টিস্যু পেপারের চুক্তিতে ১৮ বছর পার
নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজের মাঠে বার্সেলোনার সাবেক ফুটবলার ও তৎকালীন টেকনিক্যাল সেক্রেটারি কার্লোস রেক্সাস হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আর দেখছেন মাঠের সবথেকে ছোটখাটো ও দুর্বল ছেলেটা তার থেকে আধহাত লম্বা সব খেলোয়াড়দের বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে একের পর এক গোল দিয়েই যাচ্ছে! বলটা মনে হচ্ছে চুম্বক দিয়ে ওর পায়ে লাগানো আছে, পা থেকে সরছেই না! বাকি খেলোয়াড়রা একটু পর মনে হলো হাল ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল, আর ছোট ছেলেটা বড় বড় গোল দিতে লাগলো!
এতক্ষণ উপরে যার বর্ণনা দেয়া হল এটা ছিল লিওনেল মেসির ছোটবেলার খেলার একটি মুহূর্তের কথা। যার খেলা দেখেই চোখ ঝলসে গিয়েছিল বার্সেলোনার সাবেক খেলোয়াড় ও কোচ কার্লোস রেক্সাসের। তার তখনকার কাজ ছিল দেশে বিদেশে ঘুরে ঘুরে বার্সার বিখ্যাত ‘লা মেসিয়া’ একাডেমির জন্যে প্রতিভাবান ফুটবলার খুঁজে বের করা। ফুটবলের ভাষায় যাকে বলে ‘স্কাউট’।
মেসির খেলা তাকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে তাকে পেতে তাৎক্ষণিকভাবে টিস্যু পেপারেই চুক্তি করে ফেলেন তিনি। পরে সেই টিস্যু পেপারের চুক্তিপত্রে সাক্ষর করেছিলেন বার্সেলোনার সাবেক ফুটবলার ও তৎকালীন টেকনিক্যাল সেক্রেটারি চার্লস রেক্সাচ, বিখ্যাত এজেন্ট জোসেফ মারিয়া মিঙ্গুয়েলা এবং আর্জেন্টাইন প্রতিনিধি হোরাসিও জাগিওলি।
ঘটনাটা একবিংশ শতাব্দীর অর্থাৎ, ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর। অন্যান্য সাধারণ সব চুক্তির মতো ছিলো না মেসির সাথে করা বার্সার সেই চুক্তি। এরপরের ঘটনাতো সবারই জানা। মেসিকে বার্সা যতটুকু দিয়েছে, মেসি বার্সাকে তেমনই হৃদয় খুলে দিয়েছেন।
হরমোন জটিলতায় ভুগে মেসির ফুটবল ক্যারিয়ার যখন শেষ হতে যাচ্ছিল তখন বার্সেলোনা কর্তৃপক্ষ তার পুরো চিকিৎসা ব্যয় বহন করে আবার তাকে খেলার মাঠে ফিরিয়ে আনে। এরপর শুরু হয় লিওনেল মেসি যুগের। ইতিহাসে যোগ হয়েছে রেকর্ডের পর রেকর্ড।
বার্সেলোনায় প্রথম দিকে মেসি একেবারেই মানিয়ে নিতে পারছিল না। আর্জেন্টিনার সাথে স্পেনের অনেক ফারাক, ততদিনে মেসি সেটা ভালোমতোই বুঝে ফেলেছে। লা মেসিয়ায় প্র্যাক্টিসের সময়ই শুধু ভালো লাগে তার, ফুটবল যে মেসির বড় আপন! ধীরে ধীরে এই সমস্যা থেকেও বের হতে পারলো মেসি, লা মেসিয়ায় সেস্ক ফ্যাব্রেগাস, জেরার্ড পিকের মতো বন্ধু জুটে যায় তার!
