম নন– অকপটেই বললেন রাজীব, তার বাসায় ভারত থেকে দাবাড়ুরা এসে খেলা শিখত। তার অনেক ছাত্র ভারতে গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছে, আরও অনেক টাইটেল জিতেছে। কোচ হিসেবেও তিনি অনেক সফল।
সকাল সোয়া এগারোটার দিকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নিচে জিয়ার লাশবাহী গাড়ি পৌঁছায়। সেখানে আধঘণ্টার একটু বেশি সময় রাখা হয় তার লাশ। এরপর মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের উদ্দেশে নেওয়া। সেখানেই আরেক দাবাড়ু বাবা পয়গম আহমেদের পাশে চিরশায়িত হবেন গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়া।
শেষবারের মতো দেখতে ছুটে এসেছিলেন দাবা অঙ্গনের অনেকেই। জিয়ার পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতার গণ্ডি দাবা ছাড়িয়ে সামগ্রিক ক্রীড়াঙ্গনেই ছিল। তার কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে দেশের অন্যতম শীর্ষ ক্রীড়া সংস্থা অলিম্পিক এসোসিয়েশন, দাবা ফেডারেশন, বাংলাদেশ স্পোর্টস জার্নালিস্টস এসোসিয়েশন, দাবা, তায়কোয়ান্দো ফেডারেশন।
ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন না করলেও জিয়ার জানাজায় উপস্থিত ছিলেন হ্যান্ডবল, অ্যাথলেটিক্স, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল, সাইক্লিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ও বিভিন্ন ফেডারেশনের খেলোয়াড়-কর্মকর্তারা। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম এলাকার সবচেয়ে বড় ক্রীড়া ফেডারেশন ফুটবল (বাফুফে) থেকে কাউকে দেখা যায়নি।
মন্তব্য করুন