লা মেসিয়ার খেলোয়াড়দের সাধারণত চার পাঁচ বছর লেগে যায় মূল একাদশ এমনকি বার্সা বি দলে সুযোগ পেতে। মেসি এখানেই অনন্য। লা মাসিয়ায় যোগ দেয়ার তিন বছরের মধ্যেই নিজের কারিকুরি দিয়ে সুযোগ করে নেন বার্সেলোনা মূল দলে! ২০০৩ সালে।
বার্সেলোনা দলে তখন রোনালদিনহো, ক্লাইভার্টদের মতো তারকার মেলা। সেখানেও নিজের শৈলী দেখাতে ভুল করেনি মেসি, ষোল বছর বয়সেই বার্সেলোনা কোচের চোখে পড়ে যেতে দেরি হলো না মেসির। সে বছর মূল দলে আরো একজন তারকার অভিষেক হয়েছিল। তার নাম আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, যাকে বলা যায় একবিংশ শতাব্দীর সেরা মিডফিল্ডারদের একজন। মেসির অবশ্য মূল দলে মোটামুটি নিয়মিত হতে আরো সময় লেগেছে।
২০০৯ থেকেই একরকম অপ্রতিরোধ্য লিওনেল মেসি, পাঁচ পাঁচবার বিশ্বসেরা ফুটবলার হয়েছেন, এর মধ্যে টানা বিশ্বসেরা হয়েছেন চারবার! নামের পাশে একগাদা রেকর্ড, একগাদা এওয়ার্ড। বার্সার ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোল করেছেন, করিয়েছেন। বার্সার হয়ে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ ছয়টি কাপ জিতেছেন, আরো কত শত কৃতিত্ব যে তার ঝুলিতে।
মেসির ক্যারিয়ারে একটাই অপ্রাপ্তি, দেশের হয়ে অলিম্পিকের বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্ট ছাড়া আর কিছুই জেতা হয় নি তার। একটা বিশ্বকাপের খুব দরকার এই কিংবদন্তীর। ২০১৪-তে বিশ্বকাপের খুব কাছাকাছি গিয়েও ছুঁতে পারেনি আর্জেন্টিনা, দলটির আশা ভরসা সব এই মেসিকে ঘিরেই। রোজারিওর সেই ছোট্ট ছেলেটি আজ আর্জেন্টিনা দলের অধিনায়ক।
মেসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, স্প্যানিশ কোপা ডেল রেসহ ৩২টি শিরোপা এনে দিয়েছেন বার্সাকে। এক বছরে ৯১টি গোল করে এক বছরে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন।চ্যাম্পিয়নস লিগে সর্বোচ্চ আটটি হ্যাটট্রিকের মালিক তিনি। লা লিগায় এখন পর্যন্ত রেকর্ড গোল ৪০৪টি। ক্লাব ও জাতীয় দলের জার্সি গায়ে মেসির মোট গোল সংখ্যা ৬৭০টি। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে সর্বোচ্চ ২৬টি গোল করেছেন লিওনেল মেসি। এভাবে মাঠে বল গড়াতে গড়াতে বার্সেলোনার সঙ্গে মেসি পার করলেন ১৮টি বছর।
বার্সেলোনার সঙ্গে মেসির বর্তমান চুক্তির মেয়াদ দুই বছর বাকি আছে। চুক্তি শেষে তার বয়স দাঁড়াবে ৩৪। অবসরে যাওয়ার আগে শৈশবের ক্লাবে ফেরার ইচ্ছা জানিয়েছিলেন পাঁচবারের বর্ষসেরা এই ফুটবলার। তবে দলের সেরা তারকাকে ছাড়তে রাজি নন বার্তোমেউ। তার বিশ্বাস, নতুন চুক্তির করে ক্যারিয়ারের বাকিটা সময়ও মেসিকে বার্সেলোনায় রাখতে পারবেন।
বার্তোমেউ বলেন ‘লিও মেসি আমাদের সঙ্গেই থাকবে। সম্পর্কটা আজীবন থাকবে। সে আমাদের বলেছে যে সে এখানে খেলে যেতে চায়। আমরা তাকে পাঁচ বছরের নতুন চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছি। আমি আশা করি, আমরা চুক্তি নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাব।
এএ
মন্তব্য করুন